ম্যাজিক লণ্ঠনের আয়োজনে দর্শক-শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন আজমেরী হক বাঁধন
ম্যাজিক লণ্ঠনের আয়োজনে দর্শক-শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন আজমেরী হক বাঁধন

জুলাইয়ে রাস্তায় নামাটা আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত : বাঁধন

‘লাক্স সুন্দরী থেকে নায়িকা বাঁধন এবং নায়িকা বাঁধন থেকে অভিনেত্রী বাঁধন হওয়ার একটা দীর্ঘ যাত্রা আমার আছে।’ এভাবেই নিজের পথচলার গল্প শুরু করলেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আজমেরী হক বাঁধন। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২৩ নম্বর কক্ষে এক আমন্ত্রণে দর্শক-শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেখানে শুনিয়েছেন তথাকথিত ‘আদর্শ নারী’র খোলস ছেড়ে একজন পরিপূর্ণ ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার সংগ্রামের কথা, যা তাঁর ব্যক্তি ও অভিনয়জীবনে এনেছে আমূল পরিবর্তন।

চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা 'ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১৩' শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে। এতে অংশ নিয়ে ‘অভিনয়, অভিনয়শিল্পী এবং আমার জীবন’ শিরোনামে বক্তব্য উপস্থাপন করেন আজমেরী হক বাঁধন। পরে তিনি উপস্থিত দর্শকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

অনুষ্ঠানে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সদস্য জেরিন আল জান্নাতের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন ম্যাজিক লণ্ঠনের সদস্য ও কথামালা-১৩–এর আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার সজীব। অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচককে সম্মাননা, ক্রেস্ট ও উপহারসামগ্রী তুলে দেন ম্যাজিক লণ্ঠন সদস্যরা। এতে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রবিষয়ক তাত্ত্বিক ও গবেষক আ-আল মামুন। আয়োজনে সমাপনী বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার।  

এদিন পথচলার গল্প বলেন আজমেরী হক বাঁধন। প্রথম আলো

অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক ২০০৬ সালের ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাঁধনের পথচলার কথা মনে করিয়ে দেন। সেই সূত্র ধরেই বাঁধন বলেন, ‘প্রথমে যখন আমি লাক্স থেকে বের হই, তখন সবাই আমাকে “লাক্স বা সাবান সুন্দরী” বলত এবং আমি ওটা মোটামুটি উপভোগ করতাম। ওই বয়সে আমার কাছে মনে হতো, এটা আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস।’

এরপর নাটক, সিরিয়াল ও বাণিজ্যিক সিনেমার নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। কিন্তু অল্প বয়সেই তাঁর মনে হয়েছিল, পড়ালেখা শেষ করাটা জরুরি। ডেন্টাল থেকে বিডিএস সম্পন্ন করার পর অভিনয়জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। বিয়ে এবং সন্তানের জন্মের পর তাঁর জীবনে নেমে আসে নানা বিপর্যয় বলে জানান তিনি।
বাঁধন বলেন, ‘আমার জীবনে নানা রকমের ডিজাস্টার শুরু হয়। তখন আমাকে আবার মিডিয়ার কাজে ফেরত আসতে হয়। কিন্তু তখনো আমি আমার এই কাজটাকে ভালোবাসতাম না। শুধু টাকার জন্য, আমার ও আমার মেয়ের জীবন নির্বাহ করার জন্য কাজ করে যেতাম।’

দর্শক-শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাঁধন। প্রথম আলো

২০১৮ সালকে নিজের জীবনের মোড় ঘোরানোর বছর হিসেবে উল্লেখ করেন এই অভিনেত্রী। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমার সন্তানের বাবা আমার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিতে চায়। ওই ঘটনা আসলে আমাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তথাকথিত ভালো মেয়েটা থেকে হঠাৎ আমার মনে হয়েছে যে মানুষের বাঁধনটা কোথায়? তার অস্তিত্বটা কোথায়?’

বাঁধন আরও বলেন, ‘যখন আমি একজন মানুষের মতো আমার অধিকার চাইছি, তখন এই সমাজ, দেশের আইন, এমনকি আমার নিজের পরিবারও বলেছে—না, এভাবে হবে না। কিন্তু আমি আমার অধিকার বুঝে পেতে চেয়েছিলাম।’

আজমেরী হক বাঁধন। প্রথম আলো

বাঁধন জানান, এই লড়াইয়ের ফল হিসেবেই তিনি তাঁর মেয়ের সম্পূর্ণ অভিভাবকত্ব লাভ করেন, যা ছিল বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী রায়।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অকপটে কথা বললেন বাঁধন। তিনি বলেন, ‘আমি ক্রনিক ডিপ্রেশন ও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগী এবং নিয়মিত থেরাপি নিই। থেরাপিস্টের এক প্রশ্নেই আমি নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করি। থেরাপিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি যে কাজটা করো, সেটাকে ভালোবাসো? আমি বলেছিলাম, না। তখন আমি উপলব্ধি করি, আমি আসলে অভিনয়টাই ঠিকমতো করতে চাই।’

এই উপলব্ধির পরেই তাঁর জীবনে আসে আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বাঁধন বলেন, ‘আমি দেড় বছর অন্য কোনো কাজ করিনি। পুরোটা সময় রেহানাকে দিয়েছিলাম। কারণ, আমি বুঝেছিলাম, এটাই আমার জীবনের একমাত্র সুযোগ। এই সিনেমার হাত ধরেই কান চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করি।’
‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর পর ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’, ‘খুফিয়া’র মতো আন্তর্জাতিক মানের কাজে নিজেকে প্রমাণ করেছেন বাঁধন। নিজের এই নতুন জীবনবোধ থেকেই সাম্প্রতিক ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
বাঁধন বলেন, ‘আমি যে মানুষ বাঁধন হওয়ার চেষ্টা করছি, তার কিছু সামাজিক দায়িত্ব আছে। আমার চোখের সামনে এত অন্যায় হচ্ছে, আর আমি একজন সুবিধাভোগী নাগরিক হিসেবে চুপ করে থাকব, তা হতে পারে না। জুলাইয়ের সেই দিনগুলোতে রাস্তায় নামাটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল।’
ভবিষ্যতে একজন চিত্রনাট্যকার হিসেবেও কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার মেয়ের জন্য সমাজটা বদলে যাক। আমি এমন গল্প বলতে চাই, যা শুধু বিশ্বদরবারে নয়, আমাদের দেশের দর্শককেও ছুঁয়ে যাবে।