
উচ্চ বেতনের চাকরি মানেই ডিগ্রির প্রয়োজন, এ ধারণা আমেরিকার ক্ষেত্রে সব সময় সঠিক নয়, মানে ধারণা বদলে যাচ্ছে। লেন্ডিংট্রির নতুন সমীক্ষা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন লাখো মানুষ কোনো ব্যাচেলর ডিগ্রি ছাড়াই ছয় অঙ্কের উপার্জন করছেন। কিছু পেশার ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ বা তার বেশি কর্মী ডিগ্রি ছাড়াই বছরে এক লাখ ডলার বা তার বেশি আয় করছেন।
কিন্তু ইউরোপে এ চিত্র আলাদা, বলছে ইউরো নিউজ। এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপে আয়ের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো শিক্ষা। ইউরোপীয় কমিশনের ইনভেস্টিং ইন এডুকেশন ২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার প্রতিটি অতিরিক্ত বছর একজন ব্যক্তির আয় গড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। ইউরোপের ৩৬টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের আয় সব সময়ই মাঝারি বা নিম্নশিক্ষিতদের চেয়ে বেশি। তবে এ আয়ের ব্যবধান ইউরোপজুড়ে সমান নয়।
ইইউতে গড় ৩৮% বেশি আয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) গড় বার্ষিক নিট ব্যয়যোগ্য পারিবারিক আয় ছিল ২১ হাজার ৬৪৪ ইউরো। কর ও অন্যান্য কর্তনের পর পরিবারের মোট আয় থেকে ব্যয় ও সঞ্চয়ের জন্য যে অর্থ থাকে, সেটিই ব্যয়যোগ্য নিট আয়।
শিক্ষার স্তরভিত্তিক আয়ের চিত্র
—নিম্নশিক্ষা (ISCED ০–২): ১৭,৫১৭ ইউরো
—মাঝারি শিক্ষা (ISCED ৩–৪): ২১,৪০১ ইউরো
—উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি (ISCED ৫–৮): ২৯,৪৯০ ইউরো
এতে বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের আয় মাঝারি শিক্ষিতদের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি এবং নিম্নশিক্ষিতদের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বেশি।
পূর্ব ইউরোপে আয়ের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি
উচ্চ ও মাঝারি শিক্ষার মধ্যে আয়ের পার্থক্যে স্পষ্ট আঞ্চলিক প্রবণতা রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ব্যবধান
তুরস্ক—৬২%
লিথুয়ানিয়া—৫৭%
আলবেনিয়া—৫৪%
রোমানিয়া—৫১%
বুলগেরিয়া ও মন্টেনেগ্রো—৪৮%
লাতভিয়া—৪৪%
সার্বিয়া—৪০%
সবচেয়ে কম ব্যবধান
আইসল্যান্ড—৬%
নরওয়ে—৯%
সুইডেন—১৬%
ডেনমার্ক—১৯%
অস্ট্রিয়া—১৫%
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির আয়ের বাড়তি সুফল সবচেয়ে বেশি, আর নর্ডিক দেশগুলোতে আয়ের বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। ইউরোপের পাঁচটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে উচ্চ বনাম মাঝারি শিক্ষিতদের আয়ের পার্থক্য ইইউ গড়ের কাছাকাছি (৩১ শতাংশ)।
ইতালি—৩০%
জার্মানি—৩০%
যুক্তরাজ্য—৩৩%
ফ্রান্স—৩৪%
স্পেন—৩৪%
উচ্চ বনাম নিম্নশিক্ষা: ব্যবধান আরও বিস্তৃত
উচ্চশিক্ষা ও নিম্নশিক্ষিতদের আয়ের পার্থক্য আরও বিস্তৃত। ইইউতে এ ব্যবধান গড়ে ৬৮ শতাংশ। তবে অনেক দেশে তা দ্বিগুণের বেশি। সবচেয়ে বেশি ব্যবধান—
বুলগেরিয়া—১৭৮%
রোমানিয়া—১৪৮%
সার্বিয়া—১১৪%
তুরস্ক—১১১%
আলবেনিয়া—১০৮%
উত্তর মেসিডোনিয়া—১০৬%
মন্টেনেগ্রো—১০০%
এ দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের আয় নিম্নশিক্ষিতদের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ, যা তুলনামূলকভাবে নিম্ন ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে সম্পর্কিত। সবচেয়ে কম ব্যবধান—
আইসল্যান্ড—১৪%
নরওয়ে—২৪%
ডেনমার্ক—২৯%
ফিনল্যান্ড—৩৬%
নেদারল্যান্ডস—৪১%
সুইডেন—৪৮%
স্লোভেনিয়া—৪৮%
অস্ট্রিয়া—৪৯%
নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে বড় ব্যবধান
তথ্য বলছে, দেশের সামগ্রিক আয়ের স্তর যত কম, শিক্ষার স্তরভিত্তিক আয়ের বৈষম্য তত বেশি। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সবচেয়ে কম গড় বার্ষিক আয় পাওয়া গেছে এ দেশগুলোতে—
আলবেনিয়া—৪,৩৪৮ ইউরো
উত্তর মেসিডোনিয়া—৪,৯১৯ ইউরো
মন্টেনেগ্রো—৬,৪২৯ ইউরো
তুরস্ক—৭,৫৪২ ইউরো
সার্বিয়া—৮,৫৯৮ ইউরো
হাঙ্গেরি—১১,৫৮০ ইউরো
স্লোভাকিয়া—১১,৭৫২ ইউরো
রোমানিয়া—১২,৪৬৩ ইউরো
বুলগেরিয়া—১২,৫৬৯ ইউরো
গ্রিস—১৪,১৬৬ ইউরো
কীভাবে তৈরি হয় এ ব্যবধান
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফান্ডামেন্টাল রাইটস এজেন্সির সামাজিক বিশেষজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল জাজুর বলেন, কর ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা এ পার্থক্যের অন্যতম প্রধান কারণ। নর্ডিক দেশ, নেদারল্যান্ডস ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোতে উচ্চ করব্যবস্থা, শক্তিশালী কল্যাণভিত্তিক নীতি ও সেক্টরভিত্তিক মজুরি সমঝোতা আয়ের বৈষম্য কমাতে বড় ভূমিকা রাখে। ‘উচ্চশিক্ষার কম বাড়তি আয় কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং এটি সামাজিক মডেলের সাফল্য,’ বলেন জাজুর।
জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডের দ্বৈত উচ্চশিক্ষা–কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা মাঝারি শিক্ষিতদেরও ভালো আয়ের সুযোগ তৈরি করে। ‘এতে মাঝারি শিক্ষিতদের আয় বাড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে বৈষম্য কমে আসে,’ যোগ করেন জাজুর। অন্যদিকে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীরা অনেক বেশি আয় করেন, সেখানে সাধারণত দেখা যায়—
—দুর্বল সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা।
—উৎপাদনশীলতার খাতভিত্তিক বড় পার্থক্য।
—অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারের প্রসার।
—ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের আধিক্য।
ধনী ও সমতাভিত্তিক দেশগুলোতে যেমন আইসল্যান্ড বা নরওয়ে শিক্ষার স্তরভেদে আয়ের পার্থক্য তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু বুলগেরিয়া বা রোমানিয়ার মতো নিম্ন আয়ের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীরা নিম্নশিক্ষিতদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি আয় করেন।
ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে টিকে থাকার জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলেও আয়ের সমতা নির্ভর করছে কেবল শিক্ষার ওপর নয়, বরং দেশভেদে সামাজিক নীতি, করব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের কাঠামোর ওপরও।