
বাসার সবাই একসঙ্গে খেতে বসা তো আটপৌরে জীবনেরই একটি অংশ। অনেক পরিবারে সকালে মা-বাবা, ভাইবোন, এমনকি দাদা-দাদি—সবাই একসঙ্গে নাশতা করে। দুপুরে হয়তো খাওয়াটা একসঙ্গে হয় না চাকরি আর পড়াশোনার কারণে। আর রাতের খাবার টেবিল তো যেন গল্পের আসর। সারা দিন কার স্কুলে কী হয়েছে, কার অফিসে কী হলো—সব প্রাণ খুলে বলে ফেলার এক সুবর্ণ সুযোগ। স্কুলে পিকনিক? বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ট্যুর? এমন সব আবদার মা-বাবার সামনে তুলে ধরার ভালো সুযোগ করে দেয় খাবার টেবিল।
সম্প্রতি এই স্বাভাবিক কাজেরও একটি বিশেষ উপকারিতা খুঁজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা। যেসব শিশু পরিবারের সঙ্গে বসে নিয়মিত খাবার খায়, তারা অন্যদের চেয়ে পড়াশোনায় ভালো করে।
পরিবারের সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার ফলে শিশুদের বেশ কিছু দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। যেমন আবেগ নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগের দক্ষতা ও শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হওয়া। খাবার টেবিল ভদ্রতা ও পারিবারিক মূল্যবোধ শেখার দারুণ স্থানও বটে।
খাবার টেবিলে পরিবারের সবার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা হলে অনেক বদভ্যাস থেকেও দূরে থাকা যায়। এটি সামগ্রিকভাবে আমাদের সুস্থতা ও সাফল্যের জন্য জরুরি।
পরিবারের সবাই মিলে খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে পড়াশোনায় ভালো করার এই সম্পর্ক সত্যিই কৌতূহল–জাগানিয়া। এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ‘ন্যাশনাল সেন্টার অন অ্যাডিকশন অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ’ কয়েকজন টিনএজারের ওপর গবেষণাটি চালায়। অংশগ্রহণকারী টিনএজাররা নিয়মিত তাদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খায়, সপ্তাহে পাঁচ দিন কিংবা তারও বেশি।
গবেষণাটিতে দেখা গেছে, এই টিনএজাররা তাদের বাকি সহপাঠীদের চেয়ে বেশি ‘এ গ্রেড’ পেয়েছে। পিছিয়ে থাকা সহপাঠীরা এগিয়ে থাকাদের তুলনায় পরিবারের সঙ্গে বসে তুলনামূলকভাবে কম খাওয়াদাওয়া করেছিল।
গবেষকদের ধারণা, একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে। এখন চারপাশে কেবলই প্রতিযোগিতা। ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণই ক্লাস, কোচিং, অ্যাসাইনমেন্ট, বাড়ির কাজ নিয়ে অস্থির। সঙ্গে আছে সহশিক্ষা কার্যক্রম।
‘তোমাকে সেরা হতেই হবে’—এই চাপও থাকে সব সময়। সারা দিনের এই ইঁদুরদৌড়ের পর ডাইনিং টেবিল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের দম ফেলার জায়গা। সেখানেই তারা মানসিক সমর্থন খুঁজে পায়। পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা অনুভব করে।
একসঙ্গে বসে খাওয়ার এই উপকারিতা শুধু পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। খাবার টেবিলে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। শিশু-কিশোরেরা প্রশ্ন করার এবং মা-বাবার কথা শোনার সুযোগ পায়।
বাড়ির সদস্যরা নিজেদের সারা দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। নিজেদের মূল্যবোধ এবং একে অন্যের কাছে তাদের প্রত্যাশা নিয়েও আলোচনার সুযোগ পান। এতে শিশুরা চিন্তা করতে শেখে। নিজেদের ভাবনা মা-বাবার কাছে প্রকাশেরও সুযোগ পায়।
এসব আলোচনার ফলে তারা দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে শেখে, সেটা হোক বাড়ি কিংবা ক্লাসে। প্রতিদিনের আলোচনার এই অভ্যাসে শিশু সুন্দরভাবে, গুছিয়ে কথা বলতে শেখে। এই গুণ পর্যায়ক্রমে ভালো ফলাফলের দিকে তাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়।
খাবার টেবিলে একটি নিরাপদ ও আন্তরিক পরিবেশে নিজেদের চিন্তাভাবনাগুলোকে শিশুরা গুছিয়ে প্রকাশ করতে শেখে। অনেকের মাথায়ই অনেক ভালো ভালো আইডিয়া আসে। কিন্তু শুধু গুছিয়ে প্রকাশ করতে না পারায় সেসব আইডিয়া কোনো দিন বাস্তবায়ন করা হয় না।
নিজের কাজকে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করতে পারার কারণে অনেকে পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে ব্যর্থ হন। তাই ছোটবেলা থেকেই গুছিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারা ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ ছাড়া একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করলে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের বন্ধন দৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।
গবেষণাটিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল চোখে পড়ার মতো। পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে খেতে বসা অনেক বদভ্যাস থেকে দূরে রাখে। যেমন কিশোর বয়সে ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি। মা-বাবা উপস্থিতি ও নজরদারি এসব ক্ষেত্রে একটি রক্ষাকবচের মতো কাজ করে।
পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার মতো একটা সহজ কাজও শিশুর ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার ক্ষেত্রে স্কুলের পরিবেশ এবং শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েই সবাই বেশি ভাবেন। কিন্তু পরিবারেরও যে এ ক্ষেত্রে কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, গবেষণাটি সেটিই তুলে ধরে।
এখনকার চ্যালেঞ্জিং পৃথিবীতে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার সময় বের করা হয়তো অনেকের জন্যই দুরূহ। কিন্তু এই কাজ নিয়মিত করতে পারলে আপনার সন্তান শিক্ষাদীক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। একসঙ্গে খাবার খাওয়া শুধু শরীরেই পুষ্টি জোগায় না, মন ও মস্তিষ্কের খোরাক হিসেবেও খুবই জরুরি।
সূত্র: ন্যাশনাল সেন্টার অন অ্যাডিকশন অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি