নিজের কথা স্পষ্টভাবে বলতে বা যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তিতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়তে এ প্রজন্ম ভয় পায় না
নিজের কথা স্পষ্টভাবে বলতে বা যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তিতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়তে এ প্রজন্ম ভয় পায় না

নতুন প্রজন্ম ভাবছে ‘আমিই ঠিক’, অভিভাবক বলছেন বেয়াদবি

আজকাল অনেকেই আড্ডা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, ‘যতই দুষ্টামি করি, আমরা তো কখনো শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত বেয়াদবি করার সাহস পাইনি। গায়ে হাত তোলা তো বহু দূরের কথা। দ্বিমত থাকলেও বড়দের সঙ্গে সব সময় তর্ক জুড়ে দিইনি।’ অথচ বর্তমানে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এসব প্রবণতা লক্ষণীয়। নিজের কথা স্পষ্টভাবে বলতে, ক্ষেত্রবিশেষে ঔদ্ধত আচরণ করতে বা যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তিতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা ভয় পায় না। এ ধরনের আচরণকে অশ্রদ্ধা বা বেয়াদবি হিসেবেই বিবেচনা করেন অভিভাবকেরা। অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম ভাবছে, মৌলিকভাবে তাদের অবস্থান সঠিক। তারা তো ভুল কিছু বলছে না বা করছে না। কিন্তু আদতে কি তারা ঠিক? অভদ্রতা নাকি সাহস, কোনটির পাল্লাই–বা ভারী? নাকি প্রচলিত ধারা বদলে তারা সমাজে নতুন পরিবর্তন আনতে চায়?

নতুন প্রজন্ম নতুন ধরন

হালের প্রজন্মের নাম ‘জেন-আলফা’। অর্থাৎ এ প্রজন্মের শিশুদের জন্ম ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে। এর আগের প্রজন্ম, অর্থাৎ জেন-জিদের (১৯৯৭-২০১২) মধ্যে যারা সবচেয়ে কম বয়সী, তারাও এই লেখায় উল্লিখিত কিশোরদের মধ্যে পড়ে। আর উভয়ের মা-বাবাই সাধারণত মিলেনিয়াল প্রজন্মের।

এই শিশু ও কিশোরেরা ডিজিটাল যুগে বড় হয়েছে, হচ্ছে। অল্প বয়সেই হাতে পেয়েছে টাচ স্ক্রিন, বুঝতে শেখার আগেই ভক্ত হয়েছে ইউটিউবের। এমনকি করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসেও উপস্থিত থেকেছে ভার্চ্যুয়ালি। অর্থাৎ বোঝাই যায়, প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুবই গভীর। সহজ কথায়, প্রযুক্তি ছাড়া এরা প্রায় অচল।

তবে যদি বৈচিত্র্য কিংবা অন্তর্ভুক্তির মতো বৈশিষ্ট্য খুঁজতে চান, এই প্রজন্মের মধ্যে তা সহজাত। পেছনের কারণ হিসেবে ডিজিটাল যুগের অবদানের সঙ্গে ধরা হয় করোনা মহামারিকেও। এ দুই বৈশ্বিক ঘটনা তাদের শৈশব–কৈশোরকে প্রভাবিত করেছে দারুণভাবে।

বুঝতে ভুল, নাকি ভুলভাবে উপস্থাপন

অনেকের ধারণা, জেন-আলফা ও জেন-জির একাংশ আগের যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে অভদ্র। বড়দের শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে তারা নাকি অনেকটাই পিছিয়ে। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. ক্যাথরিন নোবিল ঠিক তেমনটা মনে করেন না। তাঁর বক্তব্য হলো, প্রজন্মের অন্তর্নিহিত বা তাদের ব্যাপারে উপসংহার টানার মতো বৈশিষ্ট্য এটা নয়। বরং সমাজের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের প্রভাবের ফলেই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

ক্যাথরিনের মতে, জেন-আলফা শিশু–কিশোরদের বড় হওয়ার সময়টা খেয়াল করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। এখন বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটছে। শুধু তা–ই নয়, প্রযুক্তির আধুনিক প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে ছোটবেলা থেকেই তারা নিজের মতামত তুলে ধরে। একই বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে পারে সহজেই। সব শুনে মনে হতে পারে, কাউকে প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া এবং নিজের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে এই প্রজন্ম বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু এই নতুন ভঙ্গি তাদের মা-বাবা বা বড়দের খুব একটা পছন্দ নয়।

জেন–এক্স (১৯৬৫-১৯৮০) ও বেবি বুমার্স (১৯৪৬-১৯৬৪) প্রজন্মের মধ্যে মা–বাবা, দাদা–দাদিরা পড়েন। তাঁরা নতুনদের এই সাহসী, স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টভাষী চরিত্রকে একটু অন্যভাবে দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মাথা নিচু করে কথা বলা, বিনা প্রশ্নে শ্রদ্ধা করার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের এই আচরণ বেশ সাংঘর্ষিক।

শুরুতেই কঠোর সমালোচনা না করে সহানুভূতির সঙ্গে তাদের কথা শুনতে হবে। বিকল্প উপায় দেখিয়ে বোঝাতে হবে। বলা যেতে পারে, ‘যা করছ ঠিক আছে, কিন্তু এভাবেও তো করা যায়।’ তখন তারা এ বিষয়ে ভাবতে চাইবে।
শারমিন হক, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেন-আলফাদের এসব বৈশিষ্ট্য আদতে আশপাশের পরিবেশের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। অর্থাৎ তাদের একতরফা দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই।

এ ছাড়া আজকের পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশকে উৎসাহিত করা হয়। সবাই উদ্‌যাপন করে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে। প্রচলিত রীতিনীতিকে প্রশ্ন করাও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঠিক এ জায়গাতেই আগের প্রজন্মগুলো থেকে জেন–আলফা আলাদা। কাউকে বিনা বাক্যে মানার চেয়ে তার মুখোমুখি হয়ে যুক্তি শুনতেই বেশি পছন্দ করে।

যেকোনো প্রশ্নে ‘জি স্যার’, ‘জি ম্যাডাম’, ‘ঠিক আছে’ বা ‘যাহোক’ বলার রীতি এখন আর নেই। বরং এই প্রজন্ম জানতে চায়, ‘কেন আমাকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না?’ ইচ্ছা না হলে বলে, ‘না, আমি ওটা করব না। আমি এভাবে করব।’

তাই জেন-আলফার অবাধ্যতাকে ঠিক অসম্মান নয়, বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে জেনেবুঝে তারপর কাজে জড়ানোর আকাঙ্ক্ষা বলা যেতে পারে। যখন এই বয়সীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ‘না’ বলে, অনেকে এটাকে ‘বিদ্রোহ’ ধরে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। অথচ বাস্তবে এটা তাদের সূক্ষ্ম চিন্তা এবং আরও ভালোভাবে বোঝার প্রমাণ। এটি বরং প্রচলিত প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছাকেই তুলে ধরে।

প্রযুক্তির সন্তান

এই প্রজন্মের সবাইকে প্রযুক্তির সন্তান বলা হয়। মুঠোফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দুই যুগ আগে হয়তো কেউই এমনটা কল্পনা করেননি। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং শেখা, যোগাযোগ করা এবং নিজেকে প্রকাশ করার টুল হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমেও বাড়ছে এর ব্যবহার। এই প্রযুক্তিনির্ভরতা তাদের আচরণ ও বিশ্বকে দেখার চোখকে প্রভাবিত করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যামিলি থেরাপিস্ট কেলি ওরিয়ার্ড বলেন, ‘ছোট বয়স থেকেই বেশি তথ্য জানা এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। ফলে তাদের ভেতরে তৈরি হয়েছে স্বাধীনচেতা মনোভাব ও বলিষ্ঠ কণ্ঠের মতো বৈশিষ্ট্য।’

কেলি আরও যোগ করেন, ‘মনে হতে পারে, এই ব্যবহার দ্বারা আদতে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটা আত্মবিশ্বাস ও সূক্ষ্ম চিন্তার মতো দক্ষতা থাকার লক্ষণ। এসব গুণ আমাদের লালন করা উচিত।’

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রযুক্তির সঙ্গে অল্প বয়সেই পরিচয় জেন–আলফা ও জেন–জিকে কিছু সুবিধা দিয়েছে। তাই বিভিন্ন সামাজিক ধারণা ও বৈশ্বিক বিষয়ে সবাই এখন যথেষ্ট সচেতন। মতপ্রকাশেও তারা দ্বিধা করে না। ফলে সব বিষয়ে নাক গলানোকেই অসম্মান ভেবে ভুল করা হয়।

মুঠোফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য

ভাষা দিয়েই তরুণদের বোঝা যায়

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা বিবর্তিত হয়। যুক্ত হয় নতুন শব্দ, বদলে যায় উচ্চারণ কিংবা প্রয়োগ। বর্তমান তরুণ সমাজ, অর্থাৎ জেন-জি ও জেন-আলফার শব্দভান্ডারেও এসেছে পরিবর্তন। কথোপকথন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করছে, যার অর্থ পুরোনো প্রজন্মের পক্ষে বোঝা মুশকিল। তবে নতুন শব্দ তৈরি ও সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শুধু তাদের সৃজনশীলতাকেই প্রকাশ করে না, তথ্যের স্রোতে নিজেদের শক্ত অবস্থানেরও জানান দেয়।

কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক—

বেট: ‘হ্যাঁ’ বা ‘আমিও একমত’।

স্লে: সাধারণত প্রশংসা করতে ব্যবহৃত হয়।

নো ক্যাপ: এটি দিয়ে ‘সত্য বলছি, একদম মিথ্যা নয়’ বোঝায়।

রিজ: কোনো আকর্ষণীয় বা অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে বোঝানো হয়।

এসব শব্দ অভিভাবকদের বুঝতে সমস্যা হলেও তরুণদের পৃথিবীকে জানতে এসব শব্দ সাহায্য করে।

মা-বাবা ও শিক্ষকদের যা জানা দরকার

সাহস ও দৃঢ়তার মতো গুণই হতে পারে তরুণদের বড় শক্তি। এ জন্য দরকার সঠিক পরিচর্যা। তাদের সঠিকভাবে পরিচালিত করলেই কেবল এটা সম্ভব। সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব বা মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা গড়তে বড়দের সাহায্য দরকার।

তাদের শেখাতে হবে সদয়, সহানুভূতি এবং দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার পাঠ। এটাই চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা তাই সতর্ক করেছেন, ‘এই প্রজন্মকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা ইতিবাচকতা ও ঔদ্ধত্য, শক্ত ও কঠোর, আত্মবিশ্বাস ও আঘাত করা (বুলিং) এবং আত্মসম্মান ও অহংকারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে।’

আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি অন্যকে মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং অন্যের অবস্থান বোঝাও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ, সেটা শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের।

কেমন সাহায্য দরকার

মা-বাবা ও শিক্ষককেই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

  • অন্যের বক্তব্যকে সম্মান জানান: অন্যের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান জানিয়েও কীভাবে নিজের মত স্পষ্ট করে প্রকাশ করতে হয়, তা আপনি নিজে পালন করে সন্তানকে দেখান। এতে সে ছোট থেকেই বুঝতে পারবে।

  • শুনতে হবে সক্রিয়ভাবে: উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে অন্যের কথা ভালোভাবে শুনতে হবে। শেষ হলে তারপর বলার সুযোগ নেওয়া যাবে।

  • সহযোগিতা করার মানসিকতা: সাফল্য পেতে বা লক্ষ্য অর্জনে জীবনে দলগত কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধর চর্চা থাকা খুবই দরকারি। এ কথাটা নতুনদের শেখাতে হবে।

  • সহানুভূতির গুণ: আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তা গড়ে তুলতে শিশুদের সাহায্য করুন। অন্যের চোখে কীভাবে পৃথিবীকে দেখতে হয়, তা শেখাতে পারেন।

  • সীমারেখা টানুন: আত্মবিশ্বাস মানেই নিয়ম অমান্য করা বা অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করা নয়, তা শেখান। যুক্তি দিয়ে কথা বলতে হলেও কখন থামতে হবে, সেটা জানতে হবে।

অন্যের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান জানিয়েও কীভাবে নিজের মত স্পষ্ট করে প্রকাশ করতে হয়, তা আপনি নিজে পালন করে সন্তানকে দেখান

আত্মবিশ্বাস ও সহানুভূতির মতো গুণকে একসঙ্গে শেখানো গেলে, জেন-আলফা এমন এক প্রজন্ম হবে, যারা নিজেদের প্রয়োজন ও লক্ষ্য পূরণে সক্ষম, আবার অন্যের সম্মান ও সহযোগিতার মূল্য দিতে শিখবে। মাথায় রাখতে হবে, প্রতিটি প্রজন্মেরই আলাদা আলাদা শক্তির জায়গা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। তাই তাদের পৃথিবীকে বুঝে, সেরা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করাই বড়দের দায়িত্ব হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের মনোবিদ কী বলছেন

আজকের শিশু-কিশোরেরা মুখের ওপর কথা বলে, বড়দের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। এটা আমাদের দেশ বিবেচনায় কতটা নেতিবাচক? স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক এই আচরণকে পুরোপুরি নেতিবাচকভাবে দেখতে চান না। তিনি বলেন, ‘একটা শিশুর আচরণের ধরনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। বংশগত, মানসিক ও পরিবেশগত। তিনভাবেই বর্তমান অবস্থার ব্যাখ্যা করা যায়।’

এই প্রজন্মের স্বাধীনচেতা মনোভাব ও সব সময় ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়ে এই মনোবিদ বলেন, ‘অনেকে হয়তো এটাকে অ্যাসার্টিভনেস (মানসিক দৃঢ়তা) বলবে। কিন্তু প্রতিটি জিনিসেরই ভালো-মন্দ আছে। অ্যাসার্টিভনেস মানে যদি বেয়াদবি হয়, তাহলে সেটা নেতিবাচক অ্যাসার্টিভনেস। তবে আদতে সেটা ঠিক অ্যাসার্টিভনেস নয়, আচরণগত সমস্যা।’

আবার জেন-আলফাদের সামগ্রিক কার্যক্রমকে ভুল বলতে চান না শারমিন হক। কারণ, নিজেদের অর্জিত জ্ঞান ও ভাবনা অনুযায়ী তারা কাজ করে। এ জায়গায় বরং প্যারেন্টিংয়ের একটা ভূমিকা আছে। প্যারেন্টিংয়ের ওপরও সন্তানের আচরণ নির্ভর করে।

এ যুগের অনেক মা-বাবা সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করেন। সেই প্রভাবও শিশুদের আচরণে পড়তে পারে। অন্যদিকে আগের দিনের মা-বাবা একটু রক্ষণশীল ছিলেন। হয়তো মা কঠোর শাসন করতেন কিন্তু বাবা ছিলেন উল্টো, বেশি আদর করতেন। ফলে তৈরি হতো ভারসাম্য। তখন একই সঙ্গে শিশুটি শাসন–সোহাগ, দুটিই পেত এবং শিখত। আদর করেই হয়তো বাবা বলতেন, ‘তুমি এ কাজটা করেছ, তাই মা রাগ করেছে।’ ফলে শুরুতে খারাপ লাগলেও শিশু–কিশোরেরা সেটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত বলে মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী।

এই প্রজন্ম যুক্তি পছন্দ করে। তাই একসঙ্গে বসে সমস্যাগুলোর কথা ভাগাভাগি করা হলে, যুক্তিসংগত উপায়ে বোঝানো গেলে, জেন-আলফারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। তবে এটা ঠিক, নিজের মতামতকেই ওরা বেশি প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করে।

১৫–১৬ বছরের মধ্যে একজন কিশোর সৃজনশীল ভাবনা, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শিখে যায়। ডিজিটাল জমানার শিশু হওয়ায় এই শেখাটা এখন সময়ের আগেই ঘটে। তাই ঠিক বা ভুলকে তারা অন্ধভাবে মানতে চায় না। সর্বদা যুক্তি খুঁজে। এ বয়সেই ওরা তৈরি করতে চায় নিজস্ব পরিচয়। হয়ে উঠতে চায় স্বাধীন ব্যক্তি। কে, কীভাবে নিজেদের প্রকাশ করবে, সেটাও ভাবে। এই প্রক্রিয়া কিন্তু খুব স্বাভাবিক।

যুক্তিসংগত উপায়ে বোঝানো গেলে, জেন-আলফারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে

এ যুগে ইন্টারনেটে এক ক্লিকে পুরো দুনিয়া সম্পর্কে জানা যায়। একটি শিশুর উদাহরণ দিয়ে শারমিন হক বলেন, ‘শিশুটির মনোযোগে সমস্যা ছিল। সে নিজেই গুগল করে আমাকে বলল, “আন্টি, আমার মনে হয়, এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার) আছে।” অর্থাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই ছেলেমেয়েরা ভাবে, আমি তো গুগলে এটা পড়েছি, ইউটিউবে ওটা দেখেছি। সে অনুযায়ী নিজস্ব মত প্রকাশ করতে চায়। এটাই তখন বড়দের কাছে বেয়াদবি বা তর্ক মনে হয়।’

মা-বাবা, শিক্ষক, মিডিয়া, ইন্টারনেট থেকেই শিশুরা শেখে। শেখা জিনিসগুলো প্রয়োগ করতে গেলেই শুরু হয় ঝামেলা।

শারমিন হক মনে করেন, সমাজ, সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং মানসিক গঠন, সবই পরিবর্তন হচ্ছে। এসব কারণে সবাই ভাবছে, একটা জটিল প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। আদতে আচরণগত ভারসাম্য তৈরির জন্য এ প্রজন্মকে সাহায্য করা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এ দুটো মিলে গেলে সে সম্মান, শ্রদ্ধা করার বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝবে।

 শারমিন হকের পরামর্শ, শুরুতেই কঠোর সমালোচনা না করে সহানুভূতির সঙ্গে তাদের কথা শুনতে হবে। বিকল্প উপায় দেখিয়ে বোঝাতে হবে। বলা যেতে পারে, ‘যা করছ ঠিক আছে, কিন্তু এভাবেও তো করা যায়।’ তখন তারা এ বিষয়ে ভাবতে চাইবে। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার ঘটনাকে তিনি সাধারণ শ্রেণিতে ফেলতে চান না। বিশেষ পরিস্থিতিতে হুজুগে পড়ে শিক্ষার্থীরা এটা করেছে বলে তিনি মনে করেন। তবে কেন এমন হলো, সেটা তাদের জায়গা থেকে ভেবে দেখতে হবে।