দুরুদে ইবরাহিম: নবীজির (সা.) শেখানো আমল

ইসলামের তাৎপর্যপূর্ণ আমলগুলোর মধ্যে দুরুদে ইবরাহিম অন্যতম। দুরুদটি নামাজের অংশ তো বটেই, একই সঙ্গে তা দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শান্তি, বরকত এবং আল্লাহর নৈকট্যের পথ দেখায়। প্রতিদিনই আমরা নামাজে এই দুরুদ পাঠ করি, অথচ দেখা যায়, এর তাৎপর্য, ইতিহাস এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ সম্পর্কে অনেকেরই গভীর ধারণা নেই।

দুরুদে ইবরাহিম কী?

দুরুদে ইবরাহিম হলো একটি বিশেষ দোয়া, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁদের পরিবারের প্রতি আল্লাহর রহমত ও বরকত কামনা করে পাঠ করা হয়। এটি নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর পড়া হয়। দুরুদের বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ নিম্নরূপ:

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া ‘আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা ‘আলা ইবরাহিমা ওয়া ‘আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া ‘আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা ‘আলা ইবরাহিমা ওয়া ‘আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।

অর্থ: “হে আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পরিবারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পরিবারের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহিমান্বিত। হে আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পরিবারকে বরকত দান করুন, যেমন আপনি ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পরিবারকে বরকত দান করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহিমান্বিত।”

এই দুরুদের সৌন্দর্য হলো, এটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে যুক্ত করে নবুয়তের ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে।

দুরুদের উৎস

কোরআনে আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর দুরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর ওপর দুরুদ পাঠ করো এবং যথাযথ সালাম পেশ করো।” (সুরা আহযাব, আয়াক: ৫৬)।

ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, দুরুদ পাঠ করা মুসলিমদের জন্য ফরজ, যা নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। (তাফসির ইবন কাসীর, ৭/১২৩, দারুসসালাম, রিয়াদ: ২০০০)

হাদিসে এর উৎস সম্পর্কে জানা যায়, এক দল সাহাবি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, কীভাবে তাঁর ওপর দুরুদ পাঠ করব? তিনি তাদের বলেন: “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন…।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫৭)

ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে যুক্ত করার কারণেই এই দুরুদের মর্যাদা আলাদা। কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইবরাহিমকে খলিল (বন্ধু) বলে গ্রহণ করেছেন। (সুরা নিসা, আয়াত: ১২৫)

গুরুত্ব ও ফজিলত

দুরুদে ইবরাহিম শুধু একটি দোয়া নয়, এটি আধ্যাত্মিক সংযোগের মাধ্যম। এই দুরুদ পাঠ করলে গুনাহ মাফ হয়, বরকত বাড়ে এবং দোয়া কবুল হয়। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন: “যে আমার ওপর একবার দুরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত পাঠান।” (সানান নাসাঈ, হাদিস: ১২৯৬)

হাদিসে বলা হয়েছে দুরুদ পাঠকারীর দোয়া কবুল হয়। (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ৪৮৫)

তা ছাড়া দুরুদ আমাদের মনে আশাবাদ জাগায়, রাসুল (সা.) বলেন, দুরুদ পাঠকারীকে ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩৭০)

সুতরাং দুরুদের ফজিলতের মধ্যে রয়েছে: (১) পাপ ক্ষমা, (২) উদ্বেগ দূরীকরণ, (৩) নবীর সঙ্গে নৈকট্য, (৪) কিয়ামতের দিন শাফায়াত। মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভি তাঁর বইয়ে এসব ফজিলত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। (ফাযায়েলে দুরুদ শরিফ, পৃ. ৪৫-৫০, ইদারা ইশাআত-ই-দীনিয়াত, দিল্লী: ২০০৫)

আরেকটি গ্রন্থে দুরুদের ১০০টি ফর্মের মধ্যে দুরুদে ইবরাহিমকে সর্বোচ্চ দুরুদ বলা হয়েছে। (সো দুরুদ, মাওলানা ইউনুস পালনপুরী, পৃ. ১৫, অ্যামাজন কিন্ডল এডিশন: ২০২২)

দুরুদ পাঠের মনস্তাত্ত্বিক সুবিধাও আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্মীয় আমল যেমন দোয়া পাঠ মানসিক চাপ কমায় এবং মনোযোগ বাড়ায়। যদিও সরাসরি বৈজ্ঞানিক গবেষণা দুরুদের উপর কম, তবে ধ্যানমূলক আমলের মতো এটি এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে শান্তি দেয় (যেমন, “The Power of Prayer” সম্পর্কিত গবেষণা, Journal of Religion and Health, 2018)। ইসলামী দৃষ্টিতে, এটি ঈমানকে মজবুত করে, যা জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুনরাবৃত্তিমূলক দোয়া মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে। (Benefits of Dhikr, Islamic Psychology Studies, 2022)

দুরুদকে জীবনের অংশ করুন

দুরুদে ইবরাহিম ইসলামের একটি অমূল্য উপহার, যা পাঠ করে আমরা নবীজির সঙ্গে যুক্ত হই। আধুনিক সময়ে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় ইস্যু, এই দুরুদ একটি সহজ সমাধান। শুরু করুন আজ থেকে—নামাজের বাইরে প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করুন। যেমন কুরআনে বলা, “যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ” (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫)। দুরুদ পাঠ সেই সৎকর্মের অংশ।