
গতকাল ২৬ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টায় মারা গেছেন কবি, সম্পাদক ও অভিনেতা তারেক মাহমুদ। শাহবাগ, কাঁটাবন ও শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। হঠাৎ কী হয়েছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির? কেন এভাবে চলে গেলেন তিনি?
রাতে বাসায় ফেরার পর স্বভাবতই ফেসবুকে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এটা–ওটা দেখতে দেখতে কখন রাত একটা বেজে গেল, খেয়াল করিনি। এরই মধ্যে বন্ধু শুভ একটি স্ক্রিনশট পাঠাল। তারেক ভাইয়ের ছবি পোস্ট করে একজন লিখেছেন, ‘বন্ধু, সহকর্মী, অভিনেতা, নির্মাতা ও কবি তারেক মাহমুদ আর নেই।’ দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেলাম। এটা হতে পারে না, দিব্যি সুস্থ একটা মানুষ! হয়তো কেউ মজা করছে। আবার এমন বিষয় নিয়ে কে-ই বা মজা করতে পারে? তারেক ভাইকেই ফোন করলাম। ওয়েটিং, কল ধরলেন না। মনে হলো—নাহ, কেউ ফাজলামো করেছে। মনে হলো, সবাই খবর পেয়ে ওনাকে ফোন করছে আর তিনি হয়তো ফোন রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন। সাধু ভাইয়ের (হুমায়ুন সাধু) সঙ্গেও এমন হয়েছিল একবার; ফেসবুকে ছড়াল যে হুমায়ুন সাধু মারা গেছেন। এরপর তাঁরও এ রকম ফোন রিসিভ করতে করতে পাগল হওয়ার অবস্থা হয়েছিল।
তবে এবার আমার ভাবনার গতি রোধ করেই কল ব্যাক করলেন তারেক ভাই। কিন্তু ‘হ্যালো’ বলতেই যিনি কথা বললেন, তাঁর কণ্ঠ অপরিচিত, আমার স্বর নেমে এল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাইয়া, তারেক ভাই…।’ তিনি বললেন, ‘তারেক ভাই একটু আগে মারা গেছেন।’ জানালেন, হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। এখন আছেন মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে। শুভকে খবরটা নিশ্চিত করে পরিচিত আরও কয়েকজনকে ফোন করে জানালাম। তারেক ভাই একা থাকতেন জানতাম। আজ তিনি নেই, ভাবতেই কেমন যেন লাগল। বাসায় আর বসে থাকা গেল না।
এ সময় তাঁর কাজ ও উপার্জনের অবস্থা এমন হয়েছিল যে কারও সঙ্গে দেখা করে বা মুখে কাজ চেয়ে কাজ হচ্ছে না বলে ফেসবুকেই স্ট্যাটাস দিয়ে খুব করুণ আকুতি জানান, তাঁর কাজের খুব প্রয়োজন, কেউ যেন তাঁকে কাজ দেন—এই মর্মে।
হাসপাতালে গিয়েই বাকিটা শুনলাম। ফোনে যিনি আমাকে কল ব্যাক করেছিলেন, তিনি ওনার ছোট ভাই। আর নিয়মিত চিকিৎসার কারণে ওনার বাবাও এরই মধ্যে ঢাকায় এসেছিলেন। শুনলাম, কয়েক দিন ধরে তারেক ভাই বুকের ব্যথায় ভুগছিলেন। তার মধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কাঁটাবনে আড্ডা দিয়ে রাত ১০টার দিকে বাসায় ফেরেন। এর একটু পরই বুকের ব্যথা উঠলে তিনি ভাইকে জানান, শরীর খারাপ লাগছে, তাই শুয়ে পড়ছেন। তারপর ছোট ভাই আর কথা বলতে পারলেন না। আরেকজন বললেন, সাড়ে ১১টায় চিকিৎসক তাঁকে দেখেন এবং জানান যে ঘণ্টাখানেক আগেই তিনি মারা গেছেন।
তারেক মাহমুদ—শাহবাগ এলাকার আড্ডায় বা কাজের সূত্রে যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁদের কাছে তিনি ‘তারেক ভাই’। ২০০৬-০৭ সালের দিকে শাহবাগে মারজুক (মারজুক রাসেল) ভাইয়ের আড্ডায় যাতায়াত শুরু করার মাধ্যমেই কবি-সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অন্যান্য শিল্পাঙ্গনের মানুষজনের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ হয়। সে সময়ই কোনো একদিন তারেক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তখন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বিভিন্ন টিভি নাটক ও ধারাবাহিকে অভিনয় করে বেশ পরিচিত মুখ। সে সূত্রে আমিও প্রথম তাঁকে অভিনেতা হিসেবেই চিনেছিলাম। তবে তাঁর কবি সত্তার পরিচয় পেতেও বেশি সময় লাগেনি। চলচ্চিত্র নির্মাণবিষয়ক তাঁর দুটি বইও প্রকাশ পায় সে সময়। তারেক ভাই সম্পাদিত ‘পথিক’ নামের ছোটকাগজটি বোধ হয় তখন বন্ধ ছিল, সে সময় চোখে পড়েনি। চলচ্চিত্রের দিকেই ঝুঁকে ছিলেন তখন থেকে। এরপর প্রায়ই শাহবাগ, আজিজ সুপার মার্কেট, পরিবাগে চাচির চা–দোকানে দেখা, ছোট ছোট কথা, ভাব বিনিময়, আড্ডা, রসিকতা—এভাবেই একটা দীর্ঘ সময় চলে গেল।
একসময় কবিতা ও সিনেমা নিয়ে থাকবেন বলে নিজের সিদ্ধান্তে এমন জীবন বেছে নিলেও গতকাল রাতে তিনি পারিবারিক সিদ্ধান্তে জন্মস্থান পাবনায় যাবেন বলে অপেক্ষা করছিলেন। হাসপাতালে তাঁর বাবা, ছোট ভাই ও একমাত্র ছেলে, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মীসহ কয়েকজনই ছিলেন উপস্থিত। আরও কয়েকজন এলেন এরই মধ্যে। একজন বাদ সাধলেন, ‘শাহবাগ এলাকায় তিনি বড় হয়েছেন, ডিরেক্টর গিল্ড ও অভিনয় শিল্পী সমিতির সদস্য তিনি, তাঁকে শাহবাগে শেষ শ্রদ্ধাটা দিতে চাই। যে করেই হোক, কাল (আজ শুক্রবার) দুপুর পর্যন্ত ঢাকায় রাখতে হবে তাঁকে।’ জানা গেল, অ্যাম্বুলেন্সের এসিতে মৃতের শরীর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না, এ জন্য প্রয়োজন লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি। তাতে খরচ অনেক, সেটা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না।
তারেক ভাইয়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই আমার। বেশ কয়েক বছর আগে কচি ভাইয়ের (কচি খন্দকার) একটা ধারাবাহিকে আমি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় তিনি তাতে অভিনয় করেন। আর মাস কয়েক আগে একটা সিনেমার শুটিংয়ের পর অভিনয়ের জন্য ওনাকে ডাকা হয়নি বলে প্রযোজক এফ এম শাহীনকে বেশ অভিমানের সুরেই বলেছিলেন, ‘আমাকে তোর সিনেমায় নিলি না!’ সঙ্গে সঙ্গেই শাহীন ভাই বলেন, ‘সরি ভাই, সুযোগ ছিল না। তবে আপনি যদি ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে দু-একটা চরিত্রের ডাবিংটা করে দেন, তাহলে খুব উপকার হয়।’ তারেক ভাই সম্মতি দিয়ে আমাকে বললেন, ‘ওই, স্টুডিওর ডেট কবে জানাইস।’ আসলে শাহীন ভাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল, একটা কাজের ছুতোয় ওনার হাতে কিছু টাকা দেওয়া। এ সময় তাঁর কাজ ও উপার্জনের অবস্থা এমন হয়েছিল যে কারও সঙ্গে দেখা করে বা মুখে কাজ চেয়ে কাজ হচ্ছে না বলে ফেসবুকেই স্ট্যাটাস দিয়ে খুব করুণ আকুতি জানান, তাঁর কাজের খুব প্রয়োজন, কেউ যেন তাঁকে কাজ দেন—এই মর্মে।
সেদিন ডাবিং শেষ করে দুই হাজার টাকা তাঁর হাতে দিয়ে একসঙ্গেই বের হলাম স্টুডিও থেকে। ‘কোথায় যাবি?’ জিজ্ঞেস করলে বলেছিলাম, ‘এখন আর কাজ নেই ভাই, দেখি শাহবাগের দিকেই যাই।’ বললেন, ‘চল তাইলে আমার সঙ্গে, আগে এফডিসিতে যাই।’ রিকশায় ওঠার আগে নিকেতনের ৪ নম্বর গেটে চা খেতে গেলাম। এক কাপ চা ১৫ টাকা শোনার পর দুইজনে এক কাপ ভাগাভাগি করে খেলাম। তারপর রিকশায় উঠে প্রথমে ব্যাগ থেকে ‘পথিক’ বের করলেন একটা। ‘পত্রিকাটা আবার শুরু করেছি বুঝছিস, একটা রাখ,’ বলে আমাকে দিলেন পত্রিকাটা। হাতে নিয়ে আমি নিজের ব্যাগে ভরলাম। তারপর বললেন, ‘চটপটি’ নামে যে সিনেমা বানানো শুরু করেছিলেন, সেটা তাঁর কীভাবে ক্ষতি করেছে। বললেন, ‘সিনেমা বানাইতে গেলাম বলে কেউ আমাকে এখন আর অভিনয়ে ডাকে না, বুঝলি! সবাই ভাবে, সে তো এখন ডিরেক্টর, সে কি অভিনয় করবে? ডিরেকশন দিলে কি মানুষ অভিনয় ভুলে যায়? কয়টা কাজই বা করলাম যে এটা মনে করবে, আমি নিজের কাজেই অনেক ব্যস্ত! না সিনেমাটা শেষ করতে পারলাম, না অভিনয়ের বাজারটা পেলাম! কাজের এমন সংকট হলে বাঁচব কী করে?’ অভিমানের সুর তারেক ভাইয়ের বেশিক্ষণ থাকে না। যত যা–ই হোক, মুখে হাসি ফিরে আসতে তাঁর সময় লাগে না। রিকশা পৌঁছে গেল এফডিসির অস্থায়ী ফটকে।
নেমে ভেতরে গেলাম, হাঁটলাম। প্রায় ফাঁকা। পরিচালক সমিতির অফিসে যাওয়ার পর ভাইয়ের ব্যস্ততা দেখে সেখানে তাঁর দীর্ঘ সময় লাগবে ভেবে বিদায় নিলাম। এরপর এক সন্ধ্যায় কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে দেখা। কচি ভাই, টোকন ভাই (টোকন ঠাকুর), শাহীন ভাইসহ অনেকেই আছেন। এসেই তারেক ভাই ব্যাগ থেকে ‘পথিক’ বের করে দিলেন দুই-তিনজনকে। জানালেন, এটা দ্বিতীয় সংখ্যা, মানে নতুন করে শুরু করার পর দ্বিতীয়। বুঝলাম, পত্রিকা ছাপিয়ে নিজেই ব্যাগে বয়ে বয়ে বিক্রি করছেন। দ্বিতীয় কপিটি নিতে পারিনি। সেদিনই তারেক ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তারপর আজ শুধু তাঁকেই দেখছি। তিনি কি দেখছেন বা কিছু দেখতে পাচ্ছেন? জানি না।
রাত প্রায় দুইটা বাজে। অ্যাম্বুলেন্সে এসি ছেড়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন তারেক ভাই। একসময় কবিতা ও সিনেমা নিয়ে থাকবেন বলে নিজের সিদ্ধান্তে এমন জীবন বেছে নিলেও গতকাল রাতে তিনি পারিবারিক সিদ্ধান্তে জন্মস্থান পাবনায় যাবেন বলে অপেক্ষা করছিলেন। হাসপাতালে তাঁর বাবা, ছোট ভাই ও একমাত্র ছেলে, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মীসহ কয়েকজনই ছিলেন উপস্থিত। আরও কয়েকজন এলেন এরই মধ্যে। একজন বাদ সাধলেন, ‘শাহবাগ এলাকায় তিনি বড় হয়েছেন, ডিরেক্টর গিল্ড ও অভিনয় শিল্পী সমিতির সদস্য তিনি, তাঁকে শাহবাগে শেষ শ্রদ্ধাটা দিতে চাই। যে করেই হোক, কাল (আজ শুক্রবার) দুপুর পর্যন্ত ঢাকায় রাখতে হবে তাঁকে।’ জানা গেল, অ্যাম্বুলেন্সের এসিতে মৃতের শরীর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না, এ জন্য প্রয়োজন লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি। তাতে খরচ অনেক, সেটা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ আর দ্বিতীয় কথাটি বলতে পারেননি, চুপ থাকতে বাধ্য হলেন সবাই।
অ্যাম্বুলেন্সের চালক ইঞ্জিন চেক দিচ্ছেন, এবার রওনা দেবেন। আমরা হাসপাতালের দরজা থেকে রাস্তামুখী হলাম, যার যার মতো বিদায় নিলাম। তারেক ভাই চলে গেলেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে শৈশবের জল-হাওয়া-মাটির কাছে। কাল রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ল ২৬ অক্টোবর সকালের কথা, ৫ অক্টোবরের কথা। আশ্চর্য হলাম। ৫ তারিখ সকালে এ বাংলা থেকে চলে গেলেন কবি আসাদ চৌধুরী আর ওই দিন বিকেলেই ওপার বাংলা থেকে চলে গেলেন হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের অন্যতম কবি দেবী রায়। গতকাল সকালেই আবার পশ্চিম বাংলা থেকে চলে গেলেন হাংরি জেনারেশন আন্দোলনেরই জনক কবি মলয় রায়চৌধুরী। আর রাতে—রাত সাড়ে ১০টায় চলে গেলেন এ বাংলার কবি তারেক মাহমুদ। আমাদের গ্রামে হলে বলত—দুই বাংলার কবিরা সমঝোতা করে একজন আরেকজনকে ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা বোধ হয় (দুই) বাংলাবিষয়ক কোনো বৈঠকে বসবেন অনন্তলোকে!