মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মিরপুরের চেহারা যেন পাল্টে গেছে
মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মিরপুরের চেহারা যেন পাল্টে গেছে

যেসব কারণে বদলে গেল ঢাকার মিরপুর

মেট্রোরেলের কাজ শুরু হলে মিরপুরের চালচিত্রে আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে মিরপুরবাসীর যাপনধারা। সেটারই পালে বাতাস পায় মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর।

তিন সময়ের তিনটি ঘটনা দিয়ে লেখা শুরু করা যাক।

দৃশ্য ১

১৯৯০ সাল। মিরপুরে থাকি। এখন যেখানে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, সেখান থেকে বাসে উঠেছি। ১১ নম্বরে বাস থামলে আমার সহযাত্রী জানালার বাইরে তাকিয়ে বাসস্টপে দাঁড়ানো পরিচিত একজনকে পেয়ে কুশল বিনিময় করছেন। অপরজন জানতে চাইলেন যে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। সহযাত্রীর উত্তর, ‘ঢাকায় যাই।’

(এই কথোপকথন আমাকে বাঙালি লেখক প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। লেখকের বাবা চাকরির সুবাদে বকশীবাজার থেকে মিরপুরে যেতেন। দারুণ সেই বর্ণনা।)

দৃশ্য ২

১৯৯৮ সাল। মিরপুরে তখন ফ্যাশন ব্র্যান্ড বলতে গ্রামীণ উদ্যোগ আর গ্রামীণ চেক। সনি সিনেমা হলের নিচে গ্রামীণ উদ্যোগের একটি শাখা ছিল। ওই সময়ে গ্রামীণ উদ্যোগের নতুন ব্যবস্থাপনা দল ব্র্যান্ডটিকে সময়োপযোগী করার পরিকল্পনা করে। সেইমতো কাজ শুরু হয়। তো একই বছরে রোজার সময় প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসের কাজ সেরে আড্ডা দিতে মিরপুর চলে যেতাম। আমি আর প্রয়াত ডিজাইনার এমদাদ হক আউটলেটের বাইরে ভ্যানের ওপর বসে আড্ডা দিতাম। সেবার তাঁর ডিজাইন করা একটা পাঞ্জাবি বেশ জনপ্রিয় হয়। যাকে বলে হটকেক। এক সন্ধ্যায় দোকানের ঝাঁপ নামানো হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে তখনো পাঁচজন কাড়াকাড়ি করছেন। ওই ডিজাইনের পাঞ্জাবি একটাই আছে। আমরা বাইরে রাজা-উজির মারছি। ওহ হ্যাঁ, বলা হয়নি, গ্রামীণ চেকের আউটলেট ছিল মিরপুর ১০ নম্বরে। এর পাশেই আরও ৪ বছর পর আসবে বাংলার মেলা। কারণ, গ্রামীণ উদ্যোগের এই গ্রুপই তো গ্রামীণ উদ্যোগ ছেড়ে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করবে বাংলার মেলা নামে নতুন ও হ্যাপেনিং ফ্যাশন ব্র্যান্ড। আর সনি সিনেমা হলের উল্টো দিকে আড়ং আসে ২০১৮ সালে।

পুরোনো মিরপুরে জীবনের স্বাদ অন্য রকম ছিল

দৃশ্য ৩

২০০৭ সাল। জানুয়ারি মাস। কোনো একটা কাজে মিরপুর ১১ নম্বরে গেছি। ফেরার সময় তখনকার এক সিএনজির চালককে উত্তরা যাব বলতে তিনি রাজি হলেন। বললেন, ‘নতুন একটা রাস্তা হয়েছে। চলেন, ওই রাস্তা দিয়ে যাই, তাড়াতাড়ি হবে।’

আজকের কালশীকে সেদিনের কালশীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কালশী থেকে ইসিবির দিকে টার্ন করতেই সিএনজির চাকা গেল বালুতে দেবে। কারণ, পুরো রাস্তায় তখন বালু ফেলা। নতুন রাস্তা বটে। শর্টকাটও। যাহোক, সেই বালুপথ পাড়ি দিয়ে উত্তরায় ফেরা হলো।

প্রসঙ্গত, মিরপুর ডিওএইচএস হতে তখনো ৮ বছর। কালশী থেকে ডিওএইচএস যাওয়ার পথে দুপাশে পাল্লা দিয়ে তখন চলছে জলাশয় গ্রাস ও নিধন; মেঘছোঁয়া ইমারত নির্মাণের জন্য।

এই তিনটি দৃশ্যের সাকল্য ব্যবধান ১৭ বছর। মিরপুরের বদলে যাওয়া ছবির ভিত এই সময়ে গড়া হয়ে যায়। নেপথ্যে আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। ১৯৯৩ সালে অবশ্য ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। ২০০৬ সালে মিরপুর স্টেডিয়াম উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এলাকাটির রূপান্তরের সূচনা ঘটে। ক্রিকেট যখন ধীরে ধীরে ঢাকার কেন্দ্র—জাতীয় স্টেডিয়াম ছেড়ে মিরপুরে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে; তখন থেকেই মিরপুরবাসীর যাপনে আসে নতুন উন্মেষ।

আইসিসি ট্রফি জয়, বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো, টেস্ট অভিষেক, বিশ্বকাপ আয়োজনের অংশীদার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশজুড়ে তখন ক্রিকেটের জোয়ার। সেই রেশেই মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে গড়ে ওঠে স্পোর্টস কিট ও অ্যাকসেসরিজের দোকানপাট, আশপাশে শুরু হয় মার্কেট নির্মাণ।

ওই সময়ের মিরপুরের শপিং দৃশ্যপটে উল্লেখযোগ্য ছিল কয়েকটি মার্কেট। ক্যান্টনমেন্ট লাগোয়া মার্কেটটি তখন গয়নার জন্য জনপ্রিয় ছিল; পাশাপাশি বিছানার চাদর, বালিশের কভার, পোশাকসহ নানা পণ্যেরও সমাহার থাকত সেখানে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে বলতে পারি, মিরপুর ১০-এর শাহ আলী মার্কেট ছিল তিনতলা ভবনজুড়ে। জুতা, জামাকাপড়ের পাশাপাশি পাঞ্জাবির জন্যও বেশ খ্যাতি ছিল এটির। পরে বিল্ডিং আকাশের দিকে প্রসারিত হয়েছে। এ ছাড়া পূরবী সিনেমা হল মার্কেট ও মিরপুর ১২ নম্বর মার্কেটও তখন ব্যস্ত কেন্দ্র ছিল। ১ নম্বরে ছিল কো–অপারেটিভ,মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট। পরে যোগ হয় প্রিন্স মার্কেট।

মিরপুরের স্টেডিয়াম

সেই সময় মিরপুর ১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এখনকার মতো ফার্নিচারের দোকানের সারি ছিল না; বরং দুপাশে টিনের চালার ছোট ছোট দোকান ছিল মফস্‌সল শহরের মতো; সাধারণ, কিন্তু জীবনঘনিষ্ঠ।

২০০৬ সালে মিরপুরে পৌঁছে যায় পারসোনা বিউটি স্যালন—পরিবর্তনের অভিযাত্রায় যেন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়।

নব্বইয়ের দশকের শেষ কিংবা এই শতকের প্রথম দশকের শুরুর দিকেও মিরপুর ১০ থেকে ১১ পর্যন্ত রাস্তায় দেখা যেত, তাঁতিরা বেনারসি ও কাতানের টানা দিচ্ছেন; বিশেষ করে ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনের দিকে। তখন বেনারসির দোকান ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। তবু সেই সময় মিরপুর বেনারসিপল্লির ছিল এক সোনালি যুগ। সঞ্জয় লীলা বানসালির ছবি ‘দেবদাস’-এ মাধুরী দীক্ষিত ও ঐশ্বরিয়া রাই ‘ডোলা রে…’ গানে নাচবেন বলে তাঁদের জন্য শাড়ি যাচ্ছে মিরপুর থেকে। ভাবা যায়!

মিরপুরে এখন রোশনাই ছড়ানো দোকানের সংখ্যা বেড়েছে

সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। সেই মিরপুরে এখন রোশনাই ছড়ানো দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। আর ব্যস্তানুপাতিক হারে কমেছে তাঁত ও তাঁতি। একজন বয়নশিল্পী সেদিন তাই দুঃখ করে বললেন, মিরপুর বেনারসিপল্লির নাম বদলে ইন্ডিয়ানপল্লি রাখলেই হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, মিরপুরের বয়নশিল্পের এই দুর্দশায় কারও গাত্রদাহ নেই।

এবার প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি, শেওড়াপাড়ায় তখন একটা এবং বলতে গেলে একমাত্র চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। ব্লু লেগুন। বর্তমানে সেটা বন্ধ আছে। সেই সময়ে আগারগাঁও তালতলা থেকে শেওড়াপাড়া যাওয়ার পথেই পড়ত। সেটা ছিল একটা দ্বীপের মতো। আশপাশে কিছুই ছিল না। মিরপুরবাসীর আউটিংয়ের এটাই ছিল রোমাঞ্চকর গন্তব্য। যাকে বলে সবেধন নীলমণি।

বেনারসিপল্লিতে ছিল চাপ ও কাবাবের দোকান, আর ১০ নম্বর গোলচত্বরে বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান। এসব আজও আছে। আরও ছিল নানান খাবার হোটেল, লেফট ওভার পোশাকের দোকান; এদিক-ওদিকের সাধারণ দোকান—সব মিলিয়ে মিরপুরে তখনো জীবনের স্বাদ অন্য রকম ছিল।

২০১১ সালের মিরপুর

২০০০ সালে বাংলার মেলা শুরু হয়। সূচনা থেকে এটাই ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ব্র্যান্ড। ফলে এই ব্র্যান্ড যেখানেই গেছে, সেখানেই সাড়া জাগিয়েছে। মিরপুরেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ফলে বাংলার মেলার পথ ধরে বিভিন্ন ব্র্যান্ড মিরপুরে পাড়ি জমাতে শুরু করে। এতে ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত রাস্তার বাঁ পাশে গড়ে ওঠে ব্র্যান্ডের দোকানের সারি। মিরপুরবাসীর জন্য তখন থেকে কেনাকাটা মানেই ‘নিজের এলাকা থেকেই সব পাওয়া’, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি বা গুলশান যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

এই ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। ২০১৮ সালে মিরপুর ১ নম্বরে আড়ং আসে। ঠিক সনি সিনেমার উল্টো দিকের বিল্ডিংয়ে। চিড়িয়াখানা রোডের এই বাড়িতে কয়েক বছর পর প্রতিবেশী হয় লা রিভ। এরপর এই রাস্তা রূপান্তরিত হয়েছে নতুন ফ্যাশন স্ট্রিটে; বড় সব ব্র্যান্ড মোটামুটি এখানে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। কেবল বসন নয়, অশনের আয়োজনও সমান্তরালে এগিয়েছে।

মিরপুরের অন্য প্রান্তও পিছিয়ে ছিল না। প্রান্তই–বা বলি কেন, সব জায়গাই মুখর হতে শুরু করে। কারণ, এরই মধ্যে তো ডিওএইচএস আলোর মুখ দেখেছে। সেটা ২০১৫ সাল। এর এক বছর পর শুরু হয়ে যায় মেট্রোরেলের কাজ। ফলে মিরপুরের চালচিত্রে আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে মিরপুরবাসীর যাপনধারা। সেটারই পালে বাতাস পায় মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে মিরপুরবাসীর যাপনধারা

যাহোক, ডিওএইচএস প্রসঙ্গে ফেরা যাক। নতুন আবাসিক এলাকা। একটা টাউনশিপই বটে। র‍্যাডিসন হোটেল থেকে ইসিবি পর্যন্ত ফ্লাইওভার হয়েছে। রাস্তা সরাসরি গিয়ে প্রবেশ করেছে ডিওএইচএসে। যাতায়াত হয়েছে সহজ। ফলে ডিওএইচএসের বাইরে রাতারাতি তৈরি হয়েছে ফুড জোন বা নতুন খাবার জায়গা। দুই পাশে তখনো জলা, তখনো সবুজ। মানুষ অচিরেই ভিড় করেছে খাওয়া ও সময় কাটানোর জন্য। হংসমিথুনদের উপস্থিতি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।

এ পাশটায় অবশ্য অশনের আয়োজনই বেশি।

ক্যাফে, ফুড জয়েন্ট, রেস্টুরেন্ট, ফুড কোর্ট মিলিয়ে সেই মিরপুর ১২ এখন সরগরম

অন্য পাশ, মানে ১২ নম্বরের দিকটাই–বা পিছিয়ে থাকবে কেন। জমে উঠেছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। আড়ংয়ের উপস্থিতি এই অভিযাত্রায় অনুঘটক হয়েছে। অন্য অনেক ব্র্যান্ড যোগ দিয়েছে এই কাফেলায় এবং নতুন এক ফ্যাশন স্ট্রিটের জন্ম হয়েছে মিরপুর ১২ নম্বরে।

কেবল পোশাক নয়, ক্যাফে, ফুড জয়েন্ট, রেস্টুরেন্ট, ফুড কোর্ট মিলিয়ে সেই মিরপুর ১২ এখন সরগরম—কেনাকাটা কিংবা রসনাবিলাসের জন্য। অবশ্য সেটা কেবল ওই জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সেই আগারগাঁও থেকেই এর শুরু। এই সময়ের মধ্যে শীর্ষ সারির স্যালনগুলোও হাজির হয়ে গেছে মিরপুরে। একইভাবে বিভিন্ন যাপন উপযোগী পণ্যের ব্র্যান্ড পসরা সাজিয়ে বসেছে। হয়েছে একের পর সুপার শপ। কী নেই এখন মিরপুরে!

এসবের সঙ্গে কালশী থেকে ডিওএইচএস যাওয়ার জন্য নতুন ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল চালু হওয়া মিরপুরবাসীর জন্য হয়েছে সোনায় সোহাগা।

এই যে চালচিত্রের পরিবর্তন, এটা মাত্র সাড়ে তিন দশকের। তবে দ্রুততর যে পরিবর্তন সেটা আরও কম সময়ের। প্রজন্ম বদলে গেছে—জেন এক্স থেকে মিলেনিয়াল, জেন–জি পেরিয়ে এখন আলফাদের সময়। প্রযুক্তির অগ্রগতি এই প্রজন্মকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি পাল্টে দিয়েছে তাদের জীবনযাপন, রুচি ও অভ্যাস।

মিরপুর এখন আর শহরের প্রান্ত নয়; বরং মেগাসিটি ঢাকার প্রাণস্পন্দন

এভাবেই খাদ্যরুচি, পোশাকের রুচি—এমনকি কেনাকাটার মনোভাবেই ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। মিরপুর অনেক আগে থেকে ঢাকার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও স্থানীয়রা নিজেদের বাইরের মানুষই মনে করতেন। সেই মনোভাবেও পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর কাউকে ঢাকায় যাচ্ছি বলতে শোনা যায় না। মেগাসিটির অংশ হিসেবে মিরপুর ঢাকার অন্য কোনো অংশের চেয়ে কম নয়; বরং মেট্রোরেলের কারণে অনেকাংশেই এগিয়ে।

মিরপুর এখন আর শহরের প্রান্ত নয়; বরং মেগাসিটি ঢাকার প্রাণস্পন্দন। মেট্রোরেল, ব্র্যান্ড কালচার, ফুড স্ট্রিট, ডিওএইচএস, নতুন আবাসন—সব মিলিয়ে মিরপুর এখন আধুনিকতা, ঐতিহ্য ও নাগরিক সংস্কৃতির এক অনন্য সংমিশ্রণ।

সময় বদলেছে, প্রজন্ম বদলেছে আর বদলে গেছে মিরপুরের গল্প—যে গল্পে আছে সংগ্রাম, স্বপ্ন আর এক অদম্য শহুরে উদ্যমের প্রতিধ্বনি।