চট্টগ্রামের পাদুকাশিল্প

হাতে তৈরি জুতার ব্যবসায়ে দুর্দিন

কাঁচামালের দাম বেশি পড়ায় জুতা তৈরির খরচ বেড়েছে। এতে বিক্রি কমেছে। এভাবে সংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাতে তৈরি জুতার কারখানা।

হাতে তৈরি জুতার একটি কারখানায় কাজ করছেন কারিগরেরা। গত বুধবার চট্টগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ির নছু মালুম লেনে।
ছবি: জুয়েল শীল

তখন বেলা তিনটা। কারখানার ভেতরে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক। কাজের চাপ নেই বললেই চলে। কেউ বসে বসে বাংলাদেশ ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখছিলেন। কেউবা ঘুমাচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ জুতায় আঠা লাগাচ্ছিলেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়িতে অবস্থিত দিপালী সুজ কারখানায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেল। 

কারখানার মালিক মোহাম্মদ আজহার প্রথম আলোকে বললেন, সাধারণত ঈদের মৌসুমে ব্যবসা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর জুতার অর্ডার অনেক কম এসেছে। এ কারণে ব্যস্ততা কম। গত বছর যে জুতা ২ হাজার ৬০০ টাকা ডজন দরে বিক্রি হয়েছে। সেই একই জুতা এবার বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ ডজনপ্রতি দাম এক হাজার টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে বিক্রি কমে অর্ধেক হয়েছে। মূলত জুতা তৈরির উপকরণগুলোর দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে।

উদ্যোক্তারা জানান, পূর্ব মাদারবাড়িতে ১৯৮০ সালে হাতে তৈরি ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে পশ্চিম মাদারবাড়ি, নালাপাড়া, নিউমার্কেট, মোগলটুলি প্রভৃতি এলাকায়ও একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠে। এক বছর আগেও কারখানা ছিল প্রায় ৪০০টি। এখন তা কমে আড়াই শতে নেমে এসেছে। এখানকার পাদুকা চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজার এবং ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুচরা বিক্রেতারা কিনে নেন। বিক্রি হয় সাধারণত ডজন হিসাবে। কারখানাগুলোয় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানায় মূলত ছেলেদের স্যান্ডেল, শু, স্লিপার, স্নিকার ও হাফ শুর পাশাপাশি নারীদের হিল, স্যান্ডেল, শু ইত্যাদি তৈরি হয়। 

আগে ঈদ মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। কিন্তু এ বছর অর্ধেকও হবে না। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। এক বছরে দেড় শ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রচুর শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। 
মনজুর খান, সভাপতি, চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প গ্রুপ

জুতার বাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। শরিফ আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁর কারখানার নাম লি প্লাস সুজ। চল্লিশোর্ধ্ব এই ব্যবসায়ী জানান, ঈদ মৌসুম এসে গেলেও তাঁর ব্যবসায়ে মন্দা চলছে। মধ্যম মানের স্যান্ডেল প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় এক হাজার টাকা কম। 

শরিফ আহমেদ আরও বলেন, একেবারে প্রয়োজন না হলে মানুষ এখন জুতা কিনছেন না। এ কারণে বিক্রি কম। গত বছর ঈদ মৌসুমে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। এবার তিন লাখ টাকা হবে কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান বলে জানান। 

আরেক ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন ১৫ বছর ধরে জুতার ব্যবসা করেন। তাঁদের তৈরি জুতা চলে যায় নগরের হকার্স মার্কেট, নূপুর মার্কেট ও ফুটপাতের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। বাবুল বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে আঠা, রেক্সিন, রাবার, লেস ও স্টিকারসহ জুতা তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানিতে দাম বেশি পড়ছে। এতে জুতা তৈরির খরচ বেড়ে গেছে।

বিভিন্ন কারখানার মালিকেরা বলেন, সাধারণত ঈদ মৌসুমে হাতে তৈরি জুতার ব্যবসা চাঙা হয়। করোনার ধকল কাটিয়ে গত বছর কিছুটা ভালো ব্যবসা হয়েছিল। কিন্তু এবার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্ডার কমে গেছে। ঈদের আগে পয়লা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উৎসব হওয়ার পরও অর্ডার কম। 

শ্রমিকেরা ভালো নেই

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প গ্রুপের হিসাবে এক দশক আগেও চট্টগ্রামের পশ্চিম মাদারবাড়ি ও এর আশপাশের এলাকাগুলোয় হাতে তৈরি জুতার কারখানা ছিল প্রায় ৭০০। এমনকি গত বছরও চার শর মতো কারখানা ছিল। কিন্তু এবার তা কমে আড়াই শতে নেমে এসেছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, যেসব কারখানা চালু আছে, সেগুলোর শ্রমিকেরা যে যাঁর মতো করে জুতায় আঠা লাগানো, তলানি কাটা, ফিতা বাঁধা, সেলাই করা ও প্যাকেটে ভরার কাজ করছেন। এঁদেরই একজন মানিকগঞ্জের মো. আকবর, যিনি ২০ বছর ধরে আছেন চট্টগ্রামে। হাতে তৈরি জুতার কাজ করেই সংসার চালান। আকবর জানান, তিনি প্রতি মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা পান।   

দিপালী সুজের শ্রমিক মো. ইকবাল হোসেন ও মো. ওমর ফারুক জানান, তাঁরা মাসে ১৫ হাজার টাকা করে পান। ঈদ মৌসুমে সেটা বেড়ে ২০ হাজার টাকা হয়। এ টাকা দিয়ে চলা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কারণ, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি।   

সার্বিক বিষয়ে চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প গ্রুপের সভাপতি মনজুর খান বলেন, আগে ঈদ মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। কিন্তু এ বছর অর্ধেকও হবে না। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। এক বছরে দেড় শ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রচুর শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সামনে আরও কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।