চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বা কোর্স অসম্পূর্ণ রাখা যাবে না
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বা কোর্স অসম্পূর্ণ রাখা যাবে না

মতামত

অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক: আধুনিক চিকিৎসার নীরব বিপর্যয়

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু আর ভবিষ্যতের কোনো দূরবর্তী হুমকি নয়, এটি ইতিমধ্যেই জাতীয় বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সদ্য প্রকাশিত তথ্য এ সংকটের ব্যাপ্তি সম্পর্কে শীতল বাস্তবতা সামনে এনে দিয়েছে। আইসিইউতে ভর্তি প্রতি ১০ জন রোগীর ৪ জনই বর্তমানে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকে সাড়া দিচ্ছেন না। এই একটিমাত্র পরিসংখ্যানই দেখায় যে যেসব সংক্রমণ সহজেই চিকিৎসাযোগ্য হওয়ার কথা, সেই সংক্রমণ মোকাবিলার সক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ভাঙন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন আমরা অত্যাবশ্যক অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর রেজিস্ট্যান্সের প্রবণতা দেখি। মেরোপেনেম, যা সবচেয়ে জটিল সংক্রমণের চিকিৎসায় শেষ ভরসার ওষুধ—তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মাত্রা ২০২২ সালে ৪৬ দশমিক ৭ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে আশঙ্কাজনকভাবে ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স এখন ৭৯ থেকে ৯৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এ ওষুধগুলো আমাদের শেষ প্রতিরক্ষাব্যূহ আর সেগুলোর কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাচ্ছে।

এএমআরের প্রভাব হাসপাতালের বাইরেও বিস্তৃত। বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণে সরাসরি ১২ দশমিক ৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৫০ লাখ মৃত্যুর সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল। আরও ভীতিকর পূর্বাভাস হলো ২০৫০ সালের মধ্যে এএমআর প্রতিবছর এক কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে, যা ক্যানসারকেও ছাড়িয়ে যাবে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতিও ভয়াবহ।

বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে যে এএমআরের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যেই বৈশ্বিক জিডিপি থেকে প্রতিবছর ১ ট্রিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। দ্রুত ও সমন্বিত হস্তক্ষেপ না হলে এএমআর চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কয়েক দশকের সাফল্য মুছে দিতে পারে।

এ সংকট আমাদের বিপজ্জনকভাবে প্রায় অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব যুগে ঠেলে দিচ্ছে, যে সময় সংক্রমণ ছিল মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং সাধারণ সার্জারিও ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যানসার কেমোথেরাপি, আইসিইউ সেবা, এমনকি সাধারণ সিজারিয়ান অপারেশনও সেকেন্ডারি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভরশীল। যদি এ ওষুধগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তবে আজকের অনেক জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর আস্থা রেখে দাঁড়িয়ে আছে, তা প্রতিটি প্রতিরোধী জীবাণুর সঙ্গে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে।

সমাজে স্বচিকিৎসা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কিনছে, নিজের মতো ডোজ নিচ্ছে আর উপসর্গ কমলেই ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছে। অসম্পূর্ণ কোর্সের ফলে শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া টিকে যায় এবং ভবিষ্যতে ওষুধটিকে অকার্যকর করে ফেলে। ওভার দ্য কাউন্টার বা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সহজলভ্য হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

দুঃখজনক বিষয় হলো জীবাণুনাশক প্রতিরোধ অনেকটাই মানুষের তৈরি। সমাজে স্বচিকিৎসা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কিনছে, নিজের মতো ডোজ নিচ্ছে আর উপসর্গ কমলেই ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছে। অসম্পূর্ণ কোর্সের ফলে শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া টিকে যায় এবং ভবিষ্যতে ওষুধটিকে অকার্যকর করে ফেলে। ওভার দ্য কাউন্টার বা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সহজলভ্য হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভেতরেও সমস্যা রয়েছে। অনেক চিকিৎসক সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেন আর প্রশিক্ষণহীন সেবাদাতারা তো আরও নির্বিচার ওষুধ ব্যবহার করেন। কালচার ও সেনসিটিভিটি টেস্ট (ব্যাকটেরিয়ার ধরন ও উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক নির্ণয়ের পরীক্ষা) বাধ্যতামূলক হলেও তা সর্বত্র মানা হয় না। এ ছাড়া হাসপাতালে দুর্বল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা–প্রতিরোধী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করছে।

ওয়ান হেলথ বা মানুষ-প্রাণী-পরিবেশ একসঙ্গে বিবেচনার দৃষ্টিকোণ থেকে এ সংকট আরও বিস্তৃত। কৃষি ও পশুপালনে অ্যান্টিবায়োটিক অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা হয় এদের বৃদ্ধি বাড়াতে এবং রোগ ঠেকাতে। এতে প্রতিরোধী জীবাণু খাবার, পানি, মাটি ও পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

ওষুধ উৎপাদন বর্জ্য অনেক সময় অপরিশোধিত অবস্থায় পরিবেশে যাচ্ছে, যা প্রতিরোধী জীবাণুর জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। ফলে জীবাণুগুলো আবার মানবদেহে ফিরে আসে এবং একটি ভয়াবহ চক্র তৈরি হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে অনাগ্রহ। ব্যয় বেশি, লাভ কম হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণায় বিনিয়োগ করছে না।

এএমআর মোকাবিলায় জরুরি, আক্রমণাত্মক ও বহু খাতভিত্তিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। মোকাবিলার জন্য এখনই দ্রুত, শক্তিশালী ও বহু খাতের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। অননুমোদিত ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং সঠিক পরীক্ষানির্ভর প্রেসক্রিপশন নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক স্টুয়ার্ডশিপ বা ওষুধ ব্যবহারের সঠিক নিয়মনীতি চালু করতে হবে। পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পশু পালনে অ্যান্টিবায়োটিক কমানো এবং বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক, দ্রুত ডায়াগনস্টিক (রোগ নির্ণয়) এবং টিকা গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। মানুষকে বুঝতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসজনিত রোগ সারায় না। ফলে স্বচিকিৎসা বিপজ্জনক ও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের কোর্স শেষ করা বাধ্যতামূলক। অ্যান্টিবায়োটিক অসীম নয়, এগুলো মূল্যবান ও সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। তাই এখনই যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অর্থনীতি, মানুষের জীবন—সবই বড় ঝুঁকিতে পড়বে।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব