বিধান

১৯ কারণে নামাজ নষ্ট হয়ে যায়

নামাজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে দ্বিতীয় এবং ইমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। একজন মুমিনের জীবনে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি সরাসরি আল্লাহ্‌র সঙ্গে বান্দার সংযোগ স্থাপন করে। তবে এই মহান ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য এর শুদ্ধতা বজায় রাখা অপরিহার্য।

নামাজের ভেতরে ও বাইরে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বা আরকান-আহকাম রয়েছে, যার কোনো একটি লঙ্ঘিত হলে নামাজ ভেঙে যায়। ইসলামি ফিকহশাস্ত্রের পরিভাষায় এগুলোকে ‘মুফসিদাতে সালাত’ বা নামাজ ভঙ্গের কারণ বলা হয়। হানাফি মাজহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো অনুযায়ী নামাজ ভঙ্গের প্রধান কারণগুলো ১৯টি।

নামাজে শুদ্ধতা ও সতর্কতা

ইসলামি শরিয়তে ইবাদতের পদ্ধতি ও শুদ্ধতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সুরা রুম, আয়াত: ৩১)

নামাজ কেবল কিছু শারীরিক কসরতের নাম নয়, বরং এটি একটি সুশৃঙ্খল আধ্যাত্মিক আমল। এই আমলটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য নামাজ কেন ও কীভাবে ভেঙে যায়, তা জানা প্রতিটি মুসলমানের জন্য জরুরি।

ফিকহবিদরা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে নামাজ ভঙ্গের কারণগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ইমাম শুরুনবুলালি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নামাজের মৌলিক স্তম্ভ বা শর্তের কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে নামাজ বাতিল হয়ে যায় (হাসান ইবন আম্মার শুরুনবুলালি, নুরুল ইজাহ, পৃষ্ঠা: ৮২, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৫)

নিচে ১৯টি কারণ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. নামাজে কথা বলা

নামাজে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, কথা বললে নামাজ ভেঙে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই এই নামাজে মানুষের কোনো কথা বলা সমীচীন নয়” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৩৭)। নামাজের মধ্যে কথা বললে আল্লাহর সঙ্গে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং নামাজের হাকিকত নষ্ট হয়।

২. কাউকে সালাম দেওয়া

নামাজরত অবস্থায় কাউকে আসসালামু আলাইকুম বা অন্য কোনোভাবে সালাম দিলে নামাজ ভেঙে যায় (ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদির, ১/৪০৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৩৯৭ হিজরি)। এটি মূলত মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের শামিল।

৩. সালামের উত্তর দেওয়া

কেউ সালাম দিলে মুখে তার উত্তর দিলেও নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নামাজরত অবস্থায় সালাম দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি উত্তর দেননি এবং পরে বুঝিয়ে বলেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২১৬)।

৪. শব্দ করে দুঃখ প্রকাশ করা

নামাজের মধ্যে দুনিয়াবি কোনো দুঃখ বা ব্যথার কারণে যদি ‘উহ’, ‘আহ’ বা ‘তফ’ শব্দ করা হয়, তবে নামাজ ভেঙে যায় (বুরহানুদ্দিন মারগিনানি, আল-হিদায়া, ১/৬৩, দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৫)। তবে যদি জান্নাত বা জাহান্নামের বর্ণনায় আল্লাহ্‌র ভয়ে এমন শব্দ বের হয়, তবে নামাজ ভাঙবে না।

৫. অযথা কাশি দেওয়া

গলায় কফ জমলে বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে কাশি দিলে অসুবিধা নেই। কিন্তু অহেতুক বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী শব্দ করে কাশি দিলে নামাজ নষ্ট হয়ে যায় (আলাউদ্দীন কাসানি, বাদাইউস সানাই, ১/২৩৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৩)।

৬. আমল-ই-কাসির বা অতিরিক্ত নড়াচড়া

নামাজের মধ্যে এমন কোনো কাজ করা যা দেখলে দূর থেকে মনে হয় যে ব্যক্তিটি নামাজ পড়ছে না, তাকে আমল-ই-কাসির বলা হয়। এই ধরনের অতিরিক্ত নড়াচড়া নামাজকে বাতিল করে দেয় (ইবনে আবিদিন, রদ্দুল মুহতার, ২/৩৮৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯২)।

৭. সুসংবাদ শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলা

নামাজে থাকাকালীন বাইরের কোনো ভালো খবর শুনে যদি কেউ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উত্তর দেয়, তবে তার নামাজ ভেঙে যাবে। কারণ এটি তখন জিকির না হয়ে কথোপকথনের অংশ হয়ে দাঁড়ায় (হাসান ইবন আম্মার শুরুনবুলালি, নুরুল ইজাহ, পৃষ্ঠা: ৮৪, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৫)।

৮. দুঃসংবাদ শুনে ইন্নালিল্লাহ বলা

একইভাবে, কোনো শোকের সংবাদ শুনে নামাজে থাকা অবস্থায় ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলে নামাজ ভেঙে যায়।

৯. আশ্চর্যের কিছু শুনে সুবহানাল্লাহ বলা

নামাজের বাইরের কোনো ঘটনায় আশ্চর্য হয়ে যদি কেউ ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তবে ফিকহবিদদের মতে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে।

১০. নিজের ইমাম ব্যতীত অন্য কাউকে ‘লোকমা’ দেওয়া

লোকমা মানে ভুল ধরিয়ে দেওয়া। নামাজে নিজের ইমাম কোরআন তিলাওয়াতে ভুল করলে তাকে ধরিয়ে দেওয়া বা লোকমা দেওয়া জায়েজ। কিন্তু অন্য কোনো নামাজির ভুল ধরিয়ে দিলে নামাজ ভেঙে যায় (বুরহানুদ্দিন মারগিনানি, আল-হিদায়া, ১/৬৪, দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৯৫)।

১১. কোরআন দেখে দেখে পড়া

নামাজে দাঁড়িয়ে সামনে রাখা কোরআন শরিফ বা কোনো কিতাব দেখে দেখে পড়া ইমাম আবু হানিফার মতে নামাজ ভঙ্গের কারণ। কারণ এটি নামাজের বাইরের একটি শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ার মতো মনে হয়।

১২. নামাজে কিছু খাওয়া

নামাজের মধ্যে সামান্য কিছু খেলেও নামাজ ভেঙে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজকে কেবল আল্লাহ্‌র ধ্যানে মগ্ন থাকার মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

১৩. কিছু পান করা

একইভাবে, নামাজের মধ্যে পানি বা অন্য কোনো পানীয় পান করলে নামাজ বাতিল হয়ে যায়। মুখে আগে থেকে লেগে থাকা তিল পরিমাণ কোনো খাবার গিলে ফেললেও নামাজ নষ্ট হবে (ইবনে আবিদিন, রদ্দুল মুহতার, ২,/৩৯৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯২)।

১৪. কিবলার দিক থেকে বুক ঘুরে যাওয়া

নামাজরত কারও বুক যদিকিবলার দিক থেকে ৪৫ ডিগ্রির বেশি ঘুরে যায়, তবে তার নামাজ তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙে যাবে (আলাউদ্দীন কাসানি, বাদাইউস সানাই, ১/২৪১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৩)। কারণ কিবলামুখী হওয়া নামাজের একটি অপরিহার্য শর্ত বা শর্ত। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)

১৫. অপবিত্র জায়গায় সিজদা করা

সিজদার জায়গাটি অবশ্যই পবিত্র হতে হবে। যদি কেউ জেনেশুনে নাপাক জায়গায় সিজদা করে, তবে তার নামাজ হবে না। নামাজের জন্য জায়গা পবিত্র হওয়া বাধ্যতামূলক (মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শায়বানি, আল-আসল, ১/১৭৬, দারু ইবনিল হাজম, বৈরুত, ২০১২)।

১৬. ‘সতর’ খুলে যাওয়া

যদি নামাজের মধ্যে শরীরের এমন কোনো অংশ দীর্ঘ সময় (এক রুকন পরিমাণ) খুলে থাকে যা ঢাকা ফরজ, তবে নামাজ ভেঙে যাবে। সতর ঢাকা নামাজের একটি প্রধান শর্ত।

১৭. তেলাওয়াতে মারাত্মক ভুল করা

কোরআন তিলাওয়াতে যদি এমন কোনো ভুল হয় যার ফলে অর্থের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং অর্থ কুফরিতে পর্যবসিত হয়, তবে নামাজ ভেঙে যায়। একে ‘যাল্লাতুল কারি’ বা তেলাওয়াতকারীর পদস্খলন বলা হয়। (ইবনে আবিদিন, রদ্দুল মুহতার, ২/৩৯৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯২)

১৮. শব্দ করে হাসা

নামাজে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি উচ্চৈঃস্বরে হাসেন (যাকে ফিকহের ভাষায় ‘কাহকাহা’ বলা হয়), তবে নামাজ এবং অজু—উভয়ই ভেঙে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি শব্দ করে হাসবে, সে যেন অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করে।” (সুনানে দারা কুতনি, হাদিস: ৬১২)

১৯. ইমামের আগে চলে যাওয়া

ইমামের আগে কোনো রুকন বা কাজ আদায় করে ফেলা এবং ইমামের সঙ্গে তা পুনরায় আদায় না করা নামাজকে নষ্ট করে দেয়। জামাতে নামাজের প্রধান শর্ত হলো ইমামের অনুসরণ করা (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৮৯)।

শেষ কথা

নামাজ আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেওয়ার একটি পবিত্র মুহূর্ত। তাই নামাজ নষ্ট হবার এই ১৯টি কারণ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা প্রতিটি মুমিনের জন্য আবশ্যক। এই নিয়মগুলো মূলত আমাদের নামাজের প্রতি আরও যত্নশীল এবং একাগ্র হতে শেখায়।

আমরা যখন জানব যে সামান্য অসতর্কতায় আমার এই মহান ইবাদতটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তখন আমরা আরও বেশি ‘খুশু’ ও ‘খুজু’ বা বিনয় ও মনোযোগের সাথে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে নামাজ আদায় করার তৌফিক দান করুন।