দক্ষিণ গোলার্ধে শীতের শুরুটা এবার যেন একটু বেশিই জানান দিচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বলছিলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ঠান্ডাটা বেশ জেঁকে বসেছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই এর প্রমাণ পেলাম। বাইরের তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে ৯টা বাজতে বাজতে ওয়েস্টার্ন সিডনির এই শহরতলিতে তাপমাত্রা বাড়ল, সঙ্গে জুটল ঝলমলে মিষ্টি রোদ।
শুক্রবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস হলেও ঈদুল আজহার কারণে আমার জন্য ছুটির দিন। শহরের সবাই যখন অফিস ধরার জন্য ছুটছেন; তখন আমি ভাবছি, কী করা যায়। ভাবলাম, এ সুযোগে একটি লংড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি। নিউ সাউথ ওয়েলসের সাউদার্ন হাইল্যান্ডসের ছোট শহরগুলো আমার বরাবরই খুব পছন্দ; পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সব এলাকা। সিদ্ধান্ত নিলাম, ওদিকটায় যাব।
গুগল ম্যাপে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি নাম ‘নিউ সাউথ ওয়েলস রেল মিউজিয়াম’। আমার বাসা থেকে দক্ষিণে পিকটন শহরের প্রান্তে, ৪০ মিনিটের ড্রাইভ। গুগল ম্যাপে লোকেশন সেট করে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ইউটিউবে নজরুল সংগীত চালিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। হাইওয়ে ধরে ১১০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি ছুটছে, আর গাড়িতে বাজছে, ‘বাজাও কি বুনো সুর পাহাড়ি বাঁশিতে? বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী হাসিতে, দূর দ্বীপবাসিনী।’ দুই পাশের পাহাড় আর তার ওপরে গড়ে ওঠা ছোট ছোট শহর শীতের সকালের নরম রোদে ঝলমল করছিল। পিকটনের কাছাকাছি পৌঁছাতেই খেয়াল করলাম, প্রকৃতিতে হেমন্তের রং যেন এখনো লেগে আছে; কমলা আর হলুদ রঙের পাতায় সেজে আছে রাস্তার দুই ধারের ম্যাপলগাছ।
মিউজিয়ামের সামনে যখন পৌঁছালাম, ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। সরকারি ছুটির দিন না হওয়ায় পুরো মিউজিয়ামে দর্শনার্থী আমি একা। মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো কোনো এক জাদুবলে সময়কে যেন পেছনে ফেলে এসেছি। বিশাল শেডের তলে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের আধুনিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম; মনে হলো ১০০ বছর আগে ফিরে গেছি।
পিরিয়ড সিনেমায় শতবর্ষ পুরোনো ট্রেন বা গাড়ি দেখেছেন নিশ্চয়ই। আমিও দেখেছি; কিন্তু এ মুহূর্তে যা দেখছি, তা সিনেমার জন্য বানানো কোনো সেট বা রেপ্লিকা নয়। আমি দাঁড়িয়ে আছি সত্যিকারের ইতিহাসের সামনে; সেসব আসল রেলগাড়ির সামনে, যা একসময় অস্ট্রেলিয়ার শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালনের মতো কাজ করত। এ অনুভূতি একেবারেই অন্য রকম।
আমার ডান দিকে ‘৬০৪০’ লেখা ইঞ্জিনটির ওপর চোখ পড়ল। নিছক একটি যন্ত্র এটি নয়, বরং এর কালো লোহার পর্বতসদৃশ অবয়ব, মানুষের চেয়েও উঁচু চাকা এবং পাইপ ও লিভারের জটিল সমাবেশ আপনাকে শিল্পবিপ্লবের সেই স্বর্ণযুগের শক্তির কথা মনে করিয়ে দেবে। পাশে দাঁড়ালে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এ দানবের পাশেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের সহকর্মী, লোকোমোটিভ ১০২১ ‘কার্ডিফ’। সাদামাটা কিন্তু শক্তিশালী গঠন দেখেই বোঝা যায়, এটি তৈরি হয়েছিল রেলওয়ের সবচেয়ে কঠিন ও পরিশ্রমী কাজগুলো করার জন্য, যাকে ফলকের ভাষায় বলা হয়েছে ‘পাবলিক ওয়ার্কস ডগসবডি’।
শুধু ইঞ্জিন নয়, এই জাদুঘরের প্রতিটি কোণে মিশে আছে মানুষের গল্প। একটি প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখা টকটকে লাল রঙের আনুষ্ঠানিক জ্যাকেট, বিভিন্ন ট্রফি ও পুরস্কার রেলওয়ে কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম আর সাফল্যের স্মারক। আরেকটি প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখা মেটালের শত শত রেলওয়ে পাস ও ব্যাজ। প্রতিটি পাসের আলাদা নম্বর ও নকশা দেখে বোঝা যায়, এর প্রতিটি একেকজন কর্মীর পরিচয় বহন করত, যাঁরা তাঁদের জীবনের বড় একটি অংশ রেলওয়ের সেবায় উৎসর্গ করেছেন।
এরপর পুরোনো একটি যাত্রীবাহী কামরার ভেতরে যখন ঢুকলাম, তখন যেন সত্যিই সময় থমকে গেল। কামরার ভেতর আবছা আলোয় সবুজ চামড়ার সিটগুলোতে হাত বোলাতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, কতশত যাত্রীর স্পর্শেই না জানি এগুলো আজ এমন মসৃণ। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকালে মুহূর্তের জন্য বিভ্রম জাগে, এই বুঝি ট্রেনটা তার পরিচিত ছন্দে কু–উ–উ–ঝিক–ঝিক শব্দ করে চলতে শুরু করবে।