উত্তরের গ্রামগুলোয় গেলে দেশের উন্নয়ন চোখে পড়ে। রংপুর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে বদরগঞ্জ উপজেলা। উপজেলা থেকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম আমরুলবাড়ি। এক যুগ আগেও গ্রামে যেতে হতো মাটির রাস্তায় সাইকেল অথবা রিকশায়। কোনো রিকশাচালক যেতে চাইতেন না কাঁচা রাস্তা বলে। বর্ষাকালে এঁটেল মাটি এত বেশি আঠালো হতো যে, সাইকেল বা রিকশার চাকা আটকে যেতো কাদায়। সেই কাদা সরিয়ে আবার রাস্তা চলতে হতো।
বর্তমানে গ্রামে মাটির রাস্তা নেই বললেই চলে। রংপুর শহরে সাতগাড়া মিস্ত্রিপাড়ায় এখনো কিছু গলিতে কাঁচা রাস্তা পাওয়া গেলেও গ্রামের রাস্তা পাকা। রাস্তা হওয়ায় যোগাযোগ বেড়েছে। মিনিটে-মিনিটে ভ্যান-রিকশাযাত্রী আনা–নেওয়া করছে। ১০ টাকা হলেই তিন কিলোমিটার রাস্তা চলে যাওয়া যায় পনেরো মিনিটে। কথা হচ্ছিল ভ্যানচালক একরামুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন তো মানুষজন অনেক সুখে আছে ভাই।
গ্রামের একজন গরিব মানুষের বাড়িতে পাঁচজন লোক বেড়াতে গেলেও তাঁদের আপ্যায়ন করানোর সক্ষমতা এখন হয়েছে।
আগে সারা দিন কাজ করার পর সন্ধ্যায় মহাজনের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে হতো মজুরির জন্য। দেখা গেল, একদিন মহাজন বলল আইজ টাকা দিবার পাইরবার নাও। কাইল নেইস (আজ টাকা দিতে পারব না,আগামীকাল নিয়ো)। খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হতো।’
বর্তমানে গ্রামে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতে হয় ধান কাটার জন্য। মজুরি ন্যূনতম পাঁচ শ টাকা। গ্রামে রাস্তা পাকা হওয়ায় বিভিন্ন এনজিও টাকা ধার দিচ্ছে। সেই টাকায় একটি ভ্যান অথবা রিকশা কিনে রাস্তায় নামলেই আয় করা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে রিকশা কেনা কোনো লোকের দেখা পাওয়া যায় না, মূলত এনজিওগুলো দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। বিভিন্ন ভ্যানচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনে পাঁচ শ টাকা আয় করা কোনো বিষয়ই না।
তার মানে মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় করছে বাড়িতে থেকেই। সে তুলনায় শহরে যারা শ্রমজীবী আছেন, তাঁদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ। শহরে সব কিনতে হয়। বাড়িভাড়া, খাওয়া, চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশোনা সবকিছুই করতে হয় টাকার বিনিময়ে। শহরে যেকোনো ক্লিনিক, হাসপাতালে চাকরি করলে যে বেতন পাওয়া যায়, তা দিয়ে শহরে পরিবার নিয়ে থাকা অনেক কষ্টকর।
গ্রামে সবারই বাড়ি আছে। খালবিলের মাছ খেয়ে, পুকুরপাড়ের কলমিশাক, বাড়ির পাশে লাউ, মরিচ, কুমড়ার চাষ বা কৃষিকাজ করে শহরের চেয়ে ভালো থাকা সম্ভব।
উত্তরের প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ–সুবিধা থাকায় ঘরে ঘরে টিভি, মুঠোফোন, ইন্ডাকশন কুকার। বিকেলে মোড়ের দোকানে বিক্রি হচ্ছে চা, বিস্কুট, কেক। কৃষকেরা কৃষিকাজ শেষ করে সেসব দোকানে বসে আড্ডায় মাতেন। এমনকি শীতকালে ভাপা পিঠা ও চিতই পিঠা বিক্রি হয় চুলা জ্বালিয়ে। ১০ বছর আগেও এসব অকল্পনীয় ছিল। তারপরও কিছু উচ্চাভিলাষী মানুষ অতিরিক্ত ঋণের ফাঁদে পড়ে। পরিণামে বাড়িভিটা ছেড়ে শহরে যায়।
আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম থেকে ২০২৩ ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘এশিয়ার জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতির লৈঙ্গিক দিক বা জেন্ডার ডাইমেনশনস অব লস অ্যান্ড ড্যামেজ ইন এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় দুর্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে ৬৮ শতাংশ মানুষ বসতভিটা ছেড়ে দেশের অন্যত্র চলে যান।
এলাকা ছাড়া মানুষের ৩২ শতাংশ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে চলে যান, যাঁদের বড় অংশ পুরুষ। নারীদের মধ্যে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের ৬০ শতাংশ অল্প সময়ের জন্য গৃহশ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যান।
দেশে এখন সবচেয়ে বেশি দরিদ্রের বাস বরিশাল বিভাগে। এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯। সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে ১৪ দশমিক ৮। রংপুরে ২৪ দশমিক ৮ অথচ আগে রংপুর অভাবী এলাকা হিসেবে সারা দেশে পরিচিত ছিল। উত্তরের জনপদগুলোয় অভাব দূর হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন উন্নত সড়ক আর ভ্যানরিকশা।
আগে গ্রামের রাস্তায় গরুর গাড়িতে করে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেত যে গাড়োয়ান, তিনি এখন বর্তমানে মুঠোফোনে গান শুনতে শুনতে রিকশাভ্যান চালিয়ে চলে যায় গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে।
ডা. ফেরদৌস রহমান সহযোগী অধ্যাপক শিশু বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর