
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া নতুন সিদ্ধান্তে এইচ–১বি ভিসা (যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কাজের ভিসা, যা বিদেশি দক্ষ পেশাজীবীদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কাজের অনুমতি দেয়) ব্যবস্থা বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখে পড়তে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে যাওয়া নিরুৎসাহিত করবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির প্রযুক্তি খাতের কর্মী সরবরাহের ধারা ভেঙে দিতে পারে।
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস হঠাৎ ঘোষণা দেয়, বিদেশি কর্মী নিয়োগে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এক লাখ ডলার অতিরিক্ত ফি নেওয়া হবে। এ ঘোষণা বিশেষ করে ভারতের আইটি পেশাজীবী ও চিকিৎসকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কারণ, বর্তমানে এইচ–১বি ভিসাধারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ভারতীয় নাগরিক। পরবর্তী সময় হোয়াইট হাউস স্পষ্ট করে জানায়, এই ফি কেবল নতুন আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং চিকিৎসকেরা এর আওতার বাইরে থাকতে পারেন।
তবে আসল ধাক্কা আসে গত মঙ্গলবার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) থেকে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এখন থেকে লটারি পদ্ধতির পরিবর্তে বেতনভিত্তিক নতুন নিয়মে এইচ–১বি ভিসা দেওয়া হবে। সরকারের দাবি, এতে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ও উচ্চ বেতন পাওয়া ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
নতুন নিয়মের ফলে শিক্ষার্থীদের সংকট আসলে কেমন হবে
এখন পর্যন্ত বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাঁদের পড়াশোনা শেষ করার পর এফ–১ (এফ–১ হলো যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা, যা শিক্ষার্থীদের স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন পড়াশোনার সুযোগ দেয়) স্টুডেন্ট ভিসা থেকে এইচ–১বি ভিসায় সমানভাবে আবেদন করতে পারতেন। নতুন নিয়মে সেই সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। এইচ–১বি ভিসায় আবেদন করতে হলে এখন থেকে নিয়োগদাতাকে শিক্ষার্থীকে ভৌগোলিক এলাকা ও পেশাভিত্তিক ন্যূনতম বেতন দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সান ফ্রান্সিসকো কাউন্টিতে একজন নতুন কম্পিউটার সায়েন্স স্নাতকের চাকরির ন্যূনতম বেতন হতে হবে ১ লাখ ৩৬ হাজার ডলার। তারপরও এআই প্রকৌশলীর তুলনায় এটি চার ভাগের এক ভাগ হবে। কারণ, বছরে ২ লাখ ১৪ হাজার ডলার বা তার বেশি আয়ের সুযোগ ছিল তাঁর।
লাস ভেগাসে ৯৭ হাজার ডলার আয় করা একজন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্টের ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হবে। অথচ একই শহরে সফটওয়্যার ডেভেলপারের জন্য ন্যূনতম বেতন হতে হবে ১ লাখ ৬৪ হাজার ডলার।
ফলে নতুন স্নাতকেরা সিলিকন ভ্যালির মতো প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলো থেকে বাদ পড়বেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যেতে বাধ্যও হবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাবটি কেমন হবে
বিদেশি শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) বিষয়ে পড়াশোনার পর যুক্তরাষ্ট্রে কাজের সুযোগ পাবেন, এই আশায় নিজেদের খরচে পড়াশোনা করেন। নতুন নিয়ম কার্যকর হলে এই পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং মার্কিন উচ্চশিক্ষা আকর্ষণও কমে যেতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজন STEM কর্মীর একজন বিদেশি, মোট সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। তাঁদের বেশির ভাগই ভারত, চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম থেকে এসেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কাজের নিশ্চয়তা না থাকলে অনেক শিক্ষার্থী বিকল্প হিসেবে জার্মানি বা অন্য দেশে চলে যাবেন। সম্প্রতি জার্মানির ভারতের রাষ্ট্রদূত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘আমাদের অভিবাসন নীতি জার্মান গাড়ির মতো—বিশ্বস্ত, আধুনিক ও পূর্বানুমানযোগ্য।’
অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিটা কী
এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এফ–১ ভিসা ছিল এইচ–১বি ভিসা, স্থায়ী বসবাসের অনুমতি ও নাগরিকত্বের পথে প্রথম ধাপ।
নতুন নিয়ম কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কমে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন অভিযান ও বাণিজ্যযুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের মতো দেশ থেকে নতুন শিক্ষার্থী ও কর্মী আসার প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তির অগ্রবর্তী খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। তরুণ বিদেশি কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের নিরুৎসাহিত করা মানে, ভবিষ্যতের উদ্ভাবন ক্ষমতা নষ্ট করা।’
ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপের দিকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি কোম্পানি ও শিক্ষার্থীদের পরিবার সজাগ দৃষ্টি রাখছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবন ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এফ–১ থেকে এইচ–১বি ভিসার পথ খোলা থাকবে কি না—নাকি নতুন নিয়মে ভেঙে পড়বে।