কাউকে বলতে না–পারা কথাও যার কাছে অনায়াসে বলা যায়, সেই প্রকৃত বন্ধু। মডেল: সৌরভ অভি ও কাব্য, কৃতজ্ঞতা: রেইনি রুফ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ক্যাফে
কাউকে বলতে না–পারা কথাও যার কাছে অনায়াসে বলা যায়, সেই প্রকৃত বন্ধু। মডেল: সৌরভ অভি ও কাব্য, কৃতজ্ঞতা: রেইনি রুফ রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ক্যাফে

ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব নাকি প্রেম

এ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজের দশ দিকে উঁকি দিন। হঠাৎ আসা কোনো বিপন্ন মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। বুকের ভেতর আটকে আছে বলতে না–পারা কথা আর হাহাকার। নাহ্, এই বুঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে সব। বলতে না–পারা কথার ভার নিয়ে নির্জনে কারও পাশে দাঁড়ালে হয়তো হালকা হয়ে যাবে বুক। ঠিক এমন সময় কার কথা মনে পড়ে! যে কিনা, আলো ফুরিয়ে আসা বিকেলে সব শুনে বলবে ‘ব্যাপার না’, পিঠে হাত রেখে সমূহ না–এর মাঝে ছড়িয়ে দেবে অসীম হ্যাঁ–এর আলো। সে–ই পরম সখা। বন্ধু। পিঠে হাত বুলিয়ে হাহাকার ভুলিয়ে দেওয়া নাবিক। পঞ্চম সওয়ারিতে আনন্দভৈরব বাজিয়ে মৌরিদানার মতো হিম নামিয়ে আনে বুকে, মন খারাপ উড়িয়ে দেয় দূর দিগন্তের দিকে।

বন্ধুরা এমনই হয়। সেই কবে বাড়ি ছেড়ে, মায়ের স্নেহের পরশ ছেড়ে অচিন শহরে বন্ধুর ভরসাতেই তো পথচলা শুরু হয় অনেকের। বিশ্বাস নিয়ে আলোর মতো পাশে পাশে থাকে বন্ধু। কাউকে বলতে না–পারা কথাও যার কাছে অনায়াসে বলা যায়, জীবনে সেই বন্ধুই থাকে আনন্দের তারাবাতি হয়ে।

সিফাত ও তানি (ছদ্মনাম) এমনই আনন্দের তারাবাতি হয়ে আছেন একে অপরের কাছে। স্বজন ছেড়ে দুজনেই পড়াশোনার জন্য এসেছিলেন ঢাকায়। শুরুতে পড়াশোনাসহ অনেক কিছুই বুঝতে অসুবিধা হতো। তেমন কেউ সাহায্য করত না। এমন সময় সিফাত-তানির পরিচয়। আস্তেধীরে দুজনের বোঝাপড়া দৃঢ় হতে থাকে। জমে থাকা আনন্দ–বেদনা ভাগ করে নেন দুজনে। একসময় দল বড় হলেও পুরোনো বন্ধু সিফাত ও তানির সখ্য একটু বেশি। অন্যরা গুঞ্জন ছড়াতেন—তাঁদের মধ্যে প্রেম আছে। এমন গুঞ্জনের মধ্যেই শেষ হয় পড়াশোনা। তানি চলে যান মার্কিন মুলুকে। কিন্তু সিফাত–তানির যোগাযোগ কমেনি। তাই দুজন আলাদা জায়গায়, আলাদা সংসারে থিতু হলেও বন্ধুত্ব অটুট রয়ে গেছে।

দুজনের মধ্যে বেশি আন্তরিকতা থাকলে অন্যরা গুঞ্জন ছড়াতে পারেন—তাঁদের মধ্যে প্রেম আছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত সিফাত বলেন, ‘ছেলে–মেয়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে পরিবার এমনকি বন্ধুরাও সন্দেহ করে। আমরা দুজনেই জানতাম, সবাইকে সবকিছু দিতে নেই। কারও জন্য গোপনে কিছু রেখে দিতে হয়। সেটা আমরা রেখেছিলাম। তাই এখন মধ্যবয়সেও দারুণ বন্ধুত্ব উপভোগ করছি। সবকিছু নিয়ে এখনো আমাদের কথা হয়।’

সিফাত–তানির সম্পর্ক বন্ধুত্ব পর্যায়ে থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা প্রেমের সম্পর্কে গড়ানোর নজির আছে। তবে কাছের বন্ধুর সঙ্গে প্রেমে না জড়ানোর পরামর্শ অনেকের। কারণ, সম্পর্ক যদি ঠিকঠাক না চলে, তখন প্রেম তো হয়ই না, বন্ধুত্বও ছুটে যায়। আর গবেষণা বলছে, সফল সম্পর্কের ভিত্তি হলো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হলে সেই সম্পর্ক প্রেমে গড়ালেও টেকসই হয়।

কানাডার একদল গবেষকের দ্য ফ্রেন্ডস টু লাভারস পাথওয়ে টু রোমান্স: প্রিভেলেন্ট, প্রেফারড অ্যান্ড ওভারলুকড বাই সায়েন্স শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র সোশ্যাল সাইকোলজিক্যাল অ্যান্ড পার্সোনালিটি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়া ইন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডানু স্টিনসন বলেন, বন্ধুরা পরস্পরকে ভালোভাবে জানতে পারেন, লুকোচুরি কম থাকে। বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের মানে সবকিছু জেনেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। তাঁদের সম্পর্কটা সহজ হয়। আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গভীর হলে, প্রেমের সম্পর্কে পারিবারিক চাপ কম থাকে। সফল পরিণতির দিকে এগোতে তেমন বাধা থাকে না। প্রত্যাশার ক্ষেত্রেও ঝামেলা হয় না।

তবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রেমে গড়ানোর পর অনেকের সব সম্পর্কই চুকেবুকে গেছে। তাঁরা হয়তো জানেন না, সম্পর্ক ভেঙে ফেলা সহজ, টিকিয়ে রাখাই বরং কঠিন, তার জন্য দরকার জেদ আর বিশ্বাস।

যেমনটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ইশরাত ও শুভর ক্ষেত্রে ঘটেছে। তাঁদের বন্ধুত্বটা সিফাত–তানির মতোই হয়েছে। আড্ডায় গিটার বাজিয়ে গান শোনাতেন শুভ। একসময় ভুল–বোঝাবুঝির ঘটনায় দলছুট হয়ে পড়ে অন্য বন্ধুরা। বন্ধু হারানোর বেদনা বুকের ভেতর গুমরে উঠলে পাশে বকুল ফুলের মতো ফুটে ছিলেন শুভ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার শেষ দিকে শুভ কেমন যেন হয়ে যান। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারেন না। যাকে সব বলা যায়, সেই বন্ধু ইশরাতকেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। একদিন জোরাজুরিতে বলে ফেলেন—ভালোবাসি। রাগ করেন ইশরাত। বন্ধুকে জানিয়ে দেন, ‘ওই মুখ আর দেখাবে না।’ যোগাযোগ বন্ধ। একাকিত্বে থাকতে থাকতে ভাবেন—বন্ধুরা ছেড়ে গেলেও যে কিনা বকুল ফুলের মতো ফুটে ছিল পাশে, তাঁকে না ভালোবেসে আমি কোথায় যাব! ব্যস, ইশরাতও একদিন জানিয়ে দিলেন—ভালোবাসি। তারপর কিছুদিন চুটিয়ে প্রেম করে এখন তাঁরা সংসারী।

ইশরাত ও শুভ আলাদা দুটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করছেন। ইশরাত বলেন, ‘আমাদের (ছেলে–মেয়ে) বন্ধুত্বের সম্পর্ককে অনেকেই প্রেম বলে সন্দেহ করত। প্রেম ছিল না, তাই শুনতে খারাপ লাগত। প্রেমটা শুরু হয়েছে, সবাই যখন ভেবেছে আমাদের সব সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। জীবনে ছেলে বা মেয়ে বন্ধুর দরকার আছে। দরকার আছে প্রেমেরও। দুজনের বন্ধুত্ব প্রেমে গড়ালে বোঝাপড়াটা সহজ হয়। এই যেমন আমাদের যৌথ জীবনে এখন হাওয়া বইছে শনশন করে।’

জীবনে ছেলে বা মেয়ে বন্ধু আসবে। বন্ধুর সম্পর্ক কখনো প্রেম, কখনোবা ভাঙনের দিকে বাঁক নিতে পারে। প্রেম যতটা না গড়ায়, তারও চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়ায় গুঞ্জন। এই গুঞ্জন আর সব বন্ধুর থেকে নিজেকে একা করে দেয়, প্রেম হলেও। এতে হাল ছাড়লে চলবে না। দেখবেন, এমন সময়ও চিরদিনের বন্ধুর মতো পাশে থেকে গেয়ে উঠছেন অখিল বন্ধু ঘোষ—‘যেন কিছু মনে করো না কেউ যদি কিছু বলে, কত কী যে সয়ে যেতে হয় ভালোবাসা হলে।’