গল্প

মেঘের মায়ায় কিছুক্ষণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আকাশে মেঘ দেখলেই মন খারাপ হয়। এ রোগটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। ঝড়-বৃষ্টির সময়ে তিনি আমাদের দুই ভাইবোনকে কোলের মধ্যে বসিয়ে দোয়া-দরুদ পড়তেন। কোথাও বজ্রপাতের শব্দ শুনলে আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে মায়ের আঁচলের তলে বসে থাকতাম। মা আমাদের মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। বৃষ্টি থামলে আকাশের মেঘ সরে যেত আর আমরা আকাশের রঙে হারিয়ে যেতাম। রংধনুর সাত রং গোনার প্রতিযোগিতা চলত নিজেদের মধ্যে।
এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার আগে ফেসবুকে মেঘের সংবাদ পেয়ে যাই। মেঘ-বৃষ্টি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের ঝড় ওঠে। প্রায়ই শৈশবের ভয়াল কালো মেঘ, ধূলিঝড়, অঝোর বৃষ্টি, মায়াবী রংধনু আর মায়ের নির্ভার আঁচল মিস করি। ছোটবেলার সে স্মৃতি নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিই। অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ইনবক্সে একটা মেসেজ পাই। পাঠিয়েছে মেঘ মায়া। এ ধরনের নামের আইডি ফেইক হওয়ার আশঙ্কা বেশি ভেবে এড়িয়ে যেতে চাইলেও সে আমাকে আটকে রাখে।
—আপনার স্ট্যাটাসে আরও অনেক কথা আসতে পারত। জানি না, সেসব ভুলে গেছেন কি না!
আমার স্ট্যাটাসে কী আসবে না-আসবে তার হিসাব অন্য কারও কাছ থেকে নিতে হবে কেন? তবু জানতে কি-বোর্ডে হাত লাগাই।
—যেমন?

—স্কুলের গা ঘেঁষে থাকা একটা সাদা রঙের বাড়ি। একবার ঝড়ে স্কুলের টিনের চাল উড়িয়ে নিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সবাই গিয়ে উঠল সে বাড়িতে। ওই বাড়ির একটা মেয়ে পড়ত আপনার সঙ্গে...

—হ্যাঁ, সাবিহাদের বাড়ি। আপনি জানলেন কীভাবে?

—সব শেষ ঠিক কবে তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে বলতে পারবেন?

—না, হবে অনেক দিন। এখন কে কোথায় আছে তাও ঠিকমতো জানি না।

—আমি কিন্তু দিন-তারিখ সব বলে দিতে পারব।

হঠাৎ ফেসবুকের সবুজ বাতি নিভে যায়। মেঘ মায়া হারিয়ে যায় আমার ভেতরে অস্বস্তি ছড়িয়ে দিয়ে। আমি একের পর এক মেসেজ দিতে থাকি। ‘আপনিই কি সাবিহা?’ থেকে ‘তুমি কি সাবিহা?’-তে চলে আসি, তবু সাড়া মেলে না। কোনো মেসেজ সিন হয় না। ছোটবেলায় যখন কিছুই বুঝতাম না, বন্ধুরা আমাদের দুজনকে নিয়ে নানা কথা রটাত। লজ্জায় সাবিহার মুখ লাল হয়ে যেত। আমার থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে বসত। ওর বাড়ি থেকেও বোধ হয় এসব নিয়ে বকাঝকা করত। কী দিনই না ছিল তখন!

দিন দশেক বাদে ওই আইডি থেকে একটা শিশুর ছবি আসে। নিচে লেখা, ‘আমার ছেলে। নাম রেখেছি “মেঘ”।’ ছবি দেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকি। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে ফিরে যাই। ছেলেদের চেহারায় মায়ের এমন ছাপ থাকতে পারে জানতাম না। ঠিক যেন সাবিহার ছোটবেলার ছবি! আমিও মেঘের মায়ায় পড়ে যাই। আশ্চর্য, মেঘ দেখে একসময় ভয়ে লুকাতাম, অথচ আজ এ মেঘের কী দুর্নিবার আকর্ষণ যে চোখ ফেরানোই যাচ্ছে না!