মতামত

ফ্রান্স: যে দেশে পুলিশের বর্ণবাদী হত্যায় সায় থাকে সরকারের

নাহেল হত্যার প্রতিবাদে ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে
 ছবি: রয়টার্স

চলতি সপ্তাহে ফ্রান্সে একজন পুলিশ কর্মকর্তা দিনদুপুরে একটি ট্রাফিক স্টপেজে ১৭ বছরের এক কিশোরকে নির্মমভাবে গুলি করে মেরে ফেলেছেন। পুলিশ প্রথমে মিথ্যা বলেছিল। পুলিশ বলেছিল, ওই কিশোরকে থামতে বলার পরও সে পালানোর চেষ্টা করেছিল, তাই পুলিশ গুলি করেছে এবং প্রায়ই যা ঘটে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে; এ ক্ষেত্রেও জাতীয় সংবাদমাধ্যম পুলিশের বানোয়াট বক্তব্যকে তথ্য হিসেবে প্রচার করেছে। কিন্তু পরে একজন পথচারী তাঁর মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে আসল সত্যকে দেখিয়ে দেন।

প্যারিসের শহরতলি নঁতেরে এলাকায় একটি হলুদ গাড়ির আরোহীর দিকে ফরাসি পুলিশ সদস্যরা রাইফেল তাক করে তাকে ভয় দেখাচ্ছেন এবং গাড়ি থেকে ওই আরোহীকে টেনে বের করতে করতে তার মাথায় গুলি চালাচ্ছেন—এই দৃশ্য ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের মানুষ দেখে ফেলেছে। পুলিশের মিথ্যা দাবির বিপরীতে এ সময় কোনো কর্মকর্তাকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির গতি রোধ করতে বা গাড়ির চালককে পুলিশি নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি চালিয়ে যেতে অথবা তাকে পুলিশকে লক্ষ্য করে হুমকি দিতে দেখা যায়নি।

তরুণকে গুলি করার ওই নারকীয় দৃশ্যকে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম ‘সামগ্রিক বিবেকের জন্য ধাক্কা’ বলে অভিহিত করেছেন।

এ ঘটনায় দেশজুড়ে ফুঁসে ওঠা বিক্ষোভ দমন করতে হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে ‘জনশৃঙ্খলা’ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। নাহেল নামের যে ফরাসি তরুণকে পুলিশের গুলিতে দুঃখজনকভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে, সে আলজেরীয় বংশোদ্ভূত। ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক বর্ণবাদের ও ‘অ-শ্বেতাঙ্গ’ লোকদের ওপর সহিংসতা চালানোর একটি দীর্ঘ ও জঘন্য ইতিহাস রয়েছে। ফরাসিদের নিপীড়নের এই ইতিহাস ক্যারিবিয়ান অঞ্চলভুক্ত হাইতি, গুয়াদেলুপ ও মার্টিনিক থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরের রিইউনিয়ন দ্বীপ এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার পাশাপাশি ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত।

ফ্রান্স, বিশেষ করে আলজেরিয়ার জনগণের ওপর নির্মমভাবে নিপীড়ন করেছে। সেখানে ফরাসি উপনিবেশের গোড়াপত্তন হয় ১৮০০ সালের দিকে। ওই সময় আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ফরাসিরা সেখানে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় (১৯৫৪-৬২) ফরাসি শাসকেরা ‘স্বাধীনতা’ ‘সাম্য’ ও ‘ভ্রাতৃত্ব’-এর দোহাই দিয়ে মূলত তাদের ঔপনিবেশিক শাসন জারি রাখতে দেশটিতে গণহত্যা চালায়। ওই সময় ফরাসি সেনারা ১০ লাখের বেশি আলজেরীয় মানুষকে হত্যা করে এবং অগণিত মানুষের ওপর পরিকল্পিতভাবে অত্যাচার চালায়। তখন থেকেই ফরাসিদের মধ্যে আলজেরীয় বিদ্বেষ রয়ে গেছে।

ফ্রান্সে আরব ও কৃষ্ণাঙ্গরাও ঐতিহাসিকভাবে পুলিশি নির্যাতনের মুখে পড়ে। ১৯৬১ সালে আরব বংশোদ্ভূত ফরাসিরা শান্তিপূর্ণভাবে প্যারিসে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশ গুলি চালিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে মেরে ফেলেছিল। ওই সময় আলজেরীয় স্বাধীনতাকামীদের পক্ষ সমর্থন করে কারফিউ ভেঙে লক্ষাধিক মানুষ প্যারিসের রাস্তায় মিছিলে যোগ দিয়েছিল। পাল্টা জবাব হিসেবে পুলিশ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসিদের রাজপথে গুলি করে, এমনকি সিন নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করেছিল।

ফরাসি পুলিশের হাতে ওই বিক্ষোভের সময় নিহত হওয়া নথিভুক্ত সর্বকনিষ্ঠ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত কিশোরী হলো ফাতিমা বেদা। এখনকার মতো স্মার্টফোন না থাকায় কয়েক যুগ ধরে ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ এসব নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে এসেছে। এমনকি সেদিনের সেই ঘটনার কথা স্বীকার করতে ফ্রান্স সরকারের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় লেগে গেছে। এমনকি আজ পর্যন্ত সেই বর্বরতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতা প্রার্থনা করা হয়নি।

ঔপনিবেশিক বর্ণবাদ ও পুলিশিংয়ের যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নঁতেরে এলাকায় নাহেলের হত্যাকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করেছিল, তা শ্বেতাঙ্গ ফরাসি রাজনীতিক ও মিডিয়া পণ্ডিতদের আলোচনায় একেবারে অনুপস্থিত থেকে যায়। ফ্রান্সে ক্রমবর্ধমানভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও আরবরা পুলিশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার সরকার নিয়মিতভাবে এবং আক্রমণাত্মকভাবে এসব নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে থাকে।

চলমান বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এই হত্যাকাণ্ডকে ‘অবর্ণনীয়’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এটিও ফরাসিদের ঘটনা অস্বীকারের একটি কায়দা। নাহেলের মৃত্যু যে কোনো অমীমাংসিত রহস্য নয়; এটি যে পরিষ্কারভাবে পদ্ধতিগত বর্ণবাদের ফল, তা কথার মারপ্যাঁচে মাখোঁ এড়িয়ে গেছেন। এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটে এবং সেখানে সাধারণত উদারপন্থী ও বামপন্থীদের অনেকেই ওই ঘটনার জন্য পরিকল্পিত বর্ণবাদকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফরাসি বর্ণবাদের অভিযোগ অস্বীকারের ক্ষেত্রে উদারপন্থী ও বামপন্থীরা উগ্র ডানপন্থীদের সঙ্গে এক হয়ে যান।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

● ক্রিস্টাল এম ফ্লেমিং স্টনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড আফ্রিকানা স্টাডিজের অধ্যাপক এবং রিজারেক্টিং স্লেভারি: রেইসিয়াল লিগ্যাসিস অ্যান্ড হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি ইন ফ্রান্স বইয়ের লেখক