
আমি তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমার আব্বু ছিলেন বন কর্মকর্তা। সে সময় সুন্দরবনের বগী বা শরণখোলা ফরেস্ট অফিসে ছিল তাঁর পোস্টিং। কোনো এক ছুটিতে সেখানে বেড়াতে গেছি। সারা দিন গল্পের বই পড়ি আর খেলাধুলা করি।
একদিন আব্বুর অফিসরুমে ডাক পড়ল। গিয়ে দেখি কেউ একজন বসে আছেন।
আমার হাতে একটা বই তুলে দিয়ে আব্বু বললেন, ‘তোমার এই আঙ্কেল একজন মুক্তিযোদ্ধা। সুন্দরবনে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা নিয়ে এই বই লিখেছেন। নাও, বইটা তুমি পোড়ো।’
তখনো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমার জানাবোঝা খুব একটা বেশি ছিল না। ছোটদের জন্য লেখা মুক্তিযুদ্ধের বই-ই শুধু পড়েছি। সেদিন হাতে এল ‘মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উন্মাতাল দিনগুলি’। স্মৃতিকথামূলক বইটি আমার ওই বয়সের জন্য বেশ কঠিন ছিল। তারপরও কিসের আকর্ষণে জানি না একটানে বইটা পড়ে ফেললাম। সবকিছু বুঝিনি, তবু পড়েছি।
জানি না, কী বুঝে অতটুকু মেয়েকে বইটা পড়তে দিয়েছিলেন আব্বু। তবে এটুকু বুঝি, ওটা আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিপুল আগ্রহের সূতিকাগার ছিল।
নিজে যখন মা হলাম, আমার লক্ষ্যই ছিল ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানানো। সে যেন দেশকে, মানুষকে ভালোবাসে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে বড় হয়। খুব ছোটবেলায়, ও যখন পড়তেও জানে না, ওকে আমরা বই কিনে দিয়েছি। গল্পে গল্পে যুদ্ধের কথা বলেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেছি।
উজানের (আমার ছেলে) পাঁচ বছরের জন্মদিনে আমার সহকর্মী জেসমিন মলি আপা ওকে এক সেট মুক্তিযুদ্ধের কমিক উপহার দিলেন। সত্যি বলতে কী, এরপর আমাদের আর বাড়তি কোনো চেষ্টা করতে হয়নি। ওই কমিক পড়ে ছেলে নিজেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আগ্রহী হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছে।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি কীভাবে ৯ বছরের এইটুকু ছেলেকে বই পড়ায় আগ্রহী করলাম। কীভাবে ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এত কিছু জানে? এর উত্তর আসলে এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ছোট করে যদি বলি, শিশু তখনই বই পড়তে আগ্রহ পাবে, যদি মা–বাবা কিংবা বাসার বড়দের হাতে বই দেখে।
আর অবশ্যই ডিভাইসে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না। আমরা উজানের হাতে ডিভাইস দিইনি। ওকে বারবার বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছি, কোনো তথ্য জানতে হলে পত্রিকা বা বইয়ের বিকল্প নেই। ওকে বলেছি, তোমার যদি কিছু জানতে ইচ্ছা হয়, বই পড়ো, সেখানে সব লেখা আছে।
ওকে মুক্তিযুদ্ধের গান শুনিয়েছি, শুয়ে শুয়ে ছোট ছোট গল্প বলেছি। ওর নানা ওকে ভাষা আন্দোলনের গল্প বলেছেন, শুনিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। ছুটির দিনে ওকে নিয়ে আমরা বধ্যভূমিতে যাই, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরিয়ে দেখাই। আমাদের যে মুক্তিযোদ্ধা আত্মীয়রা আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছি। সেই দাদা বা নানার কাছে বসে মন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে উজান।
বিজয় দিবস এলে ওকে মুক্তিযুদ্ধের বই উপহার দিয়েছি, পতাকার নকশায় টি–শার্ট কিনে দিয়েছি। ওর ঘরের দরজায় লাগিয়ে দিয়েছি ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর পোস্টার। ওকে বলেছি, এই দেশ কত কষ্টে পাওয়া। কীভাবে ওর মতো শিশুরা কষ্ট করেছে, ওকে শরণার্থীশিবিরের ছবি দেখিয়েছি, বধ্যভূমির ছবি দেখিয়েছি। অনেকটা নিজের আগ্রহেই পত্রিকা পড়ে জেনেছে, বই পড়তে শুরু করেছে। যখন যেটা বুঝতে পারেনি, প্রশ্ন করেছে। আমরা উত্তর দিয়েছি, যতটুকু সম্ভব সহজ করে।
যেমন একবার সে জানতে চাইল, যুদ্ধশিশু কী? প্রথমে ওর বাবা বলেছিলেন, যে শিশুরা যুদ্ধের সময় জন্মেছে, তারাই যুদ্ধশিশু। তখন ও পাল্টা প্রশ্ন করেছে, তাহলে বড় ফুফুও তো যুদ্ধশিশু! কারণ, ওর বড় ফুফু যুদ্ধের বছর ডিসেম্বরে জন্ম নিয়েছিলেন। এরপর ভেবেচিন্তে তার প্রশ্নের উত্তর দিতাম আমরা। শিশুরা তো কৌতূহলী।
তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করবেই। তাই তাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো তাদের বয়স উপযোগীভাবে উত্তর করাই নিরাপদ। তবে উত্তরগুলো যেন বিভ্রান্তিমূলক না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে স্কুলের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় ওকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়েছিলাম।
সবার মধ্যে যখন ও খালি পায়, লুঙ্গি পরে, গলায় গামছা ঝুলিয়ে কাঁধে নকল স্টেনগান নিয়ে গ্রীবা উঁচু করে হাঁটছিল, মা হিসেবে আমার প্রাণটাও ভরে উঠছিল।
এভাবে খুব ছোট ছোট পদক্ষেপে বিশাল মুক্তিযুদ্ধকে আমরা উজানের হৃদয়ে স্থাপনের চেষ্টা করে চলেছি। উজানের বয়স এখন মাত্র ৯ বছর। বাকি জীবনটাও যেন এভাবেই সে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসে
যেতে পারে, এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে, মা–বাবা হিসেবে এটুকুই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক