ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর ও অর্থবহ পরিবর্তন এসেছিল শান্তিপূর্ণভাবে, তবুও তা ছিল অত্যন্ত নির্ণায়ক। রাসুল মুহাম্মদ (সা.) মানুষের বিশ্বাস, আচরণ, রীতিনীতি এবং সামাজিক প্রথাগুলো পরিবর্তন করেছিলেন কেবল দয়া ও বিনম্র প্রচারণার মাধ্যমে। তিনি কাউকে তাঁর সঙ্গে একমত হতে বাধ্য করেননি এবং প্রয়োজন ছাড়া কখনো শক্তি প্রদর্শনের আশ্রয় নেননি। তাঁর নেতৃত্বের এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁকে একজন অসাধারণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মক্কার দুর্বিষহ সময়ে ধৈর্য ও সহনশীলতা
রাসুল (সা.) তাঁর দাওয়াতের প্রথম তেরো বছর মক্কায় অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় কাটিয়েছেন। তাঁর স্বদেশবাসী তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের নির্যাতন চালিয়েছিল। তবুও তিনি ধৈর্য ও নম্রতার সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করেছেন। তিনি কখনো প্রতিশোধ বা অভিশাপের পথ বেছে নেননি। তাঁর এই ধৈর্য ও সহনশীলতা তাঁর নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে সহাবস্থান করার সময় তিনি তাদের প্রতি খোলা হৃদয় ও নম্রতা প্রদর্শন করেছেন, যদিও তারা তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা ও নির্যাতন চালিয়েছিল। (ইবনে হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ,দারুল মা’রিফা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৪৩)।
মদিনায় সম্প্রদায় গঠন ও সুরক্ষা
মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.)-এর মূল লক্ষ্য ছিল একটি শক্তিশালী সম্প্রদায় গঠন ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মদিনার যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বদরের যুদ্ধ পরিকল্পিত ছিল না; উহুদের যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রতিরক্ষামূলক এবং পরিখার যুদ্ধও তাই। এই যুদ্ধগুলোতে তিনি কেবল তাঁর সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, ২০০১, পৃষ্ঠা ৩৫০)
হুদায়বিয়ার সন্ধি, যা অনেক মুসলিমের কাছে ইসলামের জন্য অপমানজনক মনে হয়েছিল, তা রাসুল (সা.)-এর দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রমাণ। তিনি জানতেন এই সন্ধি দীর্ঘমেয়াদে মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হবে। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের সময় তিনি শান্তিপূর্ণভাবে নগরী দখল করেন, কোনো রক্তপাত বা যুদ্ধ ছাড়াই। তিনি মক্কাবাসীদের, যারা বছরের পর বছর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা যেমন ইচ্ছা চলে যেতে পারো, কারণ তোমরা মুক্ত।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২,৬৮৮)
এই ঘটনা তাঁর করুণা ও ক্ষমাশীলতার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
সমাজের কুপ্রথা দূর করা
রাসুল (সা.) জাহিলিয়া যুগের গভীর-মূলীভূত ও ক্ষতিকর প্রথাগুলো দূর করেছিলেন। তিনি মানুষের মনোভাব পরিবর্তন করে পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি তাদের কুসংস্কার, ভাগ্য গণনা, যৌন নিপীড়ন এবং গোত্রীয় গর্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি তাদের হৃদয় থেকে বর্ণবাদ দূর করেছেন। যখন তাঁর সাহাবী আবু জার (রা.) বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি এমন একজন, যার মধ্যে জাহিলিয়ার কিছু অভ্যাস রয়ে গেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪,০৯২)।
তিনি কখনো শিরকের সঙ্গে আপস করেননি। তিনি শিরকের বিরুদ্ধে অটলভাবে লড়েছেন, যদিও এর জন্য তাঁকে ব্যাপক ত্যাগ ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তবুও হুদায়বিয়ার সন্ধির পর যখন তিনি উমরাহ পালনের জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন, তখন কাবার চারপাশে তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিল। তিনি সেগুলো ধ্বংস করেননি বা হস্তক্ষেপ করেননি। কারণ তিনি জানতেন, মানুষের মনে মূর্তির বিশ্বাস থাকলে তারা পুনরায় মূর্তি তৈরি করবে। তাই তিনি প্রথমে মানুষের হৃদয় ও মন থেকে শিরক দূর করার কাজ করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর, যখন অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং মূর্তিপূজার মিথ্যা সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল, তখন তিনি কাবা থেকে মূর্তিগুলো অপসারণ করেন। একজন মক্কার নেতা তখন বলেছিলেন, ‘যদি এগুলোর কোনো মূল্য থাকত, তবে এগুলো আমাদের ত্যাগ করত না।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, ২০০১, পৃষ্ঠা ৪৫০)।
দুর্বলদের ক্ষমতায়ন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা
রাসুল (সা.) দুর্বলদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন, ক্রীতদাসদের মুক্ত করেছেন, নারীদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন এবং নারীদের উপর জাহিলিয়া যুগের নিপীড়নমূলক প্রথাগুলো দূর করেছেন। তিনি শোষণমূলক প্রথা এবং নগরীর অত্যাচারীদের অহংকার ও প্রভাব বন্ধ করেছেন, সব পক্ষের জন্য ন্যূনতম কষ্ট নিশ্চিত করে। (ইবনে হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, দারুল মা’রিফা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ২৩৫)।
সহাবস্থানের শিক্ষা
মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) ইহুদি, মুশরিক এবং মুনাফিকদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর সময়ও এই সম্প্রদায়ের লোকেরা মদিনায় ছিলেন। হিজরতের নবম বছরে তাঁর প্রতি অশোভন আচরণ ও বিদ্রূপাত্মক নাম ব্যবহারকারীদের সম্বোধন করেছে নাজিল হয়েছিল সুরা হুজুরাত। এর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বেদুঈনরা বলে, ‘আমরা ইমান এনেছি।’ বলো, ‘তোমরা ইমান আনোনি; বরং বলো, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, কারণ ইমান এখনো তোমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো, তিনি তোমাদের কোনো আমলের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৪)
রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর ঢাল একজন ইহুদির কাছে ঋণের জামানত হিসেবে ছিল। তিনি তাঁর পরিবারের জন্য খাবার কেনার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর সহাবস্থানের একটি ব্যবহারিক শিক্ষা। মদিনা, ইসলামের প্রথম রাজধানী, এই বৈচিত্র্যকে ধারণ করেছিল, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে আছে। (আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ২০০২, পৃষ্ঠা ৩২০)
শেষ কথা
রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্ব ছিল ধৈর্য, করুণা ও প্রজ্ঞার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সমাজের কুপ্রথা দূর করেছেন, দুর্বলদের ক্ষমতায়ন করেছেন এবং সহাবস্থানের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা আজও আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক। আমরা যদি তাঁর নীতি অনুসরণ করি, তবে আমরা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাঁর সুন্নাহ অনুসরণের তৌফিক দিন। আমিন।