শেন ওয়ার্ন। সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। অনেকের চোখে সর্বকালের সেরা স্পিনারও। ২০২২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে অন্যলোকে চলে যাওয়া ওয়ার্নের আজ জন্মদিন। ক্রিকেটার হয়েও তাঁর জীবন ছিল রকস্টার কিংবা হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতাদের মতো বর্ণাঢ্য। ‘নো স্পিন’ তাঁর আত্মজীবনীর নাম, যেখানে ওয়ার্ন খুবই অকপট। নিজের শৈশব, মেলবোর্নের মতো উপশহরে বড় হওয়া, লেগ স্পিনার হওয়া, বিখ্যাত সেই ‘গ্যাটিং বল’, ইতিহাস গড়া ৭০০তম টেস্ট উইকেট, এমনকি হলিউড অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লির সঙ্গে সম্পর্ক, কিছুই লুকাননি। কিংবদন্তির জন্মদিনে চলুন পড়া যাক তাঁর আত্মজীবনী থেকে সিম্পলি দ্য বেস্ট নামে অধ্যায়টা, যেখানে ওয়ার্ন লিখেছেন নিজের জীবন নিয়ে, বেছে নিয়েছেন তাঁর চোখে অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের সেরা একাদশ।
আমার জীবনটা মন্দ কাটেনি। লড়াই করেছি, মজা করেছি—সব মিলিয়েই বেশ কেটেছে।
জেসন ও আমি কোনো রাজকীয় পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু মা-বাবা আমাদের কখনো কিছুর অভাব বোধ করতে দেননি। ভদ্রতা আর ভালো জীবনযাপনের মূল্যটা ছোটবেলা থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
এই বইয়ে আমি চেষ্টা করেছি নিজের গল্পগুলো সৎভাবে বলতে। আশা করি, তাতে পাঠকেরা আমার জীবনের কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। আমি কারও দুর্দশা বা যন্ত্রণার কারণ হইনি কখনো। তবে মজা করতে ভালোবাসি। জীবন তো আর কিছুর রিহার্সাল নয়!
এই বই লিখতে গিয়ে কিছু এমন বিষয় সামনে এসেছে, যেগুলো হয়তো আগে ভুলভাবে বোঝা হয়েছিল। মার্কের (মার্ক নিকোলাস, শেন ওয়ার্নের আত্মজীবনীর সহলেখক) সঙ্গে এক বছর ধরে এই গল্পগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেকেও নতুন করে আবিষ্কার করেছি।
মার্ক একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কি ক্রিকেট খেলাটা বদলে দিয়েছি? কে জানে, হয়তো বদলেছি, হয়তো বদলাইনি। তবে খেলাটা আমাকে বদলে দিয়েছে, এটা নিশ্চিত। যতবার আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে, ততবারই গ্যাটিংকে করা সেই বিখ্যাত বলটার প্রসঙ্গ এসেছে। অদ্ভুতভাবে, সেই সময় আমি একই সঙ্গে শিকারি ও শিকার—দুই-ই ছিলাম। সেই টেস্টের পরের রাতে আমি ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার আর ফ্রাই খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি, পাঁচ-ছয়জন আলোকচিত্রী সামনে দাঁড়িয়ে আমার খাওয়ার ছবি তুলছে। অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘তোমরা কী করছ? আমার খাওয়া নিয়ে এত আগ্রহ কেন? যাও, আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও!’
সেই থেকেই আসলে শুরু। এরপর আমার জীবনটা প্রায় এমনই হয়ে গেছে। আগেই বলেছি, এ ধরনের অবিরাম ঝুটঝামেলা সামলানো শেখার জন্য কোনো স্কুল নেই। আমিও ভুল করেছি, শিখেছি, আবার ভুল করেছি। সব সময় নিজের মতো থাকার চেষ্টা করেছি। তবে হয়তো আরও একটু বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। কারণ, কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবার সময় তখন আমার ছিল না। হ্যাঁ, ভুল করেছি। কিন্তু সেই ভুলগুলোই আমাকে আজকের আমি বানিয়েছে।
তখন আমার কখনো মনে হয়নি, ক্রিকেটে কোনো প্রভাব ফেলছি। কিন্তু এখন পেছনে তাকালে দেখি, হয়তো ফেলেছিলাম। রিস্ট স্পিন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। আমি ভালো করতে শুরু করায় সেটায় যেন নতুন প্রাণ ফিরে এল। হুট করেই ‘কুল’ হয়ে গেল লেগ স্পিন। বলাই যায়, ক্রিকেটে একটু রক অ্যান্ড রোল ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আমি চাইতাম মানুষ লেগ স্পিনের মজা বুঝুক। আমাকে দেখে অনেক বাচ্চা লেগ স্পিন করা শুরু করেছে। এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে।
স্লাইডার, গুগলি, ফ্লিপার—এসবের মধ্যে একধরনের রহস্য ছিল, যা আমি উপভোগ করতাম। আমি সেটা একটু বাড়িয়ে বলতেও ভালোবাসতাম। আর যখন এই বলগুলো উইকেট নিত, তখন সেটা সাধারণ অফ ব্রেকের চেয়ে অনেক বড় খবর হতো। তার ওপর, যে ছেলেটা এই বলগুলো করত, তার চুল রং করা, কানে দুল, পার্টি করতে ভালোবাসে—গল্প তো জমবেই!
অনেক প্রশংসা পেয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছে দুজন কিংবদন্তির অল্প কিছু কথা। একবার সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে বিল ও’রেইলি (অস্ট্রেলিয়ার আরেক কিংবদন্তি লেগ স্পিনার) লিখেছিলেন, ‘ছেলেটার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। লেগ স্পিন আবার ফিরেছে খেলায়…আশা করি ওর সঙ্গে থাকবেন।’ সবাই বলে, তাঁর ক্রিকেট দেখার চোখটা নাকি অসাধারণ ছিল।
আরেকজন কিংবদন্তি—কিথ মিলার (অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার)। সবাই তাঁকে ডাকত ‘নাগেট’। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন তিনি হুইলচেয়ারে। ইয়ান চ্যাপেল সব সময় বলতেন, আমি আর নাগেট নাকি খুব ভালো বন্ধু হতে পারতাম। ‘তোমরা একই ধরনের লোক’—এটা ছিল চ্যাপেলের কথা। যাই হোক, একটা ট্যাবলয়েডে আমাকে নিয়ে একবার একটা বিতর্কিত শিরোনাম বের হওয়ার পরপরই কিথ অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে এসেছিলেন সবার সঙ্গে দেখা করতে। সেটাই ছিল আমাদের ড্রেসিংরুমে শেষ আসা।
আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘কেমন আছ, শেন?’
বললাম, ‘ভালো আছি, মেট।’
হাসলেন একটু। তারপর বললেন, ‘ওসব বদমাশ লোকদের কথায় কান দিও না। তোমার যা ভালো লাগে, সব করো। মাঠে তুমি যা করছ আর মাঠের বাইরে যেভাবে আছ, সবই আমার ভালো লাগে। নিজের মতো থেকো।’
ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম তাঁকে। ওটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা। কিংবদন্তি কিথ মিলার।
বিল ও’রেইলি আর কিথ মিলার—এই দুজনকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা দলে না রাখাটা কঠিন। আমার সময়ের কয়েকজনও সেই দলে ঢুকতে পারেন। হেইডেন, পন্টিং, বোর্ডার, গিলক্রিস্ট, ম্যাকগ্রা—আর হয়তো আমিও!
সর্বকালের সেরা অস্ট্রেলিয়া দল নির্বাচন করাটা আমার জন্য কঠিন, কারণ পুরোনো খেলোয়াড়দের সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। তার চেয়ে বরং আমি এমন একটা দল নির্বাচন করব, যাদের সঙ্গে আমি খেলেছি।
ব্যাটিং শুরু করবে ম্যাথু হেইডেন ও মাইকেল স্ল্যাটার। তারা খেলায় এমন একটা ধারা তৈরি করেছিল, যা ঠিক আমার ভাবনার সঙ্গে মেলে—আক্রমণাত্মক, আগ্রাসী ও রোমাঞ্চকর। তিন নম্বরে রিকি পন্টিং। দুর্দান্ত স্টার্টার, ডিফেন্স আর অ্যাটাকের মধ্যে দারুণ ভারসাম্য। শর্ট বলের মাস্টার। যদিও উপমহাদেশে স্পিনের বিপক্ষে কিছুটা দুর্বল। তবু আমার মতে, ‘পান্টার’ (পন্টিংয়ের ডাকনাম) সর্বকালের সেরাদের প্রায় কাছাকাছি, লারা ও টেন্ডুলকারের চেয়ে খুব সামান্যই পিছিয়ে।
চার নম্বরে মার্ক ওয়াহ। ব্যাট হাতে তার প্রতিভা ছিল প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের, সব ধরনের বোলিং করতে পারত, পাশাপাশি ফিল্ডিং ও ক্যাচ ছিল অসাধারণ। এরপর অ্যালান বোর্ডার (এবি)। একজন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারের যা কিছু থাকা উচিত, তার সবকিছুই তার ছিল। ‘ব্যাগি গ্রিন’ (অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ক্যাপ) নিয়ে কেন এত আবেগ, তা শুধু এবির খেলা দেখলেই বোঝা যায়। যেকোনো গর্বিত অস্ট্রেলিয়ানের কাছে দেশের হয়ে খেলার মানে কী, সেটা তার খেলায় ফুটে ওঠে।
ছয় নম্বরটা বেশ কঠিন। প্রথমে স্টিভ ওয়াহর কথাই মাথায় আসে। কিন্তু তার খেলার ধরন ও গতি এবির মতো বলে মনে হলো। তাই ভিন্ন কিছু ভাবলাম। ইশ্, ‘নাগেট’ (কিথ মিলার) যদি আরেকটু তরুণ হতো! অন্য সম্ভাব্য নামগুলো হলো ডিন জোন্স, মাইক হাসি ও মাইকেল ক্লার্ক। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দিনে অসাধারণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্টিভ ওয়াহকেই বেছে নিলাম, তার অলরাউন্ডার দক্ষতার কারণে। আমাদের মধ্যে মতের অমিল ছিল, কিন্তু তার দৃঢ় মনোবল আর চাপের মধ্যে সেরাটা দেওয়ার ক্ষমতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সাত নম্বরে গিলক্রিস্ট নাকি হিলি? ব্যাট হাতে গিলক্রিস্ট প্রতিপক্ষকে একেবারে শেষ করে দিত। কিপিংয়ে হয়তো হিলির মতো নিখুঁত নয়। হিলি তো ছিল উইকেটের পেছনে এক জিনিয়াস, বিশেষ করে আমার জন্য, যখন রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য রাফের (উইকেটের রুক্ষ অংশ) ওপর বল করতাম। উমম, তাহলে কাকে বেছে নেওয়া যায়...দুঃখিত, হিলি, আমাকে গিলির (গিলক্রিস্ট) কাছেই যেতে হচ্ছে—সে ব্যাট হাতে এতটাই ধ্বংসাত্মক যে তাকে বাদ দেওয়া যায় না।
আট নম্বরে টিম মে। আগেই বলেছি, দুর্দান্ত এক বোলার ছিল। এরপর গতি আর রিভার্স সুইংয়ের জন্য ব্রেট লি এবং নিখুঁত ক্লাসের জন্য জেসন গিলেস্পি, আমার মনে হয়, এই দুজন ব্রুস রিডকে সামান্য ব্যবধানে হারিয়ে দেবে। আচ্ছা, আরেকবার ভাবি। আরে বাবা, সবাই তো ভালো বোলার! নাহ, দুঃখিত ‘বিঙ্গা’(ব্রেট লির ডাকনাম), আমি আমার মত পাল্টাচ্ছি। আমার দলে ‘চুক’ও ‘ডিজি’(রেইড ও গিলেস্পি) থাকবে। চুকের সবকিছুই ছিল, তবে তার অদ্ভুত অ্যাঙ্গেলে অতিরিক্ত বাউন্সটাই আমাকে তার দিকেই ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করছে।
আর সবশেষে, অবশ্যই ‘পিজিয়ন’(গ্লেন ম্যাকগ্রার ডাকনাম)—৫৬৩ টেস্ট উইকেট! আমাদের দুজনের মিলে ১,২৭২ উইকেট! আমি মিচেল জনসন বা রায়ান হ্যারিসের সঙ্গে খেলিনি। যদি খেলতাম, তাহলে দলটা হয়তো অন্য রকম হতে পারত। কারণ, তারা দুজনই অসাধারণ বোলার ছিল।
দ্বাদশ খেলোয়াড় মার্ভ হিউজ। আমার দেখা আর কোনো বোলারের এত বড় হৃদয় বা এমন রসবোধ ছিল না। দুর্দান্ত ক্রিকেটার, ফ্ল্যাট উইকেটের জন্য সেরা, প্রায় শূন্য থেকে ম্যাজিক দেখাতে পারত।
তাহলে আমার দলটা হলো: হেইডেন, স্ল্যাটার, পন্টিং, মার্ক ওয়াহ, বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, গিলক্রিস্ট, মে, গিলেস্পি, রিড, ম্যাকগ্রা। দ্বাদশ খেলোয়াড়: হিউজ।
আমি একই সময়ের একটি বিশ্ব একাদশ বেছে নেব। তারপরও আমি বাজি ধরব অস্ট্রেলিয়াই জিতবে। ‘পিজিয়ন’ হয়তো বলবে, ৫-০! নাহ, ‘পিজি’, ওভাবে বলে না!
আমি যখন খেলা শুরু করি, তখন ইয়ান বোথাম বা ভিভ রিচার্ডসের মতো কিংবদন্তিরা মাঠে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের সেরা সময়টা পেরিয়ে গেছে। তাই বিশ্ব একাদশ বাছাই করার নিয়মটা একটু পাল্টে নিই—আমি শুধু তাঁদেরই নেব, যাঁদের বিপক্ষে বা পাশে খেলেছি। সময়সীমা হবে জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে জানুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত। একাদশ নয়, পুরো সফরের জন্য ১৬ জনের একটা স্কোয়াডই বানাচ্ছি।
একজন ওপেনার নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই—হেইডেন। ভয়ংকর শক্তি, বোলারদের জন্য আতঙ্ক। ওর সঙ্গে একজন ডানহাতি চাই। এরপর স্ল্যাটস (স্ল্যাটার), গ্রাহাম গুচ, সাঈদ আনোয়ার ও বীরেন্দর শেবাগ—এদের মধ্যে থেকে একজন। আমি একজন ডানহাতি আর একজন বাঁহাতি ওপেনার চাই, তাই আনোয়ার বাদ পড়ে গেল। তবে ক্রিকেট বলে অসাধারণ ‘টাইমার’ ছিল সে।
গুচকে আমি পেয়েছিলাম তাঁর ক্যারিয়ারের শেষের দিকে। কিন্তু তিনিই আমার বিপক্ষে খেলা সেরা ইংলিশ ব্যাটসম্যান। শেবাগ কঠিন পিচে খুব ভালো এবং ভারতের পিচে অসাধারণ। তাই স্ল্যাটসের বদলে শেবাগকেই আমি বেছে নিলাম। সে বোলারদের ওপর দারুণ চাপ তৈরি করত। আসলে, দুজনই সেটা করত। তবে আমার দলে ওপেনার হেইডেন ও শেবাগ। ইনিংসের শুরুটা হবে একেবারে ‘ফায়ারক্র্যাকার’ দিয়ে।
তিন নম্বরের জন্য তিনজন প্রার্থী—রিকি, সবচেয়ে বিস্ফোরক; জ্যাক ক্যালিস, সবচেয়ে নিখুঁত; কুমার সাঙ্গাকারা, সবচেয়ে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও নমনীয়। এই তিনজনই আমার ট্যুরিং পার্টিতে থাকবে। তবে আমি তিন নম্বরে রিকিকেই (পন্টিং) রাখব, কারণ সে খেলাটা শুরু ও শেষ করে আসতে পারে।
পরের দুটি পজিশনে কারা থাকবে, এই বইয়ের আগের অধ্যায় থেকেই পরিষ্কার। আমার সময়ের সেরা দুই ব্যাটসম্যান নিঃসন্দেহে টেন্ডুলকার ও লারা। আমরা তাদের জন্য কোনো পরিকল্পনা করতে পারতাম না। শুধু বলতাম, ‘স্টাম্পের ওপরে বল করো।’ মাঝেমধ্যে ব্যর্থ হতো তারা, কিন্তু বেশির ভাগ সময় ছিল অবিশ্বাস্য। টেন্ডুলকার টেকনিকের মাস্টার, লারা ম্যাচ জেতানোর।
ছয় নম্বরে আমি একজন অলরাউন্ডার চাই। ইমরান খান, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথামের সময়টা মিস করেছি। দুঃখের বিষয়, তাদের কারও বিপক্ষেই আমি কখনো খেলিনি। কিন্তু কালিসকে পেয়েছি। ব্যাটে ধৈর্য, বলে শৃঙ্খলা, স্লিপে ক্যাচ—যেন তিনজন খেলোয়াড় এক শরীরে। গত পঁচিশ বছরের কোনো একাদশ বানালে ওকে বাদ দেওয়া যাবে না।
উইকেটকিপার বেছে নেওয়া কঠিন। হিলি দুর্দান্ত গ্লাভসম্যান, গিলক্রিস্ট ব্যাটে বিধ্বংসী, সাঙ্গাকারা দুটোই পারে। তবে এই দলে আগেই ব্যাটসম্যানে ঠাসা। তবু শেষ পর্যন্ত আবারও গিলক্রিস্টকেই নিলাম—ওর ব্যাটের তাণ্ডব মিস করার ঝুঁকি না নিই।
এরপর ওয়াসিম আকরাম। অবিশ্বাস্য বোলার। পিচ তার জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না—বাতাসে সে এতটাই দ্রুত ছিল। নতুন ও পুরোনো বলে সে সুইং করাতে পারত, অর্থোডক্স ও রিভার্স—দুটিই। ইয়র্কার দিয়ে পায়ের হাড় ভাঙত, বাউন্সার দিয়ে হেলমেট। একা হাতে ম্যাচ জেতাতে পারত। এ দলে সে-ই অধিনায়ক।
নয় নম্বরে অনিল কুম্বলে। দক্ষতা তো ছিলই, তার চেয়ে বেশি তার মানসিকতা ও প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতার কারণে। এরপর কার্টলি অ্যামব্রোস ও গ্লেন ম্যাকগ্রা। ওয়াকার, শোয়েব, শন পোলক ও কোর্টনি ওয়ালশদের চেয়ে তারা সামান্য এগিয়ে। দুজনই নিখুঁত লাইন-লেংথের কারিগর, ম্যাচ বাঁচিয়ে রাখতেও পারত, শেষও করে দিতে পারত। পার্থে অ্যামব্রোসের ৭/১—মনে পড়লেই শিউরে উঠি। ম্যাকগ্রা তো আমার সঙ্গী, তাকে ছাড়া দলই অসম্পূর্ণ।
তাহলে গ্যাবায় সফরের প্রথম টেস্টের জন্য আমার একাদশ দাঁড়াচ্ছে: হেইডেন, শেবাগ, পন্টিং, টেন্ডুলকার, লারা, ক্যালিস, গিলক্রিস্ট, আকরাম (অধিনায়ক), কুম্বলে, অ্যামব্রোস ও ম্যাকগ্রা।
যেহেতু আমরা সফরে যাচ্ছি, আমার কিছু ব্যাকআপ লাগবে। সাঙ্গাকারা নিশ্চিতভাবেই থাকবে। এক থেকে ছয় নম্বরের যেকোনো পজিশনে ব্যাট করতে পারে, কিপিং করে আবার দারুণ ফিল্ডিংও করে। মজার ব্যাপার, কিপিং করলে তার ব্যাটিং অ্যাভারেজ ৪০.৪৮, আর কিপিং না করলে ৬৬.৭৮! তবু, আমার দ্বিতীয় কিপার ও-ই।
আরেকজন রিজার্ভ ব্যাটসম্যান হবে কেভিন পিটারসেন। ওর স্টাইল, ম্যাচ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা—সবই ভালো লাগে। আর ওর ইতিবাচক মানসিকতা তো দলের জন্য বাড়তি পাওয়া।
মুরালি দ্বিতীয় স্পিনার হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার আরও দুজন অতিরিক্ত ফাস্ট বোলার লাগবে। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। ২০০৫ সালে তার সেরা সময়ে শুধু দারুণ বোলিংই করেনি, দ্রুত রান করেছে। পোলকও তার অসাধারণ অলরাউন্ড দক্ষতার কারণে আরেকজন প্রার্থী। ফ্লিনটফের প্রতি আমি সামান্য পক্ষপাতী। কিন্তু...কিন্তু...কিন্তু...কিন্তু...ওয়াকার ইউনিস। দারুণ এক বোলার! রিভার্স সুইংয়ে সেরা, টেলএন্ডারদের ধ্বংস করে দিতে তার জুড়ি নেই।
আমার শেষ পছন্দটি একটু অপ্রত্যাশিত, কিন্তু আমি তাকে দলে চাই। শোয়েব আখতার। আমি যাদের বিপক্ষে খেলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিল সে। দারুণ মানুষ, মজাও হবে ও থাকলে!
তাই রিজার্ভ বেঞ্চে আমার শেষ পাঁচজন হলো: সাঙ্গাকারা, পিটারসেন, মুরালিধরন, ওয়াকার ও শোয়েব।
এই দল, মানে ‘ওয়ার্নের ওয়ারিয়র্স’কে হারানো প্রায় অসম্ভব। তাহলে, কে খেলতে প্রস্তুত?
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওয়ার্নের অভিষেক ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে, ভারতের বিপক্ষে সিডনি টেস্টে। ১৫ বছর পর যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, তাঁর নামের পাশে ১৪৫ টেস্টে ৭০৮ উইকেট। এই ফাঁকে ১৯৪ ওয়ানডে খেলে পান ২৯৩ উইকেটও। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জিতেছেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে, ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হয়েছেন ম্যাচসেরাও। লেগ স্পিনের এই জাদুকর ক্রিকেট বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়ে হৃদ্রোগে মারা যান ২০২২ সালে, থাইল্যান্ডের কো সামুই দ্বীপে ছুটি কাটাতে গিয়ে।