
গবেষণা বলে, বিশ্বে মোট কার্বন নিঃসরণের ৮ শতাংশের জন্যই দায়ী ‘সিমেন্ট উৎপাদন’। অথচ কংক্রিট তৈরির একটু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সিমেন্ট। বিভিন্ন ভবনের ছাদ তৈরিতে এ কংক্রিট ব্যবহার করা হয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীর একটি দল তাই পরিবেশবান্ধব ছাদ তৈরির কথা ভাবছিল। ‘ইকো-জেনেসিস’ নামের দলটির দাবি, এরই মধ্যে তারা একটা উপায় খুঁজেও পেয়েছে। তাদের উদ্ভাবন সম্প্রতি জিতেছে পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
দলের সদস্যদের মধ্যে আছেন পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের ফারহানা ইসলাম, নাদিরুজ্জামান নায়েফ, আবু ইয়াহিয়া, রায়হান উদ্দিন, পরিসংখ্যান বিভাগের তাসমিয়া তাহিরা এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রিয়া রানী। পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ শহীদুর রহমান এই দলের তত্ত্বাবধায়ক।
চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁরা এই প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। দুটি আইডিয়াকে কেন্দ্র করে এগিয়েছেন। একটি হলো কংক্রিটের মিশ্রণে (সিমেন্ট, বালু, পাথর) বর্জ্য মিশিয়ে টেকসই ছাদ নির্মাণ। অন্যটি কংক্রিট ছাড়া শুধু বর্জ্য থেকেই ছাদ নির্মাণ। দুটি ধারণাই পরিবেশবান্ধব। এরই মধ্যে গবেষণায় প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
দলের অন্যতম সদস্য ফারহানা ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই দেখি যে ছাত্রীদের আবাসিক হলে ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ডায়পার ও সার্জিক্যাল মাস্ক প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। পরে বর্জ্যগুলো যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় না।
ভাবে চলতে থাকলে একসময় বর্জ্য ফেলার জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। আমরা কেন সমাধান নিয়ে ভাবছি না? ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, এই বর্জ্যগুলো প্রক্রিয়াকরণের পর শুধু বর্জ্য থেকেই ছাদ নির্মাণ করা সম্ভব। অথবা এ বর্জ্য কংক্রিট তৈরির অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়। এতে ভবন নির্মাণে খরচ অনেকাংশে বেঁচে যাবে। গবেষণাগারে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এটি পরিবেশের জন্যও উপযোগী।’
আবু ইয়াহিয়া বলেন, প্রচলিত কংক্রিট তৈরিতে সিমেন্ট ব্যবহারের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের হার অনেক বেশি, যেটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের পলিপ্রপিলিনজাত প্লাস্টিকগুলো প্রক্রিয়াকরণ করে ব্যবহার করলে সিমেন্ট কম লাগে। অপর দিকে বর্জ্য থেকে ছাদ নির্মাণে প্রচলিত কংক্রিটের প্রয়োজন নেই।
পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝিয়ে বললেন নাদিরুজ্জামান নায়েফ, ‘শুরুতে আমরা বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করি। এরপর এসব বর্জ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত করা হয়। বর্জ্যগুলো থেকে পলিপ্রপিলিনজাত প্লাস্টিক আলাদা করা হয়। এই প্লাস্টিক কাজে লাগিয়েই টেকসই ছাদ নির্মাণ করা সম্ভব।’
প্রিয়া রানী বলেন, শুধু বর্জ্য থেকে তৈরি ছাদের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ টিনের চালা চেয়ে অনেক বেশি। এটি পানিরোধী, তাপমাত্রা সহনীয়। মরিচা ধরে না। তাই সহজে ক্ষয়ও হয় না। এটার স্থায়িত্বও বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কিংবা অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণে দ্রুত ও সহজে ব্যবহারযোগ্য।
উদ্ভাবনটি কীভাবে বাজারজাত করা যায়, তা নিয়েও ভাবছেন দলের সদস্যরা। তাসমিয়া তাহিরা বলেন, ‘বর্জ্য থেকে যে ছাদ বানানো হবে, তা প্রাথমিকভাবে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩ ফুট প্রস্থ আকারে বাজারজাতের পরিকল্পনা করছি। কম খরচে সাধারণ মানুষ এটি কিনতে পারবেন।’
উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ এ মাসের ৮ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবনকেন্দ্র থেকে পুরস্কার পায় ইকো-জেনেসিস। এ ছাড়া গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘জাতীয় কংক্রিট উৎসব ২০২৫’-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা।
আগামী অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় ‘আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউট সম্মেলনে’ উদ্ভাবনটি উপস্থাপনের ডাক পেয়েছে ইকো-জেনেসিস। সবকিছু ঠিক থাকলে সেখানে দলের সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ শহীদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন একটি নতুন পথ তৈরি করেছে। আশা করছি, এটি জনকল্যাণে ও পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’