গাজাকে যেভাবে সাজানো বা পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। হামাস এখন কী করবে? নেতানিয়াহু কি তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখবেন?
গাজাকে যেভাবে সাজানো বা পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। হামাস এখন কী করবে? নেতানিয়াহু কি তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখবেন?

মতামত

ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা: নেতানিয়াহুর পরাজয় নাকি হামাসের আত্মসমর্পণ

গাজা পরিস্থিতি নতুন এক সন্ধিক্ষণে এসে হাজির হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফার একটি পরিকল্পনা হাজির করেছেন। যে পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছে গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে, কিন্তু গাজাকে যেভাবে সাজানো বা পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি যে পরিসংখ্যান, তা জাতিসংঘ স্বীকৃত এবং নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলোয় উদ্ধৃত হয়। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজার ওপর চালিয়ে আসা ইসরায়েলি আগ্রাসনের আজ ৭২৪তম দিনে এসে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৬৫ হাজার।

এই শতাব্দীর সবচেয়ে নজিরবিহীন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে মাত্র ১৭ বর্গমাইলের উপত্যকাটি। এ সংখ্যা ভয়াবহ রকমের বিশাল, কিন্তু এই সংখ্যা কেবলই বোমা হামলা, জায়নবাদী স্নাইপারদের গুলি কিংবা ভবন ধ্বংসের মতো আঘাতে প্রত্যক্ষভাবে নিহত ব্যক্তিদেরই পরিসংখ্যানমাত্র।

এর বাইরে ইসরায়েলি অবরোধের দরুণ অনাহারে ধীরে ধীরে প্রাণহানির শিকার, অসুস্থতায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া ব্যক্তি, যাঁদের মৃত্যু ওষুধের সরবরাহ ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতিরোধযোগ্য ছিল।

কিন্তু অবরুদ্ধ অবস্থায় তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, পঙ্গু ও অঙ্গহানির শিকার, যাঁদের নাড়াচাড়া করা কঠিন, কিংবা যাঁরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন অথচ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেসব ব্যক্তি; গর্ভেই যেসব শিশু সিজারিয়ান অপারেশন ও অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে, তাদের সবার সংখ্যা হিসাব করলে এই প্রাণহানির পরিমাণ দাঁড়ায় বহুগুণ।

বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট কর্তৃক জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সরাসরি আঘাতের কারণে সরকারি হিসাবে যে মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে মোট প্রাণহানির সংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি হিসাব মতে, প্রতিটি মৃতের বিপরীতে আরও চারজন মারা যাচ্ছেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা অথবা চিকিৎসাহীনতায়। ফলে সরকারি হিসাব মতে, ৬৫ হাজার শহীদের বিপরীতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখের অধিক। এ সংখ্যা চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর দিকের হিসাবে গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-অষ্টমাংশ।

ট্রাম্প ইতিমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, এ প্রস্তাব হামাস মেনে না নিলে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার যে ইসরায়েলি পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করবেন। অথচ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এই পৃথিবীতে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কারোর বিচারের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই; বরং ঔপনিবেশিকতা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাই সুস্পষ্ট। ফলে শেষ পর্যন্ত এ ঘোষণা ফিলিস্তিনে স্বস্তি ও শান্তি আনতে কতখানি ভূমিকা রাখবে, তা এখনই সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন।

লাশের এই সমুদ্রসম সারি আর লাখ লাখ আহত নিয়ে পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উপত্যকাটি।

সেই গাজা উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সম্মিলিত চাপের মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পাকিস্তান, তুরস্ক, আরব উপসাগরীয় দেশগুলো এতে সমর্থন জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করার কথাও জানিয়েছে। কিন্তু গাজার মূল শক্তি হামাস এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা আছে, গাজা হবে একটি নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল, যা প্রতিবেশীদের জন্য কোনো হুমকি হবে না। গাজাকে পুনর্গঠন করা হবে, ইসরায়েল ও গাজার প্রতিনিধিরা যদি এ প্রস্তাবে সম্মত হয়, তবে এ হামলা অবিলম্বে বন্ধ হবে। ইসরায়েল তাদের সেনা প্রত্যাহার করবে, বন্দিমুক্তির প্রস্তুতি চলবে। এ সময়কালে সব সামরিক অভিযান বন্ধ থাকবে, নতুন করে কোনো প্রকার আক্রমণ করা হবে না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দী জীবিত ও মৃত ফেরত দেওয়া হবে। সব বন্দী মুক্ত হলে ইসরায়েল ২৫০ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দী এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজা থেকে আটক করা প্রায় ১ হাজার ৭০০ জনকে মুক্তি দেবে।

হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর সোমবার যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (বাঁয়ে) ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

এ পরিকল্পনার অধীন হামাস সদস্যদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অস্ত্র ত্যাগ করার শর্তে দায়মুক্তি দেওয়া হবে। অন্য যাঁরা গাজা ছেড়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য নিরাপদ প্যাসেজ প্রদান করা হবে। চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে গাজায় অবিলম্বে ত্রাণ ও রসদ পাঠানো হবে। গাজায় ত্রাণসহায়তা বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন হবে জাতিসংঘ, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে, তাতে ইসরায়েল অথবা হামাস হস্তক্ষেপ করবে না। রাফাহ সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে।

গাজা একটি টেকনোক্রেটিক, অরাজনৈতিক কমিটি দ্বারা শাসিত হবে। এই কমিটি গঠিত হবে নিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে নাম এসেছে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের। এর তদারকি করবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অস্থায়ী সংস্থা ‘বোর্ড অব পিস’।

এই বোর্ড অব পিস গাজার পুনর্গঠন ও বাজেট ব্যবস্থাপনা করবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করে। একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। কাউকেই গাজা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে না। হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর গাজার শাসনমূলকব্যবস্থায় অংশগ্রহণ থাকবে না।

গাজার সব সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হবে এবং পুনর্নির্মাণ করা হবে না। গাজার নিরস্ত্রীকরণ করা হবে স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। আঞ্চলিক অংশীদারদের গ্যারান্টি দিতে হবে যাতে হামাস প্রতিবেশী, অর্থাৎ ইসরায়েলের জন্য হুমকি না হয়।

যুক্তরাষ্ট্র, আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলিতভাবে একটি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) গঠন করা হবে। আইএসএফ ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে এবং নিরাপত্তা বজায় রাখতে কাজ করবে। ইসরায়েল ও মিসরের সঙ্গে সীমান্ত এলাকাতেও তাদের দায়িত্ব থাকবে। ইসরায়েল গাজা দখল করবে না।

আইএসএফ গাজায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর, ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সরে যাবে এবং ইসরায়েলের সেনারা ধাপে ধাপে আইএসএফ বা গাজার অস্থায়ী প্রশাসনের হাতে এলাকা হস্তান্তর করবে। সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

গাজার পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া সামনে অগ্রসর হলে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের সংস্কার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরি করা হবে।

ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংলাপ শুরু করবে, যাতে শান্তি ও সমৃদ্ধি সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। একটি স্থায়ী এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের পথ তৈরি করা হবে।

সুস্পষ্টভাবেই এই চুক্তিতে একমত হওয়া হামাসের জন্য একপ্রকারের আত্মসমর্পণ। কিন্তু অনন্যোপায় হয়েই হামাসকে এ চুক্তি মানতে হবে। এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইকে অনন্তকালের জন্য অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার নেতানিয়াহুর জন্যও এটা একপ্রকারের রাজনৈতিক পরাজয়ই বটে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি গাজাকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। যুদ্ধ থামাতে প্রস্তুত ছিলেন না।

কিন্তু এ ঘোষণায় একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট। নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক জীবনজুড়েই এর বিরোধিতা করেছেন। ইসরায়েলের জন্যও এ যুদ্ধ ছিল ব্যাপক ব্যয়বহুল এবং বহুলাংশেই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে পারেননি। যদিও তাঁকে পাশে রেখে এ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এমনকি কাতারে হামলার জন্য দেশটির আমিরের কাছে ফোন করে ক্ষমাও চাইতে হয়েছে তাঁকে।

কিন্তু নেতানিয়াহু আসলেই এ প্রস্তাবে বিশ্বাস করেন কি না, তা সন্দেহজনক। আন্তর্জাতিক রীতি ও আইনকে উপেক্ষা করার দীর্ঘ প্রতারণামূলক ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের। এই চুক্তি বাস্তবায়নে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের প্রশ্ন আছে। টেকনোক্র্যাট সেই শাসন বোর্ড ও টনি ব্লেয়ারের ভূমিকাও নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।

ট্রাম্প ইতিমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, এ প্রস্তাব হামাস মেনে না নিলে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার যে ইসরায়েলি পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করবেন। অথচ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এই পৃথিবীতে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কারোর বিচারের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই; বরং ঔপনিবেশিকতা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাই সুস্পষ্ট। ফলে শেষ পর্যন্ত এ ঘোষণা ফিলিস্তিনে স্বস্তি ও শান্তি আনতে কতখানি ভূমিকা রাখবে, তা এখনই সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন।

  • আরজু আহমাদ লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী