‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’–এ ব্রিজিত বার্দো। আইএমডিবি
‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’–এ ব্রিজিত বার্দো। আইএমডিবি

চারবার বিয়ে থেকে বিতর্কিত রাজনৈতিক দর্শন, বার্দোকে কতটা চেনেন

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আবেদনময়ী অভিনেত্রী হিসেবে দুনিয়াজুড়ে হাজারো তরুণের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন ব্রিজিত বার্দো। মারা গেছেন আলোচিত সেই ফরাসি অভিনেত্রী ও গায়িকা। ২৮ ডিসেম্বর ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’।

১৯৩৪ সালে প্যারিসে ব্রিজিত আন–মারি বার্দোর জন্ম। তিনি বেড়ে ওঠেন সচ্ছল ও ঐতিহ্যবাহী ক্যাথলিক পরিবারে। নাচে তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ; অল্প বয়সেই শুরু করেন মডেলিং। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফরাসি সাময়িকী এল-এর প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন। এই মডেলিংয়ের সূত্রেই তাঁর কাছে চলচ্চিত্রের প্রস্তাব আসে।

শুরুর দিকে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও ধীরে ধীরে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাজ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবি ‘ডক্টর অ্যাট সি’-তে ডার্ক বোগার্ডের বিপরীতে অভিনয় করেন।

তবে বার্দোর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় রজার ভাদিম পরিচালিত ছবি ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’। একটি অডিশনে ভাদিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয়; ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ১৯৫২ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’ ছবিতে অবাধ্য এক কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে ওঠেন বার্দো। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ফরাসি চলচ্চিত্রের আইকন।

‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’–এ ব্রিজিত বার্দো। আইএমডিবি

পঞ্চাশ দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরুতে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি ছবিতে অভিনয় করেন বার্দো—ক্লদ অঁত-লারার ‘ইন কেস অব অ্যাডভার্সিটি’, অঁরি-জর্জ ক্লুজোর অস্কার মনোনীত ছবি ‘দ্য ট্রুথ’, লুই মাল পরিচালিত ‘ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার’ এবং জ্যঁ-লুক গদারের ‘কনটেম্পট’। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি হলিউডের দিকেও পা বাড়ান। এ সময় তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে আরেক ফরাসি কিংবদন্তি জ্যঁ মরোর সঙ্গে ‘ভিভা মারিয়া!’ এবং শন কনারির বিপরীতে ‘শালাকো’।

শুধু সিনেমাপ্রেমীই নন, খুব দ্রুতই তিনি হয়ে ওঠেন চিন্তাবিদ ও শিল্পীদের প্রেরণা। বার্দোর আদলে তৎকালীন বান্ধবীদের চুল সোনালি করতে বলেছিলেন তরুণ জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনি। ১৯৫৮ সালে প্যারিস-ম্যাচ সাময়িকীতে কলামিস্ট রেমন্ড কার্টিয়ে লেখেন দীর্ঘ নিবন্ধ ‘লে কা বার্দো’। ১৯৫৯ সালে দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়া প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ব্রিজিত বার্দো অ্যান্ড দ্য লোলিটা সিনড্রোম’। যেখানে বার্দোকে ফ্রান্সের সবচেয়ে মুক্তমনা নারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

ব্রিজিত বার্দো। এএফপি

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সংগীতজগতেও সক্রিয় ছিলেন বার্দো। তিনি ফরাসি গীতিকার–সুরকার সের্জ গেইন্সবুর লেখায় গান রেকর্ড করেন। সেই সময় সের্জের সঙ্গে তাঁর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক চলছিল। তবে তৎকালীন স্বামী গুন্টার স্যাক্স বিষয়টি জেনে যাওয়ায় কেলেঙ্কারির আশঙ্কায় গানটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন বার্দো। পরে ব্রিটিশ অভিনেত্রী জেন বারকিনকে নিয়ে গানটি পুনরায় রেকর্ড করেন সের্জ, যা ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য পায়।

১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ‘দ্য এডিফাইং অ্যান্ড জয়াস স্টোরি অব কলিনো’ ছবির পর অভিনয় থেকে অবসর নেন তিনি। এরপর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ক্রমে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বার্দো। প্রাণী অধিকার নিয়ে তাঁর সোচ্চার অবস্থান একপর্যায়ে জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মন্তব্য এবং ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থী দল ফ্রন্ট ন্যাশনালের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থনে রূপ নেয়। এর ফলে বর্ণবিদ্বেষমূলক বক্তব্যের দায়ে একাধিকবার তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

তারকাখ্যাতির চাপ বার্দোর কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। ১৯৯৬ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাকে ঘিরে যে উন্মাদনা ছিল, তা সব সময়ই অবাস্তব মনে হতো। তারকাজীবনের জন্য আমি কখনোই পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম না।’

চারবার বিয়ে করেছিলেন বার্দো, সেই সময়ের একাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন সম্পর্কে। অভিনয়, গান, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আর বিতর্কিত রাজনৈতিক দর্শন মিলিয়ে বার্দো ছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের বহুল চর্চিত এক নাম।
দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে