আমি বললাম, ‘আমাকে সাত দিন সময় দাও, তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব’

বিজ্ঞানী ও লেখক রেজাউর রহমান চলে গেলেন গত ২৬ অক্টোবর। বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্যবইসহ বেশ কিছু বইয়ের লেখক তিনি। পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। দীর্ঘ ৩৫ বছর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে গবেষণা করেছেন। এ ছাড়া শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তায় তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকেই নির্বাচিত অংশ থাকল আজ।

বিজ্ঞানী ও লেখক রেজাউর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭৫ সালে আমি চেক একাডেমি অব সায়েন্সেসের বৃত্তি পাই। তখন সেই দেশে সমাজতন্ত্র চলছিল। ফলে অনেকে এই বৃত্তি নেননি। তাঁদের ধারণা ছিল, চেক প্রজাতন্ত্রে লেখাপড়া হয় না। কিন্তু চেক একাডেমি অব সায়েন্সেস অত্যন্ত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে অনেক বড় বিজ্ঞানী বেরিয়েছেন। ওখানে গিয়ে রেডিয়েশন বায়োলজি বিভাগে যোগ দিলাম। গবেষণার বিষয় ছিল ‘রেডিয়েশন ইফেক্টস অন ইনসেক্টস’ (পোকার ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব)। অধ্যাপক ডক্টর ফ্রান্টিসেক সেহনাল বলে এক বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে একটা গবেষণা প্রোগ্রাম নিই। নাম ‘ইন্টারেকশনস অব হরমোন ইন ইনসেক্টস’।

প্রায় সাড়ে তিন বছর ওখানে কাজ করেছি। এ ছাড়া ফ্রান্সে, পোল্যান্ডে সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমাকে পাঠানো হতো। তখন নতুন বিজ্ঞানী হিসেবে সাহস একটু কম পেতাম। তারপরও ভালোই বলতেন শ্রোতারা। এভাবে চার বছর পর, ১৯৭৯ সালে আমাকে সিএসসি (পিএইচডি) ডিগ্রি দেওয়া হয়।

তারপর দেশে ফিরে এলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, গতানুগতিক গবেষণা না করে একাডেমিক কাজ করব। তখন গতানুগতিক গবেষণার খুব একটা সুযোগ-সুবিধা এখানে ছিল না। গামা রেডিয়েশন সোর্স ছিল অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টার, ঢাকায়। তারপর চলে গেলাম সাভারে। ওখানে একটা নতুন ইনস্টিটিউট হলো—ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলজি। শুরুতে এমনিতে একটা বিভাগ ছিল, পরে আমরা বড় করে ইনস্টিটিউটটা করলাম। সেখানে আমার লক্ষ্য ছিল, একাডেমিক পারসুয়েশন অব ফ্রুট ফ্লাই অর্থাৎ ফলের মাছি নিয়ে মৌলিক গবেষণা।

এই ফলের মাছি মারাত্মক ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে একবার কমলালেবুর ইন্ডাস্ট্রি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই ফ্রুট ফ্লাইয়ের কারণে ওদের এক বছরের পুরো ফসল নষ্ট হয়েছিল। তারা মাছি দমনের জন্য এয়ারফোর্স ব্যবহার করেও ভালো ফল পায়নি। এ জন্য ঢাকায় আসেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির প্রতিনিধি থাইল্যান্ডের পাইসন রোহালানো নামের একজন। তিনি আমাকে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়ে সাহায্য চাইলেন, ‘চেক একাডেমি অব সায়েন্সেসে তুমি যে কাজ করেছ, তেমনই কাজের জন্য আমাদের সাহায্য প্রয়োজন।’

তিনি জানালেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি, ভিয়েনায় একটা ল্যাব আছে। সেখানে থেকে দেখুন, আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন কি না।’

আমি সেখানে যেতে রাজি হলাম। সাইবারডর্ফ ল্যাব ভিয়েনা শহর থেকে ৩০ মাইল। সেখানে যেতাম প্রতিদিন। এই কাজ করতে গিয়ে আমার ঘুম উধাও হয়ে গেল। একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এলাম। কাজটা হচ্ছে না, সময় লাগছে। তাই প্রথমটায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

তখন জানতে পারি—হাওয়াই থেকে যেসব কমলা আসে, ওগুলোতে ফলের মাছির লার্ভা (শিশু মাছি) পাওয়া যায়। ওরা বলত, রেডিয়েশন দিয়ে প্রিজার্ভ (সংরক্ষণ) করে দিয়েছে, কিন্তু আসলে না করেই পাঠিয়ে দিত। খরচ কমানোর জন্য ওরা এটা করত। ওগুলো অরল্যান্ডো এসে সেখানকার ফল, ফল ব্যবসায়ীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। আমি এটা ধরে ফেলি।

বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্যবইসহ বেশ কিছু বইয়ের লেখক তিনি

আমি ওখানে বক্তব্য দেওয়ার পর ব্রাজিলিয়ান এক বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, এটা হয় না। নিউরোলজিক্যালি এটা সম্ভব নয়।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘আমাকে সাত দিন সময় দাও, তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব।’ ওরা আমাকে সাত দিন রাখল। আমি ওদের পাঁচ মিনিটে এই কাজ করার ও শনাক্ত করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিলাম।

আসলে ৩ মিলির‍্যাড রেডিয়েশন দিলে লার্ভা যে স্টেজেই থাকুক, এর ব্রেনের আকার ছোট হয়ে যায়। আমি ওদের করে দেখালাম। তখন ওরা খুব আনন্দিত। আমাকে বলল, ‘তুমি আরও কিছুকাল থেকে যাও।’ কিন্তু আমি তো সংসারী মানুষ। তাই থাকতে রাজি হইনি। চলে আসি। ওদিকে আমার এই কাজ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জার্নাল অব ইকোনমিক এন্টোমোলজিতে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ফ্রুট ফ্লাই পেস্টস নামের বড় আকারের পাঠ্যপুস্তকের শুরুতে আমার পেপারের উল্লেখ রয়েছে।

প্রথমবার যখন গেলাম, ওরা আমাকে ইন্ডাস্ট্রি পুরোটা দেখিয়েছে। কীভাবে কী করে বিস্তারিত আরকি। ওরা আমাকে আর্থিক উপহারও দিয়েছিল। সে সময় এটা ছিল অনেক টাকা।

ভাবলাম, দেশে এসে এই লাইনে ছাত্র নেব। ফ্রুট ফ্লাইয়ের ওপর তিনটি পিএইচডি করিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা। ওরাও জানত না যে দেশে ফ্রুট ফ্লাই আছে। তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এটার কাজ সম্ভবত এখনো আমাদের ল্যাবে হয়।

  • সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আবুল বাসারউচ্ছ্বাস তৌসিফ