সরকারি অনুদানের ছবি নিয়ে খুব কম মাতামাতি হয়। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ছবির ক্ষেত্রে ঘটে ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দাবিদার বদরুল আনাম সৌদের গহীন বালুচর। অনুদান পাওয়ার ছয় মাস নয় দিনের মাথায় ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা পড়েছে। আর এক সপ্তাহ পর ২০ অক্টোবর মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। মুক্তির আগে পরিচালক সম্প্রতি দলবল নিয়ে এসেছিলেন প্রথম আলো অফিসে। ছবিটাকে কেন্দ্র করে আড্ডায় মাতলেন তাঁরা। সেই আড্ডার কিছু খণ্ডচিত্র, কিছু কথা তুলে ধরছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাসুম আলী
একটা ধারণা ছিলই, সবার আগে আসবেন সুবর্ণা মুস্তাফা। এলেনও। ঘুড্ডি, নয়নের আলোর সুবর্ণা। সেই চিরচেনা হাসি। সঙ্গে বদরুল আনাম সৌদ, একটু বেশিই ব্যস্ত। দেখেই বোঝা যায়, রাজ্যের টেনশন তাঁর ভেতরে। অন্যরাও প্রায় কাছাকাছি সময়ে চলে এলেন। ফজলুর রহমান বাবু, রুনা খান, নীলাঞ্জনা নীলা, আবু হুরায়রা তানভীর ও জান্নাতুন নূর মুন, শিশুশিল্পী রাসেল। এসেছিলেন নৃত্যপরিচালক নাজিবা বাশার, চিত্রগ্রাহক কমল চন্দ্র দাসও। ল্যাপটপে ছবি নিয়ে কিছু একটা করছিলেন সৌদ। ঠিক সময়ে তা বন্ধ করে যোগ দিলেন আড্ডায়। আড্ডায় রাইসুল ইসলাম আসাদ, জিতু আহসানদের অভাব বোধ করছিলেন সবাই। সংগীত পরিচালক ইমন সাহার নামটিও প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে বেশ কয়েকবার।
কী সুন্দর লাগতেছে তোদের!
সবাই চলে এসেছেন। শেষে এলেন জ্যেষ্ঠ অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু। স্বভাবসুলভ সাবলীল কুশলাদির পর বসলেন। টেবিলের অন্য পাশে নবীন দুই শিল্পী মুন-নীলা বসে ছিলেন। পরিপাটি শাড়িতে দুই নারী আলো করে রেখেছিলেন ওই পাশটা। বাবু দুজনকেই লক্ষ্য করে বললেন, ‘কী সুন্দর লাগতেছে তোদের!’ নিজের চেয়ার থেকে উঠে মুন ও নীলার চুল ঠিক করে দিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা। এমন একটি দৃশ্য আড্ডাকে জমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বুঝতে বাকি রইল না, শুটিংয়ের দিনগুলোতে তিনিই ছিলেন ‘অভিভাবক সুবর্ণা’। ছবিটির নির্বাহী প্রযোজকও তিনি।
এটা বাংলাদেশের গল্প
গহীন বালুচর, নাম শুনে একটু আঁচ করা যায় গ্রামীণ পটভূমির ছবি। পরিচালক সৌদ, অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা, বাবু তিনজনেই কাছেই এমনটা শোনা গেল, হ্যাঁ এটা বাংলাদেশের সিনেমা। একটা চরের গল্প। চিরন্তন বাংলার গল্প। চর দখল, বেদখল, পরস্পর সংঘাত। প্রথম ফ্রেম থেকেই দর্শক বুঝতে পারবেন এটি একটি সিনেমা, এটি একটি বাংলাদেশের সিনেমা। তাঁরা প্রথম থেকেই বুঝতে পারবেন যে তাঁরা একটি সিনেমা দেখছেন।
সুবর্ণা মুস্তাফাই আড্ডার মধ্যমণি। সব সময় যাঁকে সোজা-সাপটা কথা বলতে শুনেছি, দেখেছি। তাই তাঁর কাছে আবার বিশেষভাবে জানতে চাই, বড় পর্দার পরিচালক হিসেবে সৌদের গহীন বালুচর কতটা গহিন। বললেন, ‘গহীন বালুচর একটি পুরোদস্তুর চলচ্চিত্র। সামগ্রিকভাবে এর আবহ সংগীত, সংগীতায়োজন, অভিনয় িচত্রায়ণ সব মিলিয়ে এটি একটি পরিপূর্ণ চলচ্চিত্র।’
‘নাচে-গানে ভরপুর আমাদের এ সিনেমা’, বললেন সুবর্ণা। ‘চমৎকার কিছু গান আছে, ছবির ফটোগ্রাফি খুব সুন্দর। মানুষ হলে বসে ছবিটা দেখে কমপ্লিট একটা ফিলিং নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এখানে না বোঝার কোনো জায়গা নেই, খেই হারিয়ে ফেলার কোনো ফুরসত নেই। কারণ, ছবির গল্পটা “ভেরি ওয়েল টোল্ড”—প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। অনেক সময় কিছু ছবি দেখতে দেখতে আমরা বলে উঠি-না, আরে, কী হলো এটা, কিছুই বুঝলাম না! এ রকম বলার কোনো জায়গা নেই এখানে।’ পরিচালক সৌদ ও অভিনেত্রী সুবর্ণার মন্তব্য এমনই। সৌদ বলেন, ‘আমি দর্শকের জন্য ছবি বানিয়েছি। পুরস্কার কিংবা বিদেশের প্রতিযোগিতায় পাঠানোর জন্য নয়।’
মাথার ভেতর লেডি ম্যাকবেথ, হ্যামলেটের গারট্রুড
আড্ডার সূত্র ধরিয়ে দিলেন প্রথম আলোর উপ-ফিচার সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর। শামিল হলেন ছবির গানের গীতিকার কবির বকুল। সুবর্ণা মুস্তাফা তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এভাবে, ‘যে গানটা শুনে তোমরা উঁহু, আহা করছ, সেই গানের গীতিকার ইনিই।’
জানলাম, গহীন বালুচর-এর পুরো গল্পটাকে এগিয়ে নিয়েছে পাঁচটি গান। ‘তারে দেখি আমি রোদ্দুরে’, ‘তাতা থই তাথৈ তাথৈ’, ‘ভালোবাসায় বুক ভাসাইয়া’, ‘ঝড়ের মধ্যে পইড়া গেছে নাও’ এবং ‘চর জেগেছে’—যেগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাপ্পা মজুমদার, দিনাত জাহান মুন্নি, লিজা, চন্দন সিনহা, ফাহিমা নাসরিন, ঐশী, ফজলুর রহমান বাবু, জয়িতা, সাব্বির ও মনির। সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন ইমন সাহা। পরিচালক জানালেন, অযৌক্তিকভাবে আসেনি গান। বরং প্রতিটি গান গল্পের প্রয়োজনে এসে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
সুবর্ণা বললেন, প্রতিটা গানই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। গানে গল্প থেমে থাকে না একটুও। ছবির যেখানে গান আছে, সেখানে গান না থাকলে নতুন সিকোয়েন্স দিতে হতো। কারণ, তা না হলে ছবির গল্প এগোবে না।
গানের প্রাসঙ্গিকতা জানলাম, এবার গল্প ও চরিত্রে যাই। যদিও সব চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলাপে গেলেন না গহীন বালুচর-এর বাসিন্দারা। তা থাক দর্শকের জন্য, ২০ অক্টোবর জেনে যাবেন। তবে ছবির প্রচারণামূলক ভিডিও দেখে দর্শক ইতিমধ্যে ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে, সুবর্ণা মুস্তাফা ‘দাপুটে’। নাম আসমা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন কেউ? জানা গেল, চরিত্রটি একটু পোড়খাওয়া এক নারীর। কখনো তাঁর জীবনে বেশ রং ছিল হয়তো। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এখন এমন হয়ে গেছেন। যেহেতু গ্রামের সবার ভালোটা দেখতে হয় তাঁকে, নিজের ভালোটা তিনি এককভাবে দেখেন না। সবার জন্য করতে গিয়ে দিনের শেষে আসমা খুবই নিজের ভেতরে থাকা একটি চরিত্র। কিন্তু আসলে হচ্ছে বাস্তবিক ও পারিপার্শ্বিকতার কাছে অসহায় একটি চরিত্র।
যিনি ভাঙেন কিন্তু মচকান না। এক্সপ্রেশন ঠিক আছে, কিন্তু চরিত্রের চোখে কোনো পানি আসে না। এ চরিত্রটা করতে গিয়ে লেডি ম্যাকবেথ এবং হ্যামলেট-এর গারট্রুডকে মনে পড়েছিল সুবর্ণা মুস্তাফার।
বাঘ আসতেছে, বাঘ!
হাসতে হাসতে কথাটা জ্যেষ্ঠ শিল্পী ফজলুর রহমান বাবুই তুললেন। আড্ডা তখন শুটিংয়ের দিনগুলোতে। শীতকাল। অবিরাম চলছে শুটিং। একদিন দেখা গেল, ইউনিটের লোকজন সব ঝেড়ে পরিষ্কার করছেন। ব্যাপার কী? বাবু জানতে চাইছিলেন একজন কর্মীর কাছে। ‘বাঘ আসতেছে, বাঘ’—জবাবটা এমনই ছিল। সেদিন শুটিংয়ে আসবেন সুবর্ণা মুস্তাফা। নিজে যেমন গোছানো-পরিপাটি কথা বলেন, তেমনি সবকিছু পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন দেখতে পছন্দ করেন সুবর্ণা। তাই এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান।
তার আগেই শুটিং স্পটে পৌঁছেছিলেন অন্য শিল্পীরা। পরিচালক জানালেন, অডিশনের মাধ্যমে এসেছিলেন তরুণেরা। প্রথমে একটি কর্মশালার মাধ্যমে পরস্পরের জানার-বোঝার বিষয়টি হলো। লোকেশনে গিয়ে আবার নতুন করে জানাশোনা হলো। লোকেশনে পুরো দল বরিশালে ছিল এক মাসের বেশি সময়। পাঁচতলা একটা বিল্ডিংয়ের পাঁচটা ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলেন সবাই।
যেখানে অভিভাবকের মতো ছিলেন সুবর্ণা। যেখানে নবীনের সময়ের ব্যাপারটা তাঁরা প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না। রাত তিনটায় যে শুটিং কল হতে পারে, এটা তাঁদের জানা ছিল না, জানার কথাও নয়। এই ব্যাপারটা প্র্যাকটিসে ছিল না তাঁদের। তবে দু-তিন দিনেই বুঝে গেছেন তাঁরা ব্যাপারটা।
এমন অনেক কিছু ‘অর্জন’ হয়েছে মুন, নীলা, তানভীরদের। সাঁতার, নৌকা চালানোটা রপ্ত করেছেন ইতিমধ্যে। সেসব দিনরাত্রি খুব মধুর ছিল। ফজলুর রহমান বাবু গান শোনাতেন, গাড়িতে যাওয়া-আসার সময় গানে গানে চমৎকার সময় কাটত। তবে নীলা আর মুনের কণ্ঠে গান শোনাটা নাকি সবচেয়ে বড় কষ্টের ছিল। তাঁরা নিয়মিত গাইতেন। জোর করে গান শোনাতেন। চরম বেসুরো সে গান!
শেষ দৃশ্যটা এমন
অনেক কথাই হয়েছে জমজমাট আড্ডায়। ছবির শুরু গল্প, শুটিং দিনের গল্প, প্রত্যাশা—অনেক কথা। দুপুরের খাবার প্রস্তুত। কথায় কথায় সুবর্ণা বললেন, ‘শুটিংয়ের সময় খুব মুশকিলে ফেলেছিল নবীন শিল্পীদের খাদ্যাভ্যাস। এদের একজনও খেতে চাইত না। আউটডোর শুটিং, তার ওপর সিনেমার শুটিং। ওদের তো ধারণাতেই নেই কী কষ্ট করতে হয়! আর সৌদ পারফেক্ট না হওয়া পর্যন্ত শট নিতেই থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত শটটা পারফেক্ট না হবে, ততক্ষণ শট নেবে ও। সো, ওদেরও অনেক কষ্ট হবে, শক্তি লাগবে। এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো আহ্লাদ নেই। করলা খেতে হলে খাবে, ঢ্যাঁড়স খেতে হলে খাবে।’
অভিনেত্রী মুনের ভাষায়, ‘একেবারে মায়ের মতো জোর করে খাওয়াতেন সুবর্ণা ম্যাম, বকতেনও।’ তানভীর ও নীলা একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘সেটে সব সময় মায়ের মতো আদর করেছেন ম্যাম। আর সৌদ ভাই শিক্ষকের মতো।’ একবার একটি দৃশ্য কিছুতেই হচ্ছিল না। পরিচালক-অভিনেতা সৌদ অভিনেতা তানভীরকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন, ‘তুই যদি এটা না করতে পারিস, তোরে মেরেই ফেলব!’ বকা খেয়ে কান্নাকাটির ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
খাওয়া শেষে প্রথম আলোর নিজস্ব স্টুডিওতে ছবি তোলার পালা। সেখানেও চলে খুনসুটি। এখানেও পরিচালক সৌদ বাতলে দিচ্ছেন কোন ফ্রেমে কে কোথায় দাঁড়াবেন, কোথায় বসবেন। সুবর্ণাও। ছবিতে হাসি প্রয়োজন, মুন নীলাকে বলা হলো গান করতে। চাবি দেওয়া পুতুলের মতো একজন গান ধরলেন, ‘ভালোবাসায় বুক ভাসাইয়া, কী যতনে আমায় লইলা...।’ সম্মেলক হাসিতে গমগম করেই উঠল স্টুডিও।
গহীন বালুচর-এর বাসিন্দাদের আনন্দ দেখে ছবিটা কেমন হয়েছে, তা জানার আগ্রহটা আরও গভীর হয়।