প্রায় নয় বছর আগে সাবিনা ইয়াসমিনকে হারান তহুরা খাতুন। কিন্তু আজও শৈশবের এই বন্ধুকে একমুহূর্ত ভুলতে পারেন না বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই ফরোয়ার্ড। বন্ধু দিবস সামনে রেখে মাসুদ আলমকে অকালপ্রয়াত বন্ধুর কথা শোনালেন তহুরা।

মাঠে গোল করলেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। কেউ যেন ডেকে বলে, ‘তহুরা, দেখছিস, তুই পারিস!’
আমি চোখ মুছি। কেউ ভাবে ঘাম, কেউ ভাবে আনন্দাশ্রু। কিন্তু আমি জানি চোখে ওই এক ফোঁটা পানি আসলে এক নিঃশব্দ কান্না। কারণ, প্রতিটি গোলের পর আমি খুঁজি একটি মুখ—সাবিনা ইয়াসমিন।
সাবিনা আমার শৈশবের বন্ধু। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের ছোট্ট গ্রামের সেই মাঠ, পুকুরপাড়, জাম আর বরই গাছের ডাল—এসব ছিল আমাদের খেলাঘর। আমি, সাবিনা, শামসুন্নাহার কখনো কখনো একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। একসঙ্গে ফিরতাম। সাবিনার বাড়ি আর আমার বাড়ির মাঝে ১০-১২ মিনিটের হাঁটাদূরত্ব। প্রায়ই ওর বাড়ি হয়ে ওকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। ফেরাও হতো একসঙ্গে। কলসিন্দুর স্কুলে সাবিনা ছিল আমার এক ক্লাস ওপরে। তাই কখনো তাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতাম, কখনো ‘তুমি’। সম্পর্কটাও ছিল ঠিক তেমনি, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় গড়া।
২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ওর জ্বর এসেছিল। তখন আমরা থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে ফিরেছি। সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে ছিল সাবিনা। ১৮ সেপ্টেম্বর ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যায়। আমিও থাইল্যান্ডে খেলে বাড়ি গেছি। ২৭ তারিখে ঢাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবনে ওর ক্যাম্পে ফেরার কথা ছিল। আমাদেরও ক্যাম্পে ফেরার কথা। এর দুই দিন আগে এক সন্ধ্যায় জ্বর নিয়ে ও আমার বাড়ি এল। আমি ওকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে বাড়ি আনলাম, অনেকটা জোর করে। সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতেই ঘুমাল সাবিনা। সকালে বলল শরীরটা ভালো লাগছে না।
সেদিন আবার আমার নানাও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে দেখতে নানাবাড়ি যাব। সাবিনাকে বললাম, তুমিও আমার সঙ্গে চলো। সাবিনা না করল। অনেক অনুরোধ করলাম। ও রাজি হলো না। আমার অভিমান হলো। সে খেতে পারছিল না, নিজ হাতে খাইয়ে দিলাম। সেদিনই প্রথম ওকে আমি খাইয়ে দিই। জীবনের প্রথম ও শেষবার।
তাকে সাইকেলে বাড়ি দিয়ে আমি নানার বাড়ি চলে গেলাম। পরদিন আমাকে ও অনেকবার ফোন করেছিল। আমি ধরিনি, অভিমানে। কেন ও আমার সঙ্গে নানার বাড়ি গেল না! শেষমেশ ফোন ধরতেই বলল, ‘তহুরা, শরীরটা খুব খারাপ লাগতেছে রে।’
আমি বললাম, ‘ডাক্তারের কাছে যাও।’
ওর মা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
ফেরার পথে দূর থেকেই ওকে ‘টা, টা’ দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কী খাবে?
ওর মা বললেন, আমড়া খেতে চায়।
কিন্তু আমড়া পেলাম না। দোকানে দুটি আমড়া ছিল, সেগুলো অন্য কেউ কিনে নিয়েছে। দোকান থেকে অন্য কিছু খাবার কিনে নিয়ে গেলাম। এরপর ওর মার সঙ্গে ওকে ডাক্তারের কাছে নিলাম।
পরদিন ক্যাম্পে আসার কথা। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ২৬ সেপ্টেম্বর ধোবাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে বিকেলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় সাবিনা।
মনে হলো, আমি ফুটবল ছেড়ে দিই। কিসের খেলা, আমার প্রিয় সাথীই যখন পাশে নেই! কিন্তু সেই মুখ, সেই দুটি চোখ, বারবার ভেসে উঠল। মনে হলো সাবিনা বেঁচে থাকলে খেলত। তাহলে বন্ধুর জন্য হলেও আমাকেও খেলতে হবে।
সেই থেকে আমি তার জন্যই খেলি। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে ৫০টার বেশি গোল করেছি। জাতীয় দলেও গোটা পনেরো গোল করেছি। প্রতিটি গোলের পর মনে হয় সাবিনা থাকলে বলত, ‘তহুরা, গোলটা দারুণ হইছে!’
আমি হয়তো তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলতাম, ‘আরেকটা দেব?’
আজও তার কথা বললে আমার চোখ ভিজে আসে। সাবিনা যেন এখনো আমার ভেতর থেকে বলে ‘তহুরা, সামনে চল!’
এখনো আমাকে ওর মা ফোন দেন। নিয়মিত কথা বলেন। ভুটানে খেলতে আসার পরও সাবিনার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এই পরিবারের পাশে আমি সব সময় থাকি। এখনো সাবিনাকে নিয়ে গল্প করেন আমার মা। আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে সাবিনার মুখ দেখি। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ওর অকালে চলে যাওয়ার পর এক মাস কোথাও যাইনি। ঘরের ভেতর কাঁদতাম, চুপচাপ। যেন একটা শূন্যতা আমাকে ঢেকে রেখেছিল।
সাবিনা নেই, তবু সে আছে। ভালো থেকো সাবিনা, এই প্রার্থনাই করি।