'কিংবদন্তি তাজুল': হৃদয়ের নিত্যধ্বনি
লম্বা টান টান হয়ে চোখ বন্ধ করে তিনি শুয়ে আছেন বিছানায়। তাঁর চৌকির পাশেই চেয়ারে উপবিষ্ট আমি। আমার হাতে ধরা সংখ্যাতত্ত্বের বই। পড়ছি বই থেকে, ব্যাখ্যা করছি নানান ধারণা। তিনি নিবিষ্ট মনে শুনছেন, আত্মস্থ করছেন। মাঝেমধ্যে পড়া ধরছি, আচমকা প্রশ্ন করছি, তিনি কখনো উত্তর দিচ্ছেন, কখনো দিতে পারছেন না। তখন বিষয়টি আবার ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাঁর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে সংশয় জাগছে—ঘুমিয়ে পড়লেন কি না? আর তখনই কেমন করে যেন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ছেন তিনি।
প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। সলিমুল্লাহ হলের ৩৩ নম্বর কক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি ওই কক্ষের অধিবাসী অন্য তিনজন সহকক্ষবাসীসহ। আমার শয্যার পাশেই তাঁর চৌকি। সামনেই ঐচ্ছিক বিষয় সংখ্যাতত্ত্বের পরীক্ষা তাঁর। সারা বছর আন্দোলন আর রাজনীতিতে বুঁদ হয়ে থাকার ফলে পড়াশোনা একদম করা হয়ে ওঠেনি। তাই পরীক্ষার বৈতরণি পার হওয়ার জন্য এই জরুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে তাজুল ভাইয়ের জন্য। তাজুল ভাই তখনো কমরেড তাজুল ইসলাম হয়ে ওঠেননি।
কিন্তু বোঝা গিয়েছিল তখনই—এ মানুষটি সাধারণ মানুষ নন। এ একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। প্রায় তিন বছর আমাদের পাশাপাশি শয্যা ছিল। এ চৌকি থেকে ও চৌকিতে আমরা কথা চালাচালি করতাম। তিনি আমাকে তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণার কথা বলতেন, আমি তাঁকে রুশ সাহিত্যের দিকপালদের লেখার কথা বলতাম। তিনি মতলব হাইস্কুলের কিংবদন্তি প্রধান শিক্ষক ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারীর কথা বলতেন, আমি আমার বাবার কথা বলতাম তাঁকে। দুজনই অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম এক বছরের ওপর-নিচে, সুতরাং আমাদের কথার বিরাট অংশজুড়ে থাকত বিভাগ, বিভাগীয় ছাত্র-শিক্ষকেরা, নানান মজার গল্প। আমরা দুজনই মৃদুভাষী ছিলাম। সুতরাং আমাদের নিচু স্বরের গল্প বাতাসে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কইত।
রাতের শহর ঘোরা আর দেখা আমার ভারি ভালো লাগে—তা সে গা ছমছম করা ভুতুড়ে শহরই হোক, অথবা সন্ধের পরে মরে যাওয়া শহরই হোক, কিংবা সারা রাত জেগে থাকা টগবগে শহরই হোক। রাতের শহর দেখার এই নেশা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাজুল ভাই। সারা দিন লাইব্রেরিতে কাটিয়ে আমি ফিরতাম সন্ধ্যার দিকে। দলের অফিসের কাজ শেষ করে তিনি আসতেন রাত ৯টা নাগাদ। তারপর রাতের খাওয়া সেরে ১০টার দিকে এইবার বেরিয়ে পড়া—‘চলো মুসাফির’। আমরা হাঁটতাম নানান রাস্তায়, পদচারণের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত, বিধিবদ্ধ কোনো নিয়মও ছিল না।
সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসের সামনের বিশালকায় শিরীষ গাছে গাছে ছাওয়া পথটা পেরিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের বাড়িটিকে বাঁয়ে রেখে চলে যেতাম পলাশী ব্যারাকের পথের পাশে ছক্কু মিয়ার দোকানে। সেখানে চা খেতে খেতে শুনতাম চা খেতে আসা রিকশাচালকদের আলাপ। মাঝেমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পুরোনো ফুলবাড়িয়া স্টেশনের দিকে। দেখতাম, ভাসমান মানুষদের সংসার। একবার হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম সদরঘাট পর্যন্ত। দেখি অত রাতেও শ্রমজীবী মানুষের কোনো কর্মবিরতি নেই। জগৎকে চেনা, মানুষের প্রতি মমতা, জীবনের বহু শিক্ষা তো সেই নানান পথের হাঁটা থেকেই কুড়োনো।
কোনো কোনো দিক থেকে ভারি মজার মানুষ ছিলেন তাজুল ভাই; বহু ছেলেমানুষি ছিল তাঁর। পুরো হাতা জামা পরতেন তিনি, লাল আর কমলার খুদে খুদে চেক জামাটি তাঁর এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই। কিন্তু সে হাতা তিনি না ভাঁজ করে ওপরে তুলতেন (যা আমরা অনেকেই করতাম), না হাতার বোতাম সাঁটতেন। সুতরাং কবজির কাছে বোতাম না সাঁটা জামার হাতা তাঁর ঢল ঢল করে বাতাসে নড়ে তার অস্তিত্বের জানান দিত। বহু বলা-কওয়া সত্ত্বেও ‘খোলা হাতার কমরেড’ তাজুল ইসলাম তাঁর অভ্যাস থেকে এক বিন্দুও নড়েননি।
তাজুল ভাইয়ের এক বিশেষ খেলা ছিল আমার সঙ্গে—আমাকে উত্ত্যক্ত করার জন্যই। প্রতি রাতেই দলীয় অফিস থেকে একরাশ বই, একগাদা কাগজপত্র বিলিবাট্টার জন্য নিয়ে ফিরতেন তিনি। ঘরে ঢুকেই তাঁর প্রথম কাজ ছিল ওই গন্ধমাদন আমার বিছানায় দুম করে ফেলা। সেসব কাগজপত্র ছত্রাকার হয়ে যেত বিছানাময়। আমি প্রতিবাদ করলে তাঁর নির্বিকার নির্লিপ্ত জবাব ছিল, ‘আপনার বিছানাতে তো এমনিতেই বইপত্র ছড়ানো, আর পাঁচখানা পড়লে এমনই বা কী ক্ষতি?’ কে তাঁর সঙ্গে তর্ক করবে?
হলে প্রায়ই বাতি চলে যেত। তখন তাঁর সহকক্ষবাসীদের নিয়ে এক মজার দুষ্টুমিতে মাততেন তাজুল ভাই। বাতি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে আমাদের তিনজনকে টেনে ঘরের সামনের টানা বারান্দায় দাঁড়াতেন তিনি। তারপর আমরা চারজনাই বারান্দায় কাপড় রোদে মেলে দেওয়ার জন্য যে মোটা রডটি ছিল সেটা দুহাতে উঁচিয়ে ধরতাম। তাজুল ভাই শিখিয়ে দিতেন কী কী বলতে হবে হলের পশ্চিম অংশের অধিবাসীদের উদ্দেশে। সলিমুল্লাহ হলে একটি কথা ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত আছে যে পূর্ব অংশের অধিবাসীরা ‘স্মার্ট’ আর পশ্চিম অংশের অধিবাসীরা ‘বোকা’— তাজুল ভাইয়ের ভাষায় ‘ভ্যান্দামারা’। তারপর দলনেতা এক, দুই, তিন বলে নির্দেশ দিলে আমরা তিনজন চিৎকার করে শিখিয়ে দেওয়া কটূক্তিগুলো পশ্চিম অংশের দিকে ছুড়ে মারতাম। বলতে দ্বিধা নেই, সেসব কটূক্তির কিছু কিছু এমন অশ্রাব্য ছিল যে কহতব্য নয়। শেষ চিৎকারের শব্দ মিলিয়ে না যেতেই আমরা চারজন উচ্চ হাসিতে ভেঙে পড়তাম।
স্বাধীনতার পরে তাজুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। পরীক্ষার্থী হিসেবে তিনি একক কক্ষে চলে গেলেন। মাঝে মাঝে পথে বারান্দায় দেখা হয়েছে বটে, কিন্তু আগের সময়ে আমরা আর ফিরে যেতে পারিনি। এক সময়ে সেই ক্ষীণ সম্পর্কও বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৫ এ আমি বিভাগে যোগ দিলাম শিক্ষক হিসেবে, ৭৭-এ চলে গেলাম কানাডায় উচ্চশিক্ষার্থে। তাজুল ভাইয়ের খোঁজ আর রাখিনি।
শেষতক তাঁর খোঁজ পেলাম ১৯৮৪ তে বিদেশ থেকে ফিরে। কিন্তু তেমন খোঁজ তো আমি চাইনি। ঢাকা পৌঁছালাম ৩০ মার্চ। বিমানবন্দরে দেখা প্রয়াত কাজী আকরাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১ মাস আগে আদমজীতে শ্রমিকনেতা কমরেড তাজুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারপর ধীরে ধীরে জানলাম আমার সহকক্ষবাসী তাজুল ইসলামের কমরেড তাজুল ইসলাম হয়ে ওঠার গল্প। কেমন করে নিজেকে তিনি সম্পূর্ণ মোহমুক্ত করেছেন, কী করে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে একাত্ম হওয়ার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আদমজী শ্রমিক কলোনিতে বসবাস করতে শুরু করেছেন, কেমন করে শ্রমিকদের অধিকার আর কল্যাণ তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে। সে এক অবিশ্বাস্য আখ্যান।
কমরেড তাজুল ইসলামের জন্য আমার বিরাট এক গর্ব, এক বুক ভালোবাসা। তাজুল ভাই আমার অহংকার। কিন্তু অন্য সবার মতো আমি তাজুল ভাইকে শুধু জননেতা হিসেবে দেখি না, আমি তাঁকে দেখি অন্যভাবে। তাঁর সঙ্গে আমার চেনা-জানা তো অনেক আগের। তিনি ছিলেন আমার বন্ধু, সহকক্ষবাসী, আমার নৈশ হাঁটার সঙ্গী। তাঁর সঙ্গে শহর আর মানুষ দেখার সেই নিরন্তর হাঁটায় ছেদ পড়েনি আমার এখনো। পৃথিবীর যে শহরেই যাই কার্যোপলক্ষে বা নেহাত বেড়াতে—রাতের খাওয়ার পরই বেরিয়ে পড়ি। পথ যেদিকে টানে, সেদিকেই চলি। কত কিছু যে দেখেছি এ রাস্তায়, সে রাস্তায়; এ বাঁকে, সে বাঁকে; এ মানুষে, সে মানুষে।
‘এইসব দিন-রাত্রির’ রাত্রিতে যখনই শহর থেকে শহরের রাস্তায় হাঁটি, তখনই আমার পায়ের শব্দের পেছনে আরেকটি পদধ্বনি শুনি। আমি জানি এ পদধ্বনি কার। এ পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে একদিন নানান পথে আমি হেঁটেছি। একা হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যে আমি থেমে পড়ি, পেছনের পদধ্বনিও মিলিয়ে যায়। কিন্তু হৃদয়ে সে ধ্বনি নিত্য বাজে—নিরন্তর সে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
আরও পড়ুন
-
নাইজারে মার্কিন বাহিনীর অবস্থান থাকা ঘাঁটিতে রুশ সেনাদের প্রবেশ
-
প্রথম টি–টোয়েন্টি: তানজিদের অভিষেক, টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
-
সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন
-
উপজেলা চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে বদির গুলি, থানায় অভিযোগ
-
আমেথি থেকে সরে শেষ মুহূর্তে কেন রায়বেরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল