
শিশুদের নার্সিসিস্টিক প্রবণতা হঠাৎ তৈরি হয় না; এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সম্পর্ক, প্রত্যাশা ও পারিবারিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে। পরিবারে ভালোবাসা হওয়ার কথা নিঃশর্ত, কিন্তু সেখানেই অনেক সময় শিশু শিখে ফেলে, তার মূল্য নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফল, পারফরম্যান্স কিংবা কতটা ‘প্রয়োজনীয়’ হয়ে উঠতে পারছে, তার ওপর। অতিরিক্ত প্রশংসা হোক বা অবমূল্যায়ন, অতিরিক্ত দায়িত্বের চাপ হোক বা অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিশুর নিজের সত্তা ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। চলুন জেনে নিই শৈশবের এমন পাঁচটি পরিবেশ, যা নার্সিসিস্টিক ব্যক্তিত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
আমাদের সমাজে অনেক পরিবারে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা শুরুই হয় তুলনা দিয়ে। যেমন ‘আমার ছেলেটা ক্লাসে ফার্স্ট’, ‘আমার বাচ্চা অনন্য, প্রতিভাবান’। এ কথাগুলো আদরের প্রকাশ মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে একধরনের অস্বাস্থ্যকর প্রশংসা। এখানে শিশুকে ভালোবাসা হয় না তার চেষ্টা, সততা বা শেখার আগ্রহের জন্য। তার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় তখনই, যখন সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। এই পরিবেশে বড় হওয়া শিশুটি ভাবে, ভুল করা মানেই সে খারাপ।
তাই পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া, খেলায় হেরে যাওয়া বা অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়া তার কাছে শেখার বিষয় নয়; বরং লজ্জা ও অপমানের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তাকে শেখানো হয়েছে—সে তখনই শুধু মূল্যবান, যখন সে সবার চেয়ে ভালো বা আলাদা হয়। এই পরিবেশ থেকে সাধারণত তৈরি হয়—
• অতিরিক্ত আত্মগৌরব
• সবকিছুকে প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখার মানসিকতা
• অন্যকে ছোট করে দেখার প্রবণতা
• ভঙ্গুর আত্মসম্মান।
আর এভাবেই ধীরে ধীরে একটি শিশু নার্সিসিস্টিক প্রবণতা নিয়ে গড়ে ওঠে।
এই পরিবেশ আগের পরিবেশের ঠিক উল্টো, কিন্তু ফলাফল প্রায় একই। অনেক পরিবারই শাসন ও অনুপ্রেরণার পার্থক্যটাকে গুলিয়ে ফেলে। তারা সন্তানের সাফল্যকে স্বাভাবিক ধরে নেয়, কিন্তু ব্যর্থতাকে বড় করে দেখে। তাদের আদেশ হলো, ভালো ফল করতেই হবে। আর খারাপ ফল করলে বকাঝকা ও তুলনা করা হয়। এই পরিবেশে বড় হওয়া শিশুটি ধীরে ধীরে শিখে ফেলে—তার সাফল্যের কোনো মূল্য নেই। তার অনুভূতিগুলো গুরুত্ব পায় না।তাকে কোনো বিষয়ে প্রশংসা করা হয় না।ভালোবাসা পাওয়া যায় শুধু শর্ত পূরণ করলে।ফলে শিশুটির ভেতরে তৈরি হয় একধরনের গভীর শূন্যতা, যা কেউ দেখে না, কিন্তু সে প্রতিদিন বয়ে বেড়ায়। সে বুঝে যায়, যেমন আছে, তেমন থাকলে তাকে গ্রহণ করা হবে না। তাই বাঁচতে গিয়ে সে গড়ে তোলে এক মিথ্যা সত্তা। এসব সত্তা হলো সব সময় নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা, সব সময় অন্যদের চোখে শ্রেষ্ঠ দেখানোর চেষ্টা ইত্যাদি।বড় হয়ে এই শিশুরাই অনেক সময় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জোর করে প্রমাণ করতে চায়, ভুল হওয়ার ভয় থেকে চরম পারফেকশনিজমে ভোগে, বাইরের স্বীকৃতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে ওঠে, সামান্য সমালোচনাতেও গভীরভাবে আহত হয়। আর ধীরে ধীরে আবেগের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সে ধীরে ধীরে নার্সিসিস্টিক প্রবণতা নিয়ে গড়ে ওঠে।
প্যারেন্টিফায়েড বলতে বোঝায় এমন একটি অবস্থা, যেখানে একটি শিশুকে তার বয়সের আগেই বড়দের ভূমিকা নিতে বাধ্য করা হয়। অনেক পরিবারে কিছু শিশু খুব অল্প বয়সেই আর শিশু থাকে না। সংসারের চাপ, দাম্পত্য অশান্তি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন কিংবা আবেগগত সমস্যা—এসবের ভার পড়ে তার কাঁধে। মা-বাবা নিজেদের দুঃখ ভাগ করেন, রাগ-হতাশা উগরে দেন। তখন শিশুটি হয়ে ওঠে তাঁদের আবেগ সামলানোর আশ্রয়।হঠাৎ করেই শিশুটি বড় হয়ে ওঠে। এই শিশুকে মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে হয়, তাঁদের মন বুঝতে হয়, সংসারে মানিয়ে নিতে হয়। ধীরে ধীরে সে শিখে ফেলে, তার নিজের অনুভূতিগুলো বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয়।
ভালোবাসা পেতে হলে তাকে কাজে লাগতে হবে, প্রয়োজনীয় হতে হবে। শিশু হওয়ার স্বাভাবিক সুযোগ না পেয়ে সে খুব দ্রুতই প্রাপ্তবয়স্কদের মতো প্রতিরক্ষাকৌশল রপ্ত করে ফেলে। বাইরে থেকে তাকে শান্ত, দায়িত্বশীল, ‘ভালো সন্তান’ মনে হলেও ভেতরে–ভেতরে জমতে থাকে অপূর্ণ চাহিদা আর চাপা ক্ষোভ।এই পরিবেশে বড় হওয়া মানুষদের মধ্যে প্রায়ই গোপন নার্সিসিস্টিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে দমিয়ে রাখা চাহিদা, মানিয়ে চলার আড়ালে জমে থাকা গভীর ক্ষোভ। এদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো পরিত্যক্ত হওয়া। কারণ, তারা শিখেছে যে ভালোবাসা নিঃশর্ত নয়। তা অর্জন করতে হয় সেবা দিয়ে, বোঝা বইয়ে। আর এভাবেই তারা ধীরে ধীরে নার্সিসিস্টিক প্রবণতা নিয়ে গড়ে ওঠে।
অনেক পরিবারে সন্তানকে দেখা হয় ‘মিনি-মি’ শিশু হিসেবে। অর্থাৎ শিশুটি ধরা হয় মা-বাবার অপূর্ণ স্বপ্নের ধারক হিসেবে। যেসব স্বপ্ন তাঁরা নিজেরা পূরণ করতে পারেননি, সেসবের ভার নিঃশব্দে এসে পড়ে সন্তানের কাঁধে। ভালো ফল, নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, খেলাধুলায় সাফল্য কিংবা সামাজিকভাবে ‘ভালো পরিবার’-এর নিখুঁত ছবি—এসব প্রত্যাশা মিলিয়ে শিশুটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে পরিবারের সম্মান, গর্ব আর আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
এই পরিবেশে শিশুর নিজের ইচ্ছা, ঝোঁক বা স্বভাবের খুব একটা জায়গা থাকে না। সে দ্রুত শিখে নেয়, স্বাধীনভাবে কিছু ভাবা বা আলাদা কিছু হতে চাওয়া মানেই সমালোচনার মুখে পড়া। তার পরিচয় নির্ধারিত হয় আরোপিত; আর ভালোবাসা পাওয়া যায় কেবল তখনই, যখন সে প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারে। ফলে বড় হতে হতে শিশুটি বিশ্বাস করতে শুরু করে, তার মূল্য নির্ভর করছে সে কতটা ভালোভাবে একটি নির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করতে পারছে, তার ওপর। প্রশংসা না পেলে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, ব্যর্থতা তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়।
এই পরিবেশে বড় হওয়া মানুষেরা প্রায়ই ইমেজ ধরে রাখতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে। কারও সঙ্গে সম্পর্কও গড়ে হিসাব করে। অর্থাৎ কে কী দেবে, কে কীভাবে দেখবে, তার ওপর। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে নার্সিসিস্টিক প্রবণতা নিয়ে গড়ে ওঠে।
সমাজে এখনো ‘ভিন্নভাবে কাজ করা’ বা ‘ভিন্নভাবে শেখা’কে খুব সহজে গ্রহণ করা হয় না। যে শিশু একটু বেশি অস্থির, মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, অতিরিক্ত চিন্তাগ্রস্ত, আবেগে সহজে ভেঙে পড়ে বা পড়াশোনায় অন্যদের মতো দ্রুত এগোতে পারে না, তাকে প্রায়ই একটি কথাই শুনতে হয়—‘এত নাটক কোরো না, স্বাভাবিক হও।
’শিশুটি হয়তো এডিএইচডি, এএসডি, উদ্বেগ, আবেগগত অসামঞ্জস্য বা শেখার ভিন্নতা নিয়ে বড় হচ্ছে। কিন্তু পরিবার ও পরিবেশ যদি সেটাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে কিংবা ‘সময় হলে ঠিক হয়ে যাবে’ বলে এড়িয়ে যায়, তাহলে শিশুটির জন্য প্রতিদিনের জীবন হয়ে ওঠে এক নীরব সংগ্রাম। স্কুলে সে বোঝে না কেন বারবার ভুল হয়, কেন শিক্ষক বিরক্ত হন, কেন সহপাঠীরা দূরে সরে যায়। বাড়িতে সে দেখে, তার কষ্টগুলো গুরুত্ব পায় না।
ধীরে ধীরে শিশুটি নিজের ভেতরে কিছু প্রশ্ন জমিয়ে রাখে—সবাই যেটা সহজে পারে, সেটা আমার কাছে এত কঠিন কেন? কেউ কেন আমাকে বুঝতে চায় না? আমার কি সত্যিই কোনো সমস্যা আছে?এই দীর্ঘদিনের প্রত্যাখ্যান আর লজ্জা শিশুটিকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। বাঁচতে গিয়ে সে নিজের মতো করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। কেউ ‘দুর্বল’ বলার আগেই সে নিজের দুর্বলতা অস্বীকার করে। লজ্জা থেকে বাঁচতে অন্যকে দোষ দেয়, অনুভূতিকে নিস্তেজ করে ফেলে।
কেউ কেউ পড়াশোনা, কাজ বা কোনো এক ধরনের প্রতিভায় অতিরিক্ত সাফল্যের পেছনে ছোটে, যেন বারবার প্রমাণ করতে পারে ‘আমিও কম যাই না’।এই প্রমাণের চাপ থেকেই তারা ধীরে ধীরে নিজের মূল্যকে শুধু সাফল্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শেখে, আর সেখান থেকেই নার্সিসিস্টিক প্রবণতা তৈরি হতে থাকে।
সূত্র: মিডিয়াম