
শিশু-কিশোরেরা কোমল ও সরল হবে। কৌতূহলী হবে, আবার কখনো ক্ষিপ্র, চঞ্চল ও অদ্ভুত হবে। কিন্তু সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত এমন কিছু নৃশংস ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে, যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর অপরাধকেও হার মানায়। শিশুরা কেন অপরাধী হয়ে ওঠে? তাদের নৃশংসতার মনস্তত্ত্ব কীভাবে গড়ে ওঠে? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।
শিশুর বিকাশের মূলে রয়েছে পরিবার। একটি শিশু অনেকগুলো চাহিদা নিয়ে জন্মায়। সে ভালোবাসা, উষ্ণতা, যত্ন ও নিরাপত্তা চায় এবং একই সঙ্গে আনন্দও চায়। শিশুর এসব চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি না, তার ওপর নির্ভর করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশুর বন্ধন নিরাপদ হচ্ছে কি না। মনোবিজ্ঞানী জন বলবি তাঁর ‘বন্ধন তত্ত্বে’ শিশুর বিকাশে নিরাপদ বন্ধনের কথা বলেছেন, যা শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য জরুরি। শিশুর সঙ্গে থেকে পর্যাপ্ত যত্ন ও আদর, শারীরিক ও আবেগসংক্রান্ত নিরাপত্তা দেওয়া, শিশুর সঙ্গে খেলা ও আনন্দদায়ক সময় কাটানোর মতো কাজগুলো শিশুকে নিজের ও অন্যের প্রতি আস্থা তৈরিতে সহযোগিতা করে। কিন্তু অনেক পরিবারেই শিশুরা নিরাপদ বোধ করে না। তাদের বিভিন্ন চাহিদার প্রতি অভিভাবকের অবজ্ঞা বা অতিসুরক্ষা, শারীরিক ও মানসিক শাস্তি, ক্রমাগত অন্যের সঙ্গে তুলনা, সমাজে নিজেকে সফল বাবা-মা হিসেবে জাহির করার জন্য শিশুর কাছে অতি প্রত্যাশা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকের সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে। নিজের অজান্তেই তখন ভালোবাসা ও আনন্দের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজতে থাকে শিশু। পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া মানসিক আঘাতের ফলে শিশুরা একদিকে যেমন মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে, আবার কিছু শিশু নিজের চাহিদা পূরণে বেছে নেয় ভুল পথ, ভুল সঙ্গ, যা তাকে ধীরে ধীরে অপরাধী করে তোলে। মাদক সেবন, ফোনাসক্তি ও ক্ষতিকর কনটেন্ট দেখা (সহিংস ভিডিও গেম, পর্নোগ্রাফি), কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা শিশু-কিশোরদের নৃশংস করে তুলতে পারে।
অনেক সমাজেই সহিংসতাকে পুরুষত্বের নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়। আলফা মেল হিসেবে একধরনের অহংবোধ করে তারা। শিশুরা যখন দেখে যে হিরোদের অস্ত্রধারী হতে হয়, মারামারি করেই জয়ী হতে হয়, তখন তারা সেটাকেই অনুকরণ করে। বিশেষ করে টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও গেম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতা যখন বিনোদনের উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিশুরা বাস্তবতা ও কল্পনার পার্থক্য করতে পারে না। এই মিডিয়া কনটেন্টগুলো অনেক সময় শিশুর মনে নৃশংসতা ও প্রতিহিংসার বীজ বুনে দেয়। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে ইন্টারনেট, গেম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার বড় চিন্তার বিষয়। অনেক গেমে ‘হত্যা’, ‘বিরোধ’, ‘জয়-পরাজয়’-এর মধ্য দিয়ে সহিংসতা উপস্থাপন করা হয়। শিশুরা এসব গেমে মেতে উঠলে বাস্তব জীবনে মানুষের প্রতি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে একই ধরনের আচরণ করে। এভাবে ক্রমেই তাদের আচরণে নৃশংসতা ঢুকে পড়ে।
বিদ্যালয় হচ্ছে শিশুর দ্বিতীয় ঘর। যদি একজন শিশু সহপাঠীদের দ্বারা বারবার বুলিংয়ের শিকার হয় বা কোনো বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে নেতিবাচক আচরণ শেখে, তবে তার মধ্যেও প্রতিশোধপরায়ণতা ও রাগ জন্ম নিতে পারে। আবার অনেক সময় দলগত চাপে পড়ে শিশুরা এমন কাজ করে ফেলে, যা তার নিজের মন থেকেও আসে না। বরং ‘গ্রুপ একসেপ্টেন্স’ বা দলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তারা এমনটা করে থাকে। অনেক সময় বন্ধুদের মধ্যে নিজের ‘কুলনেস’ প্রকাশ করতে গিয়েও শিশু-কিশোরেরা সহিংস হয়ে ওঠে।
শিশুদের বড় করার ব্যাপারে অনেক অভিভাবকের সচেতনতা ও দক্ষতার ঘাটতি থাকে। তেমনি শিশুরা ভুল পথে পা বাড়ালে কী করণীয়, সে ব্যাপারেও অনেক অভিভাবক কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক সময় অতিরিক্ত শাসন বা দূরত্ব শিশু-কিশোরদের জন্য আরও বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।
একটি শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য কী দরকার, কোন পথে থাকতে হবে, কোন কাজের কী ফলাফল হতে পারে, সে সম্পর্কে অভিভাবকদের প্রথমে সচেতন হতে হয়। তারপর সেই অনুযায়ী সন্তানকে দীক্ষা দিতে হয়। শিশুর বিকাশ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজ শিশুদের নৈতিক শিক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে শিশুরা নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তকে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা বুঝে উঠতে পারে না, তাদের কোন আচরণ ক্ষতিকর।
সন্তান বড় করাটা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব। কিন্তু এটিকে সহজ মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেক অভিভাবকের শিশুর বিকাশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা আবশ্যক। এতে সন্তানকে বোঝা এবং তার সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করা অভিভাবকের জন্য সহজ হয়। পারিবারিক বন্ধন ও একটি সংবেদনশীল, সমমর্মিতার সমাজই পারে শিশু-কিশোরদের নৃশংস না হয়ে মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করতে।