আধুনিক জীবনে নিজেকে আভিজাত্যপূর্ণ করে তোলার জন্য দামি জিনিস বা চকমকে পোশাক কেনার প্রয়োজন নেই। এর জন্য দরকার সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, সময় ও সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা। ছোট ছোট অভ্যাস, যেমন সাদাসিধে পোশাক নির্বাচন, টাকা ও সময়ের হিসাব রাখা এবং আন্তরিক আচরণ—এই সবকিছুই আপনাকে সাবলীলভাবে আভিজাত্যপূর্ণ করে তোলে। এই লেখায় এমন কিছু সহজ অভ্যাসের কথা বলা হলো, যা মেনে চললে মানুষ আপনাকে দেখবে পরিপাটি, পাশাপাশি আপনার জীবন হবে স্বস্তির।
খেয়াল করলে দেখবেন, কিছু মানুষকে সাদামাটা টি-শার্ট আর জিনস পরেও পরিপাটি ও আকর্ষণীয় দেখায়। তাঁরা বেশি পোশাক কেনেন না, বরং কম কিন্তু ভালো মানের পোশাক বেছে নেন। তাঁরা সঠিক মাপে পোশাক তৈরি করেন এবং যত্নসহকারে ব্যবহার করেন। এই অভ্যাসে ব্র্যান্ড নয়, বরং পরিচ্ছন্নতা ও ধারাবাহিকতা বেশি গুরুত্ব পায়।
তিনটি বিষয় মাথায় রাখবেন। প্রথমত, পোশাক পরিষ্কার রাখুন। সাদা কাপড় সাদা রাখুন যেন হলদেটে না হয় আর গাঢ় রঙের পোশাক গাঢ় রাখুন। কাপড় পরিষ্কার করুন যত্নের সঙ্গে, এতে পোশাক দীর্ঘদিন নতুনের মতো দেখাবে।
দ্বিতীয়ত, পোশাকের ব্র্যান্ড বা লোগো নয়, গঠনই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক মাপের পোশাক ও ঝকঝকে জুতা পরুন, পরিচ্ছন্ন ব্যাগ ব্যবহার করুন। এসব সহজেই দামি দেখায়।
তৃতীয়ত, পোশাকে রঙের একটি সীমিত প্যালেট বেছে নিন। সচেতন স্টাইল মেনে চলুন। সচেতন স্টাইল ব্যক্তিকে আভিজাত্যপূর্ণ করে তোলে।
যাঁদের দেখে মনে হয়, টাকার দিক দিয়ে সব সময় নিশ্চিন্ত; তাঁরা আদতে পরিকল্পনা অনুযায়ী চলেন। তাঁরা হুট করে বিলের চাপে ভোগেন না, বাজারে খরচের হিসাব গুলিয়ে ফেলেন না বা ব্যাংকের ব্যালান্স দেখে অবাক হন না। এই শান্ত ভাব জন্মগত নয়, বরং গড়ে তোলা অভ্যাস।
প্রতি মাসের শুরুতেই বিল, ভাড়া, স্কুলের বেতন আর সঞ্চয়ের টাকা আলাদা করে রাখুন। সম্ভব হলে মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে রাখার ব্যবস্থা করুন।
দৈনন্দিন খরচের জন্য আলাদা একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারেন। এতে খরচের হিসাব গুলিয়ে যাবে না।
বড় খরচ বা যেকোনো ঋণ বা বিল সময়মতো পরিশোধ করে ফেলুন। এতে চাপ কমে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কমপক্ষে এক মাসের খরচের সমপরিমাণ টাকা হাতে রাখুন। এর ফলে আপনি হঠাৎ অর্থসংকটে পড়বেন না। ওষুধ কেনা, গ্যারেজে গাড়ি সারানো বা রেস্তোরাঁয় বিল দেওয়ার সময় আপনি থাকবেন নিশ্চিন্ত ও আত্মবিশ্বাসী। নিশ্চিন্ত ও আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিকে মানুষ আভিজাত্যপূর্ণ হিসেবেই ধরে নেয়।
ছোটবেলায় আপনিও নিশ্চয়ই বড়দের দেখেছেন যে তাঁরা যতই সাধারণ জীবনযাপন করুন না কেন, জিনিসের যত্ন নিতেন। কম দামি জিনিসও ব্যবহার করে সাবধানে মুছে জায়গামতো রেখে দিতেন। হুটহাট নতুন কিছু কিনতেন না; আগে সেটি মেরামত করার চেষ্টা করতেন। বাড়ির নারীদেরও নিশ্চয়ই দেখেছেন, কোনো কাপড় ছিঁড়ে গেলে নতুন কাপড় কেনার বদলে সেলাই করে পরতেন। সবকিছুই ছিল সাধারণ, কিন্তু যত্নের ছাপ ছিল স্পষ্ট। এসব প্রমাণ করে যে বিলাসবহুল জীবন মানে দামি জিনিস নয়; বরং যত্ন নেওয়ার অভ্যাসই আসল বিলাসের চিহ্ন।
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, যত্ন মানে দায়িত্ব, দক্ষতা আর স্থায়িত্ব। আমরা যে জিনিস যত্নে রাখি, তা দামি হোক বা না হোক, দেখতে মূল্যবান লাগে।
নতুন কিছু কেনার আগে ভাবুন, সেটা টেকসই কি না।
জিনিসপত্রের যত্ন নিতে শিখুন।
কিছু ভাঙলে আগে মেরামত করার চেষ্টা করুন, সঙ্গে সঙ্গে নতুন কিনবেন না। আর যেসব জিনিস দরকার নেই, কাউকে দান করুন কিংবা ফেলে দিন।
ঘর পরিপাটি রাখুন। গাছ লাগান, টেবিল পরিষ্কার রাখুন, আর মনমাতানো সুগন্ধি ব্যবহার করুন, এতে আপনার রুচি ফুটে উঠবে।
আসল স্টাইল টাকায় নয়, যত্ন আর অভ্যাসে গড়ে ওঠে।
অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখনদারি করে ফেলেন। অথচ টাকার বিষয়ে পরিপক্ব আচরণই বুদ্ধিমানের কাজ। বড় কিছু কেনার আগে একটু ভেবে নিন। ভদ্রভাবে দর-কষাকষি করুন।
পরিপক্ব আচরণে টাকার বিষয়ে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেন না—‘মোট খরচ কত?’, ‘ছাড় আছে?’ বা ‘অফার কত দিন থাকবে?’—এসবে কেউ ছোট হন না বরং এটি স্পষ্টতার প্রতীক। মানুষ এই স্বচ্ছতা থেকেই আপনার দক্ষতা ও স্থিরতা টের পায়। মনে রাখবেন, দাম যেমন আপনি দেন, মূল্যটাও আপনি পান। যখন মূল্যের দিকে মনোযোগ দেন, তখন আত্মবিশ্বাসই আপনার প্রকৃত আভিজাত্য হিসেবে ফুটে ওঠে।
অনেকে মনে করেন, উপহার দিতে বা দান করতে হলে অনেক টাকা দরকার। কিন্তু ছোট ছোট উপহার বা দানও উষ্ণতার অনুভূতি তৈরি করে। যেমন—
বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে চা বা কফি খাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে বিলটা আপনি আগে দিন।
পারিবারিক জমায়েতে মৌসুম অনুযায়ী কোনো খাবার বা উপহার নিন।
অতিথিদের জন্য ছোট উপহার রাখতে পারেন। যেমন ভালো মানের অলিভ অয়েল, চকলেট বা একটা ছোট সুন্দর গাছ।
এসব বেশ কম খরচেই করা যায়, কিন্তু উদারতা ও বন্ধুত্বের বার্তাটা দেয় বেশ গভীরভাবে।
অনেকেই আন্তরিক আতিথেয়তাকে অতটা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এটিই সহজ ও কম খরচে আভিজাত্য প্রকাশের উপায়।
আপনি শসা, টমেটো, গাজর, বিটরুট দিয়ে তৈরি তাজা সালাদ করতে পারেন।
একটি প্রধান ডিশ করতে পারেন। যেমন সবজি খিচুড়ি।
আপনার গ্রামের একটি আঞ্চলিক খাবার রাখতে পারেন।
পরিপাটি টেবিলে ভিন্ন স্বাদের জুস রাখতে পারেন।
এই ছোট ছোট জিনিসই সুন্দর ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে। মানুষ দাম নয়, পরিপাটি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ মনে রাখে। সুন্দর আতিথেয়তা, আপনার বানানো সাধারণ খাবার, চমৎকার পরিবেশই বিলাসিতার অনুভূতি দেয়।
এই লেখার উদ্দেশ্য আভিজাত্য প্রদর্শন নয়, পরিপাটি ও যত্নশীলতা দেখানো। নিজের যেকোনো ‘জিনিস’, ‘সময়’ ও ‘সম্পর্কের’ যত্ন নিলে আপনাকে আভিজাত্যপূর্ণ বলতেই হবে।
সূত্র: ভেজ আউট