
জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জীবন উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জি এইচ হাবীব -এর নিয়মিত পাক্ষিক— মৃদুল মধুর সন্তরণ
‘একজন ইউরোপীয়কে হত্যা করার মানে হচ্ছে এক ঢিলে দুই পাখি মারা।’ ফ্রান্স যখন সাত বছর ধরে বর্বরোচিতভাবে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে লিপ্ত, সেই সময় জাঁ পল সার্ত্রে এই কথাগুলো লিখেছিলেন। শত হলেও, এ ধরনের হত্যা একই সঙ্গে অত্যাচারী আর অত্যাচারিত, দুই পক্ষকেই নিকেশ করে দেয়: একজন মারা যায়, আর অন্যজন মুক্তি অর্জন করে। আলজেরিয়ার উপনিবেশবিরোধীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য ফ্রান্সে প্রবলভাবে ঘৃণিত সার্ত্রে মানুষকে ‘আমাদের মানবতাবাদের স্ট্রিপটিজ নাচ’ দেখতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আপনারা যাঁরা এত উদার, এত মানবিক, যাঁরা সংস্কৃতিপ্রেমকে ভড়ংয়ের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পছন্দ করেন, সেই আপনারা এটা ভুলে যাওয়ার ভান করেন যে আপনাদের উপনিবেশগুলোতে আপনাদের নামেই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।’
অগ্নিবর্ষী এই কথাগুলো সার্ত্রে লিখেছিলেন একটি বইয়ের ভূমিকায়। তাঁর নিজের বই নয়। ফ্রানৎস ফানোঁ নামের এক ফরাসি ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রাজনৈতিক দার্শনিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। উপনিবেশবিরোধী ওই বইটির নাম (কন্সটান্স ফারিংটন ও রিচার্ড ফিলকক্সের স্বতন্ত্র ইংরেজি অনুবাদে) ‘দ্য রেচিড অব দ্য আর্থ’। বইটির লেখক বছর কয়েক আলজেরিয়া কাটিয়েছিলেন দেশটার মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করে। আর বইটি যখন প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, স্বল্প পরিচিত সেই লেখক তখন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু। বয়স ছত্রিশ।
সার্ত্রের প্রবাদপ্রমিত খ্যাতি ফানোঁর বইটিকে আলোচনার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে; তবে সেই সঙ্গে, গোড়ার দিকে, পাশ্চাত্যে সেটার গ্রহণযোগ্যতাকেও খানিকটা বিঘ্নসংকুল করে তোলে। বইটি প্রকাশের ষাটতম বার্ষিকী উপলক্ষে গ্রোভ প্রকাশনা সংস্থা সেটার একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে। এবার সেটার ভূমিকা রচনা করেন কর্নেল ওয়েস্ট; আগে, অন্য একটি সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক হোমি কে ভাবা। গ্রোভের এই সংস্করণে সেটাও যুক্ত হয়। রচনাটি এবার বি-উপনিবেশীকরণের আশ্চর্য এক দ্বিমুখী বিবরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
হানা আরেন্ট তাঁর ‘সহিংসতা প্রসঙ্গে’ (১৯৭০) শীর্ষক দীর্ঘ রচনায় বিশদভাবে সার্ত্রের ভূমিকাটির সমালোচনা করলেও, মোটের ওপর ফানোঁর রচনাটি এড়িয়েই গেছেন; বিশেষ করে টেক্সটিতে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের অধঃগতি আর আলজেরিয়ার মানসিক সমস্যাগ্রস্ত রোগীদের নিয়ে লেখা কেস নোটগুলোর কথা। অন্য এক লেখক ১৯৬৬ সালে দাবি করেন ‘সহিংসতার পক্ষে’ ফানোঁর যুক্তিগুলো ‘আমেরিকার বস্তিতে বসবাসরত তরুণ নিগ্রোদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।’ টাইমস পত্রিকার জনৈক লেখক তরুণ র্যাডিক্যাল নিগ্রো নেতাদের ওপর সেসব কথার প্রভাব নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
আর সত্যি বলতে কি, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও গ্লোবাল প্যান-আফ্রিকান আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রাখা অ্যাকটিভিস্ট স্টোকলি কারমাইকেল (১৯৪১-১৯৯৮) ফানোঁকে তাঁর মেন্টর হিসেবে মানতেন। তা ছাড়া ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত মার্ক্স-লেনিনবাদী রাজনৈতিক সংগঠন ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি ‘দ্য রেচিড অব দ্য আর্থ’ পাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করত। মার্টিন লুথার জুনিয়রের দাবি অনুযায়ী, ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্টের সদস্যদের কাছে বইটি ছিল বাইবেলের মতো। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবীরা প্রায়ই ফানোঁর লেখাপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। তা ছাড়া পাওলো ফ্রেইরির ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড’-ও এই ফরাসি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দার্শনিকের কাছে ঋণী।
এবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।
১৯৫৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ঘটনাস্থল আলজিয়ার্সের মিল্ক বার নামের একটি ক্যাফে বা আইসক্রিম পারলার। পরিপাটি করে আকর্ষণীয়ভাবে চুল বেঁধে আর কেতাদুরস্ত ল্যাভেন্ডার রঙের পোশাক পরে ২১ বছর বয়সী আইনের ছাত্রী জোহরা দ্রিফ সেদিন একটা পিচ-মেলবা আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে তাঁর বিচ ব্যাগটা কাউন্টারে ঠেস দিয়ে রেখেছিলেন। দাম চুকিয়ে, বকশিশ দিয়ে তিনি বার থেকে বেরিয়ে আসেন, ব্যাগটা না নিয়েই। একটু পরেই বিস্ফোরিত হয় সেটার ভেতরে থাকা বোমাটা। তিনজন তরুণী নারী নিহত হয়। এবং কয়েক মিনিট পর অন্য এক ক্যাফেতে আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। দুটি ঘটনায় শিশুসহ মোট ১২ জন আহত হয়।
ঘটনাটির কথা জোহরা দ্রিফের পক্ষে কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সেদিনের মিল্ক বারটির ছবি তাঁর মনে যেন চিরভাস্বর হয়ে আছে: সাদা, উজ্জ্বল এবং তারুণ্যের কলহাস্য, ‘প্যাস্ট্রির সুগন্ধ, এমনকি পাখির দূরাগত কিচিরমিচিরে ভরা।’ অর্ধশতাব্দী পরে পেছনে তাকিয়ে জোহরা দ্রিফ মিল্ক বারের ঘটনার জন্য তেমন কোনো অনুতাপ বোধ করেন না। তাঁর দৃষ্টিতে, সে সময়ে যেসব ইউরোপীয় সেই ক্যাফেতে ছিলেন, তাঁরা মোটেই নিরীহ বেসামরিক মানুষ ছিলেন না; বরং তাঁরা ছিলেন উপনিবেশস্থাপনকারী। আলজিয়ার্সের পুরোনো শহর বা কাসবাহ-তে—দ্রিফের ভাষায় যেটা ছিল এক ‘উন্মুক্ত কারাগার’—কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে রাখা তিনি নিজেসহ ৮০ হাজার মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গি আর সেই ইউরোপীয়দের ‘ন্যক্কারজনক নিশ্চিন্ত মনোভাব’ একটি বেদনাদায়ক বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি করত। মিল্ক বারের ঘটনার মাসখানেক আগে, ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা কাসবাহর একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বোমা হামলা চালিয়ে ৮০ জন মানুষ হত্যা করেছিল।
আলজেরিয়া তখন প্রায় দুবছর ধরে একটি স্বাধীনতাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, আর ফরাসিরাও ব্যাপক দমন-পীড়ন ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রচণ্ডভাবে পাল্টা জবাব দিচ্ছে। তবে দ্রিফ মনে করেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের সেই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটাই যুদ্ধটার মোড় ফিরিয়ে দেয়। তবে এমনকি যে কমিউনিস্ট মানুষটি ‘বিদ্রোহীদের বিস্ফোরক গবেষণাগার’ তৈরি করেছিলেন, তিনিও জনসমাগমপূর্ণ উন্মুক্ত স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবার ব্যাপারে অনীহ ছিলেন। আর আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ফরাসি লেখক ও দার্শনিক আলবেয়ার কামু আলজেরীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও আর তাদের প্রতি তাঁর সমর্থন বজায় রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, তাদের আক্রমণে তাঁর মা-ও মারা যেতে পারতেন, যদিও তা ঘটেনি। তিনি বললেন, ‘ওটা যদি ন্যায়বিচার হয় তাহলে আমি বরং আমার মায়ের পাশেই দাঁড়াব।’
বলা যেতে পারে, মাত্র একজন ফরাসি লেখকই এই বোমা হামলার পক্ষে ছিলেন: মার্টিনিকান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফ্রানৎস ফানোঁ। আলজিয়ার্সের কাছেই এক হাসপাতাল চালাতেন তিনি। তাঁর মতে, বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা আসলে ফ্রান্সের হাতে আলজেরিয়াবাসীদের পদ্ধতিগত বিমানবীকরণের ‘যৌক্তিক পরিণতি’। ফানোঁ তত দিনে গোপনে বিদ্রেহীদের সাহায্য করছেন, তবে মিল্ক বারে বোমাবর্ষণের ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। কর্তৃপক্ষ তাঁর হাসপাতাল ঘেরাও করে, একজন সহকর্মীকে হত্যা করে ক্ষতবিক্ষত দেহটি শুয়োরের খোঁয়াড়ে নিক্ষেপ করে, যাতে জন্তুগুলো সেটাকে সাবাড় করে ফেলতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, লোকটি কোনোমতে বেঁচে যান।
কিন্তু এত সব করেও ফানোঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন—তাঁর জীবনীকার ‘ফ্রানৎস ফানোঁ: অ্যা লাইফ’-এর লেখক ডেভিড মেসি বলছেন—তৃতীয় বিশ্ববাদিতা বা থার্ড ওয়ার্লডিজম-এর সবচেয়ে বিখ্যাত মুখপাত্র এবং উপনিবেশবিদ্বেষী সহিংসতার একজন জোরালো সমর্থক। ফানোঁ দৃপ্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘বর্তমানে আলজেরিয়ায় থাকা প্রত্যেক ফরাসি নাগরিক আসলে একেকজন শত্রুসৈন্য।’ ফরাসিদের হত্যা করা যে কেবল কৌশলগতভাবেই প্রয়োজন তা নয়, সেটা রোগ নিরাময়কারীও বটে। তাঁর দৃষ্টিতে, সহিংসতা একটা ‘শুদ্ধকারী শক্তি’, ‘যা উপনিবেশিতের হীনম্মন্যতা দূর করে।’
মিল্ক বারে বোমা বিস্ফোরণের এক মাস পর, ব্রিটেন আর ইসরায়েলের সঙ্গে জোট বেঁধে ফ্রান্স মিসর আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য, মিসরকে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করা (উল্লেখ্য, মিসর ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেছিল)। কিন্তু ফানোঁ লিখছেন, মিসরে আগ্রাসন চালাবার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহীদের সাহায্যকারী মিসরের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে ‘আলজেরীয় বিপ্লবকে আঘাত করা।’ কিন্তু দুই দিক থেকেই সেটা ছিল এক হাস্যকর পরাজয়। যুক্তরাষ্ট্র হামলাকারীদের হটিয়ে দিলে এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য তা বড়ই অবমাননাকর হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেনের তো নার্ভাস ব্রেকডাউনই হয়ে গেল। তিনি জ্যামাইকায় গিয়ে মুখ লুকালেন তাঁর বন্ধু, জেমস বন্ডের স্রষ্টা আয়ান ফ্লেমিংয়ের এস্টেট ‘গোল্ডেনআই’-এ। উল্লেখ্য, এখানে বসেই ইয়েন ফ্লেমিং সব কটি বন্ড উপন্যাস (সাকল্যে ১২টি) আর বন্ডকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখানো দুটি গল্প সংকলন রচনা করেছিলেন।
এদিকে আরেক ক্যারিবীয় দ্বীপ ও ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকের রাজধানী ফোর্ট দে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী ফ্রানৎস ওমর ফাঁনো ছিলেন কাস্টমস ইন্সপেক্টর বাবা ফিলিক্স কাসিমির ও দোকানদার মা এলেনোরে ফেলিসিয়া মেদেলিচির চার পুত্রসন্তানের মধ্যে তৃতীয়। গোড়ার দিকে তিনি বলতেন, ‘যদি মার্তিনিক ফরাসি হয় তাহলে আমিও তাই।’ দুর্দান্ত ফরাসি লিখতেন ফানোঁ। তবে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আফ্রিকি ও জর্মন—দুই-ই। ফ্রানৎস-টা দৃশ্যত জর্মন উত্তরাধিকারেরই চিহ্ন। দুরন্ত শিশু ফানোঁ ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন এবং কৈশোরের গোড়ার দিক থেকেই বইয়ের পোকা হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স নতি স্বীকার করলেও ফানোঁ মনোবল হারালেন না। ১৯৪৩ সালে, তিনি মার্তিনিক ছেড়ে গোপনে সমুদ্রপথে ডমিনিকায় পাড়ি জমালেন, চার্লস দ্য গলের ‘ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্সেস’-এ যোগ দেওয়ার জন্য। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইউরোপ তিনি একটা মেডাল আর গোলার ক্ষত অর্জন করলেন। কিন্তু তারচেয়ে বড় ক্ষতটা সৃষ্টি হলো ফানোঁর মনে। এই প্রথমবারের মতো তিনি দেখলেন তাঁর মতো একজন কালো মানুষকে ইউরোপীয়রা কী রকম অবজ্ঞার চোখে দেখে, অথচ এদেরই মুক্ত করতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি। তাঁর বড় ভাই জবি স্মৃতিচারণা করে বলছেন, ‘ফানোঁ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।’
যুদ্ধের পর ফানোঁ যখন ইউরোপে ফিরে গেলেন, তখন তিনি আরও বেশি চিন্তাশীল, যদিও অপেক্ষাকৃত কম সংযত। লিখলেন দুই অ্যাবসার্ডিস্ট নাটক ‘সমান্তরাল দুই হাত’ ও ‘ডুবন্ত চোখ’। এরপর দন্ত চিকিৎসাবিদ্যায় কিছুদিন সময় ব্যয় করে, ফানোঁ শেষ অবধি মনোরোগবিদ্যায় মন দিলেন।
তবে তিনি নাটক লেখায় ক্ষান্ত দেননি। তাঁর তাত্ত্বিক রচনাগুলোয় আমরা বিভিন্ন সামাজিক টাইপের দেখা পাই—ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, উপনিবেশ স্থাপনকারী, উপনিবেশিত বুদ্ধিজীবী—যেন তারা তাঁর নাটকের এক একটি চরিত্র। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, অ্যালফ্রেড অ্যাডলারের ‘ইন্ডিভিজুয়াল সাইকোলজি’ দিয়ে উপনিবেশিতকে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ, সাম্রাজ্যবাদের অধীনে পুরো একটি জনগোষ্ঠীই বাতিকগ্রস্ত বা স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে, আর উপনিবেশ স্থাপনকারীরা অ্যাডলার কথিত সেই ‘বড় ভাই’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে—যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে পরিবারে কোনো অনুজ হীনম্মন্যতার বোধে আক্রান্ত হতে পারে বলে অ্যাডলার মনে করতেন। উল্লেখ্য, অ্যাডলারের ‘ইন্ডিভিজুয়াল সাইকোলজি’ তত্ত্ব বলে, ব্যক্তি সামাজিক সংযোগ ও আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একটি আদি তাগিদ দ্বারা তাড়িত হয়, যে তাগিদ আসলে প্রায়ই তার হীনম্মন্যতাবোধের প্রতিক্রিয়া।
অ্যাডলার মনে করতেন, মানুষ সহজাতভাবেই সামাজিক জীব এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রবলভাবে নির্ভর করে বা প্রভাবিত হয় সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সমাজে কোনো অবদান রাখার ইচ্ছা দ্বারা। অ্যাডলার বলেন, ‘ইন্ডিভিজুয়াল সাইকোলজি’ কথাটা কেবল কোনো সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে নয়, বরং একটি অবিভাজ্য সত্তা হিসেবে একজন রোগীর বেলাতেও প্রযোজ্য। একজন মনোরোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার সামাজিক যোগাযোগসহ তার গোটা প্রতিবেশটার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। এবং মার্তিনিকে তাঁকে যে ফরাসি সবকিছুর প্রতি অনুরক্ত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে ফানোঁ সাম্রাজ্যের কারণে সৃষ্টি হওয়া নিজের হীনম্মন্যতাটিকে শনাক্ত করতে পারলেন।
তিনি যখন একটি কাজের দায়িত্বভার নিয়ে ১৯৫৩ সালে আলজেরিয়ায় গেলেন, তখন আরও খারাপ ব্যাপারস্যাপার তাঁর নজরে এল। উল্লেখ্য, দেশটি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগে ফানোঁ প্রায় তিন বছরের মতো আলজেরিয়ায় ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে আলজেরিয়া সহিংসতার শিকার হয়ে ভয়ংকরভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, বিশেষ করে ১৯৪৫ সালে, যখন জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে একটি সংঘর্ষের পর ফরাসিরা বেশ কয়েক হাজার আলজেরীয়কে হত্যা করে। মার্তিনিকে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৫৪ সালে জাতীয়তাবাদীরা আলজেরিয়ার স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করল। ফানোঁর রোগীদের মধ্যে নানা ধরনের মানুষজন ছিল: কোনো গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি, একজন নির্যাতনকারী পুলিশ এবং দুজন মুসলমান যুবক, যারা তাদের ইউরোপীয় বন্ধুকে হত্যা করেছিল।
ব্যক্তির মর্মাঘাতের (trauma) চিকিৎসা না হয় পেশাগত দক্ষতা ও নির্লিপ্ততার সঙ্গে করা গেল, কিন্তু একটি সমাজের বেলায়? ফানোঁ মনে করতেন, আলজেরিয়ার যে নিউরোসিস বা মনোবৈকল্য তার নিরাময় হতে পারে সাম্রাজ্যকে অমান্য করার মাধ্যমে। ফানোঁ বলছেন, ‘সহিংসতার মধ্যে এবং মাধ্যমে উপনিবেশিত মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে পারে।’ ফানোঁর সাম্প্রতিক এক জীবনীকার অ্যাডাম শাটজ তাঁর ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্য র্যাবেল’স ক্লিনিক: দ্য রেভুলুশনারি লিভস অব ফ্রানৎস ফানোঁ’ গ্রন্থে এই বলছেন, ফানোঁর কাছে সহিংসতা ছিল মুক্তির সোপানের একটি ধাপমাত্র। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। ফানোঁ জোর দিয়ে বলছেন, প্রভুর দেওয়া ছাড়ের প্রয়োজন উপনিবেশিতর দরকার নেই; বরং দরকার ‘পুরোপুরি আক্ষরিক অর্থেই, তার প্রভুর মরণ।’
অ্যাডাম শাটজের লেখা ফানোঁর জীবনীগ্রন্থটি ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার বিবেচনায় ২০২৪ সালের অন্যতম সেরা বই নির্বাচিত হয়েছিল। বইটিতে জীবনীকার প্রধানত ফানোঁর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হলেও তাঁর নানা সীমাবদ্ধতার কথাও ‘নৈর্ব্যক্তিক’ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। শাটজ বলছেন, ১৯৫২ সালে প্রকাশিত ফানোঁর প্রথম বই (চার্লস ল্যাম মার্কম্যানের ইংরেজি অনুবাদে) ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’-এ সেই সব কালো মানুষের সমালোচনা করা হয়েছে, যারা শ্বেতাঙ্গ স্ত্রী কামনা করে, যদিও ফানোঁর নিজের প্রধান পার্টনারেরা শ্বেতাঙ্গই ছিল। সাত বছর পরে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ (হাকন শেভেলারের হাতে ইংরেজি অনূদিত হয়েছে) ‘অ্যা ডাইয়িং কলোনিয়ালিজম’ ছিল একজন আগন্তুকের দৃষ্টি দিয়ে আলজেরীয় জাতীয়তাবাদকে ভেতর থেকে দেখা, এমন একজন আগন্তুক যিনি আরবি বা বারবার কোনো ভাষাই জানেন না। আর তাঁর তৃতীয় বই, ১৯৬১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য রেচিড অব দ্য আর্থ’-এ লেখক স্থানীয় অধিবাসীদের বসতি স্থাপনকারীদের ওপর আক্রমণ চালানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, যদিও আলজেরিয়াতে ফানোঁকে সেই দলেরই একজন বলে বৃহত্তর অর্থে গণ্য করা যায় বলে শাটজ একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
ফানোঁ নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু তার বদলে তিনি তাঁর মনোরোগ হাসপাতালে গোপনে বিদ্রোহীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মাধ্যমে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করতে থাকেন। কর্তৃপক্ষ তার কর্মকাণ্ডের আঁচ পেতে শুরু করলে তিনি পার্শ্ববর্তী তিউনিসিয়াতে চলে যান। সেখানে তিনি যোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া অব্যাহত রাখেন এবং লেখালেখি চালিয়ে যান। শাটজ লিখছেন, ফানোঁ কখনোই বিদ্রোহের হাল ধরার মতো অবস্থানে না থাকলেও জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের কাছে তাঁর এতটাই গুরুত্ব ছিল যে তাঁকে একজন দেহরক্ষী, একটি ছদ্মনাম ও একটি ভুয়া পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয়। তার প্রধান কাজ ছিল এফএলএনের কর্মকাণ্ডের কথা বাইরের লোকজনকে বিশদভাবে বুঝিয়ে বলা। সে জন্য অবশ্য তাকে কখনো কখনো সত্য অস্বীকারের মতো অপ্রীতিকর কাজও করতে হয়েছে: দলটি যখন যখন শত শত আলজেরীয়কে হত্যা করেছে, যারা তাদের বিরোধিতাকারী অন্য জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, ফানোঁকে বলতে হয়েছে বিপ্লবীরা কখনো এমন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে না; দুষ্কর্মটা নিশ্চয়ই ফরাসিরাই করেছে।
আলজেরিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে ফানোঁকে বিভিন্ন সময়ে একজন গুপ্তচরের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে হয়েছে, যেন ইয়েন ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড, যদিও দুজনের লক্ষ্য মোটেই এক নয়। মরক্কোর সীমান্তে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য ১৯৫৯ সালে তিনি রোমে গিয়েছিলেন। সেখানে, তাঁকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার জন্য যে গাড়িটি ঠিক করা ছিল, সেটার নিচে পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়। কাজটা ফরাসি সন্ত্রাসীদের বলে শাটজ ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবারও হামলা হতে পারে মনে করে ফানোঁ তাঁর হাসপাতালের কক্ষ বদলে ফেলেন। দেখা গেল, একটু পর, একজন বন্দুকধারী আগের কক্ষটিতে হামলা চালিয়েছে।
পরের বছর ফানোঁ এক আন্ডারকাভার কমান্ডোর সঙ্গে যোগ দেন, উদ্দেশ্য, সাহারা থেকে আলজেরিয়া অবধি একটি রুট তৈরি করা। সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত স্বাধীন দেশগুলো আর তখনো পরাধীন আলজেরিয়ার মধ্যে ভালো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলে, তিনি আশা করেছিলেন, চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র জোগাড় করে বিশাল মরুভূমির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী পাঠাতে পারবেন, যাতে করে ‘একটি মহাদেশেকে ঔপনিবেশিক শক্তির শেষ দুর্গপ্রাচীরের গায়ে ছুড়ে মারা যায়।’
তবে আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ সহিংসতা ছাড়াই স্বাধীনতা লাভ করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদের উত্থানের মুখে ইউরোপীয় নেতারা কঠোর মনোভাব পরিত্যাগ করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র অবধি যাননি। জাতীয়তাবাদীরাও সাধারণত শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। বি-উপনিবেশায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া আফ্রিকার অন্যতম আলোকবর্তিকা প্যাট্রিস লুমুম্বা বলেছিলেন, ‘আমাদের সংগ্রামের জন্য আমরা কেবল একটি অস্ত্রই বেছে নিয়েছি, আর সেই অস্ত্র হচ্ছে অহিংসা।’
কিন্তু আলজেরিয়ার বিষয়টা ভিন্ন ছিল। লাখ লাখ শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারীর বাস ছিল সখানে এবং দেশটাকে ফরাসি শাসনাধীন রাখার ব্যাপারে তারা মরিয়া ছিল। তাদের কেউ কেউ এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলকে হত্যাও করতে চেয়েছিল, কারণ তিনি আলজেরিয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে অনুকূল মত পোষণ করেছিলেন। (এ প্রসঙ্গে অনেকেরই হয়তো গত জুন মাসে প্রয়াত বিশ্ববিখ্যাত লেখক ফ্রেডেরিক ফরসাইথের টানটান উত্তেজনাকর উপন্যাস ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’ ও সেটার কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের অ্যাডাপ্টেশন ‘সেই উ সেন’ বই দুটির কথা মনে পড়বে। ‘ওএএস (সিক্রেট আর্মি অর্গানাইজেশন)’ নামের একটি অতি ডান ভিন্নমতাবলম্বী ফরাসি প্যারামিলিটারি সংস্থা আলজেরীয় যুদ্ধের সময় ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের মূলমন্ত্র ছিল; ‘আলজেরিয়া ফ্রান্সের এবং তাই-ই থাকবে’। তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আলজেরীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের বিশেষ করে শেষ ভাগে সক্রিয় ছিল। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আলজেরিয়ার মুক্তিলাভ ঠেকাতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল। বোমাবর্ষণ, গুপ্তহত্যা, আর নিপীড়ন-নির্যাতন ছিল তাদের কাজ হাসিলের উপায়। প্রায় দুই হাজার মানুষ খুন হয়েছিল তাদের হাতে। ওএএস-এর সহায়তায় ফরাসি বিমানবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ-মারি ব্যাস্তিয়েন-থিরি কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ের ২২ আগস্ট ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গলকে হত্যার চেষ্টা করেন। ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’ উপন্যাসের গোড়াতেই এই হত্যা প্রচেষ্টার সঠিক ঐতিহাসিক বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক ফ্রেডেরিক ফরসাইথ। বইটির বাকি অংশ অবশ্য কাল্পনিক, যেখানে ওএএস একজন ভাড়াটে আততায়ীর সাহায্যে তাদের ব্যর্থ পরিকল্পনা সফল করার চেষ্টা করে।)
ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারী অধ্যুষিত অন্যান্য আফ্রিকি দেশগুলো, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণাঞ্চলীয় রোডেশিয়া (অধুনা জিম্বাবুয়ে), কেনিয়া ও মোজাম্বিকও প্রচুর সহিংসতার মধ্য দিয়ে যাবে। (মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকায় তো একে-৪৭-ই রয়েছে এখন। কিন্তু তারপরও, যুদ্ধটা স্বাভাবিক ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬২ সালে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যবর্তী সময়ে আফ্রিকার ২৮টি উপনিবেশ মুক্তি লাভ করেছে; তার মধ্যে মাত্র ৪টি কোনো না কোনো মাত্রার সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু তার কোনোটিই আলজেরিয়ার সহিংসতার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাবেক বেলজীয় কঙ্গোতে লুমুম্বা সহিংসতা নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
ফানোঁর কাছে শান্তিপূর্ণ মুক্তি বা স্বাধীনতা ছিল নেহাতই বোকার স্বর্গ। ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কে’র একটি জায়গায় প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি ফরাসি শাসনাধীন ক্যারিবীয় অঞ্চলকে ‘অসহনীয়’ বলে বর্ণনা দিয়েছেন, যদিও যেখানে দাসব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটেছিল এবং ফরাসি ডিক্রি জারি করে লোকজনকে নানা অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
ফরাসি জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সেখানে নিয়মিতভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন চালাত; জোহরা দ্রিফের এক সহযোগীর যোনিতে তারা বৈদ্যুতিক শক প্রয়োগ করেছিল এবং আরেকজনের যোনিতে বিয়ারের বোতল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়ে ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা শোরগোল তুললে ফানোঁ চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন তারা কি দেখে না যে তাদের গোটা সাম্রাজ্যটাই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?
তবে সাম্রাজ্য নিয়ে আচ্ছন্ন ফানোঁ আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তির বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলেননি। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ‘আইন আদালত ও বিচারের তোয়াক্কা না করে মানুষকে শাস্তি বা মেরে ফেলার দেশ’ যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সহযোগীও বটে—জন এফ কেনেডি ফরাসি উপনিবেশবাদের যে ‘চূড়ান্ত ও অনমনীয়’ বিরোধিতা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। সিআইএ সমর্থিত অ্যাঙ্গোলান নেতা হোল্ডেন রবার্তোর সঙ্গে যে ফানোঁর এক বিপর্যয়কারী সখ্য ছিল, তা বোধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর অকপটতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। হোল্ডেন উপনিবেশ স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করেছেন, তেমনি অ্যাঙ্গোলান বামপন্থীদের বিরুদ্ধেও। শাটজ আমাদের বলছেন, রবার্তো ফানোঁকে লুমুম্বার বিরুদ্ধে একটি গোপন ষড়যন্ত্রের কথা আগেভাগেই জানিয়েছিলেন, (সত্যি বলতে, লুমুম্বার বিরুদ্ধে একাধিক ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং তার একটিতে সিআইএর এক আততায়ী জড়িত ছিল)। রবার্তো মনে করতেন লুমুম্বা ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিজম বা সাম্যবাদেরে একজন পুতুল মাত্র’ এবং বিশ্বাস করতেন যে ‘রক্ত না ঝরে উপায় নাই।’ লুমুম্বার শত্রুরা ১৯৬১ সালে তাঁকে হত্যা করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নিলে ফানোঁ নিজেকে দায়ী করেছিলেন।
ফানোঁ আশা করেছিলেন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করবেন। কিন্তু তার বদলে তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হলেন। চিকিৎসার জন্য তিনি মস্কো উড়ে গেলেন, বৃথাই। অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি তাঁর সবচেয়ে আবেগমথিত ও গুরুত্বপূর্ণ বই ‘দ্য রেচিড অব দ্য আর্থ’ শ্রুতলিখনের মাধ্যমে রচনা করলেন। তারপর, সিআই-এর সাহায্য গ্রহণ করে তাঁর পরিবার নিয়ে মেরিল্যান্ডের বেথসেডায় চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমালেন। সেখানে রবার্তো তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ ফানোঁ ৩৬ বছর বয়সে মারা গেলেন। মার্কিন বিমানবাহিনী তাঁর মরদেহ আফ্রিকায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এরপর, তিউনিসিয়ায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্ব শেষে আলজেরিয়ায় সমাহিত হন ফানোঁ।
আলজেরিয়ার আট বছরব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রায় ১৫ লাখ আলজেরীয়, ২৫ হাজার ৬০০ ফরাসি সৈন্য এবং ৬ হাজার ইউরোপীয় নিহত হন, স্বাধীনতার তিন বছর পর আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। এবং যুদ্ধকালীন অনেক কর্মকাণ্ডই বহাল থাকে কয়েক বছর—দমন-পীড়ন-নির্যাতন, নজরদারি, স্বৈরতন্ত্র।
ফানোঁ আলজেরিয়ার স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। লিউকেমিয়ার হাত থেকে তিনি যদি বেঁচেও যেতেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী আলজেরিয়ার দুর্গতি তিনি কতটা সহ্য করতে পারতেন, তা ভাববার বিষয়। তবে জগতের যেখানে যত অন্যায়, অবিচার, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অত্যাচারিতর যত প্রতিবাদ বিপ্লবে ফ্রানৎস ফানোঁ একটি দুর্মর প্রতিবাদের কণ্ঠ, এক অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার নাম। গোটা বিশ্বের বঞ্চিত লাঞ্ছিতের উত্তরাধিকার রয়েছে তাঁর বিভিন্ন অনলবর্ষী রচনায়, তার হ্রস্ব কিন্তু কর্মময় জীবনে।
(সূত্র: ড্যানিয়েল ইমারওয়ারের ‘মেইক ইট হার্ট’ এবং পংকজ মিশ্রের ‘ফ্রানৎস ফানোঁ’স এন্ডিউরিং লেগাসি’ শীর্ষক দুই প্রবন্ধ)