নব্বইয়ের দশকে যখন প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছি, তখন পিঠে কোনো রকম ছেঁড়া একটা ব্যাগ থাকত, অথবা কখনো কারোর থাকতই না। বর্ষাকালে আমরা অনেকেই জামার ভেতর বই নিয়ে বা চেপে ধরে দৌড়াতাম। ছাতা ছিল তখনকার সময়ে নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতা। এখন অবশ্য রংবেরঙের স্টাইলের ছাতা বের হয়েছে। আবার ছাতার বিকল্প হিসেবে রেইন কোট পরেও স্কুলশিক্ষার্থীদের যাওয়া–আসা দেখি।
সে সময় কোথাও প্যাঁচপেঁচে কাদায় কলাগাছ দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করা হতো। ওই সিঁড়ির ওপর থেকে পা পিছলে কতবার যে পড়ে গেছি, তার ঠিক হিসাব নেই। কেউ হাত ধরে তুলে দিয়েছে। আবার কেউ হাসাহাসিতে ব্যস্ত। অনেক সময় হাঁটুসমান কাদায় পড়ে গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। কখনো বাড়ির আর স্কুলে স্যারের বকুনির ভয়ে স্কুলে ফিরে গেছি। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে পিচ্ছিল সরু কলাগাছের সাময়িক পথের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে আবার ফিরে যেতে হয়েছে পুকুরে। আবার কোথাও বেলে-দোআঁশ কাদা, আবার লতা-পাতা পচা কাদা এড়াতে বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ তৈরি করে নিয়েছি। এখন ওই সব দিনের কথা কিছুটা ঠাওর করতে পারি। এখন সেগুলো শুধু স্মৃতি। ভালো আর মন্দের ভেতর দিয়ে পার করে আসছি সেই নব্বই দশকের শেষাংশ আর একবিংশ শতাব্দীর শুরুর বছরগুলো।
কিন্তু ২০২৩ সালের আগে যেখানে ডিজিটাল গ্রাম হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমাদের কাদা এড়াতে খেত-খামার ডিঙিয়ে পার হতে হচ্ছে। এখনো পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে পানি সরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সারা বিশ্ব, তথা বাংলাদেশে এখন অনেক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। রাস্তাঘাট, অর্থাৎ যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। তারপরও দেশের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নয়নের হাওয়া লাগতে পারেনি স্থানীয় কিছু মানুষ আর জনপ্রতিনিধির আন্তরিকতার অভাবে।
বর্তমানে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম চলছে কিছুটা ঔপনিবেশিক কায়দায়। এখানে লোকদেখানো কর্মকাণ্ড ছাড়া কিছুই হয় না। শুধু নিয়ম করে খাজনা আদায়ের ফন্দি। অথচ খাজনা আদায় করলে তার ফলস্বরূপ কিছু উন্নয়ন করতে হয়, সেটার জ্ঞানচক্ষু আজও মেলেনি তাঁদের। আমি সাধারণ আমজনতা। খাজনা দিয়ে রসিদ সংরক্ষণ করাই আমার কাজ, পাছে দুবার খাজনা গুনতে না হয়, সেই ভয়ে কিনা!
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার উল্লেখ করেছিল, ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। ডিজিটাল হয়েছে অনেক কিছু। যেমন জমির নাম পত্তন, ডিজিটাল জন্মসনদ, ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র। কিন্তু গ্রামীণ মুখ্য উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকায় যাঁরা, তাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের রূপকল্পে তাল মেলাতে পারেননি। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়েও তাল মেলাতে পারবে কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটা নিম্নের চিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্টত হয়।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচিত এবং পছন্দনীয় কিছু অঞ্চলে কাজের উন্নয়নের কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। কারোর বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দে কাদামুক্ত রাস্তা।
বর্তমান শাসনাধীন সরকারের উন্নয়ন নীতিমালা, তা লঙ্ঘন করেছে স্থানীয় সরকার প্রশাসন। দেশের প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। দিনের পর দিন সেই সংবিধানের স্থানীয় সরকার গঠনপ্রণালি ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা গ্রহণপূর্বক যে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়, সেটা হয়তো ফেরার পথিমধ্যেই ভুলে যান। সে জন্য আজও জনদুর্ভোগের সীমানা দূর সীমানায়।
কেউ কেউ বলবেন, এই মন্দা অর্থনীতিতে মেগা প্রজেক্ট দ্রুত শেষ করার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে বিনিয়োগে ক্ষমতাসীন সরকার খুব একটা বাজেট দিচ্ছে না। আবার কেউ বলবেন, সরকার আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ায় এখন এসব গ্রামীণ উন্নয়নে মনোযোগ কম দিচ্ছে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, তাহলে এত দিন জনপ্রতিনিধিরা কী করেছেন, এত দিন কেন বাজেট আনা হয়নি। এত দিন কেন সংস্কার করা হয়নি এসব দুর্বল পথঘাট। আসলে গ্রামীণ উন্নয়নে, তথা সড়ক উন্নয়নে দরকার সদিচ্ছা ও পূর্ণ সততা, যা স্থানীয় সরকার প্রশাসনের মনে অনুপস্থিত।
আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, অথচ টেকসই উন্নয়ন গ্রামে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তসলিমা নাসরিনের একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘.....এত যে পুরুষ দেখি চারদিকে, কই, প্রেমিক তো দেখি না।’ এত যে রাস্তাঘাট দেখি, কোথাও টেকসই উন্নয়নমূলক রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, কাদামুক্ত পথঘাট তো দেখি না। আমরা কেন পিছিয়ে আছি, কেন গ্রামকে মফস্সল থেকে আধুনিক নগরায়ণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কেন গ্রামে গ্রামে মানসম্মত ক্লিনিক, স্কুল, মন্দির, মসজিদ, গ্রন্থাগার, শস্য হিমাগার, এটিএম বুথ, এজেন্ট ব্যাংকিং তৈরিতে পিছিয়ে আমরা। ভালো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কেন তৈরি হচ্ছে না, ভালো উদ্যোক্তারা কেন ঘন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছেন। উল্লেখিত বিষয়গুলোর মূল শিকড় হলো যোগাযোগব্যবস্থা (টেকসই সড়ক)। প্রকৃতপক্ষে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে।
এবার দেখা যাক কী কী কারণে এমন মাত্রাতিরিক্ত জনদুর্ভোগ:
জনগণের সচেতনতার অভাবে এমনটা হতে পারে। ধরুন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কাপড়টা একটু উঁচু করে বলবে, রাস্তায় যে কাদা বা দশা, তাতে হাঁটার মতোও নেই। কিন্তু তাঁরা জনসংযোগ করে কোথাও কোনো অভিযোগ দায়ের করবেন না।
জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার অভাব।
শুধু জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা, জনসেবা করার ইচ্ছার অভাব।
এক জায়গার বাজেট সুবিধামতো অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের তীব্র ইচ্ছা।
রাজনীতিকে ‘ভিলেজ পলিটিকসে’ পরিণত করা। ফলে রেষারেষির কারণে পিছিয়ে পড়ে রাস্তা সংস্কার।
ক্ষমতাসীন দলের ও বিরোধী দলের মধ্যে বা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। এতে গ্রামের উন্নয়ন আরও পিছিয়ে যায়।
স্মার্ট ইউনিয়ন বা গ্রাম গড়ার যথাযথ স্বপ্নের অভাব।
আমরা নিজেরাই নিজেদের অভিশাপ দিতে কুণ্ঠা বোধ করি না। এখান থেকে বেরিয়ে বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতাপূর্ণ টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অংশগ্রহণে একমাত্র উপায় হলো গ্রামগুলোর দিকে আন্তরিক নজর দেওয়া। যোগাযোগ উন্নত ও মানসম্মত রাস্তা বিনির্মাণ করা। আসুন, অভ্যন্তরীণ সব রেষারেষি ভুলে হাতে হাত রেখে নিজ নিজ জায়গা থেকে সঠিক ও উন্নত ভূমিকা রাখি এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করার গঠনমূলক মনোভাব তৈরি করি। ২০৪১ সালের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকারকে সামনে রেখে আগামী কয়েক বছরে মধ্যে ‘স্মার্ট গ্রাম’ গড়ার স্বপ্ন দেখি।
নীলকমল মণ্ডল
সাতক্ষীরা