
২০২১ সালের আগস্টে দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবানরা। এরপরই জন্মভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন দেশটির নারী ফুটবল দলের সদস্যরা। চার বছর পর তাঁদের কয়েকজন আবার দেশের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছেন। তবে এবার তাঁরা খেলছেন শরণার্থী হিসেবে।
এই টুর্নামেন্ট আফগান মেয়েদের জন্য একরকম পুনর্জন্ম। বৈশ্বিক অঙ্গনে জাতীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পথে এটি তাদের প্রথম ধাপ। নিজেদের পরিচয় তাঁরা দিচ্ছেন ‘আফগান উইমেন ইউনাইটেড’ নামে।
ইতালিতে বসবাস করা দলের অধিনায়ক ফাতিমা হায়দারি বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ‘একসঙ্গে দেখা হওয়া, জড়িয়ে ধরা, একসঙ্গে খেলা—এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না। খেলোয়াড় হিসেবে জানি, জীবনে চ্যালেঞ্জ আসবেই, কষ্ট আসবেই। কিন্তু সব সময়ই উত্তরণের একটা পথ থাকে। হাল ছাড়লে চলবে না, কখনোই না।’
চার দল নিয়ে মরক্কোয় এক প্রীতি টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে ফিফা। অংশ নিচ্ছে চাদ, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের শরণার্থী ফুটবলারদের দল। গত রোববার শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতাটি।
আফগানিস্তান নারী দলের সাবেক অধিনায়ক খালিদা পোপাল, তাঁর সাবেক সতীর্থ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এই টুর্নামেন্ট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। লক্ষ্য ছিল একটাই—আফগান নারী ফুটবলারদের আবার মাঠে ফেরানো।
পোপাল বলেন, ‘অগণিত বাধা আর চ্যালেঞ্জের পর চার বছর পেরিয়ে মেয়েরা আবারও আফগান দল হিসেবে ফুটবল খেলছে। যদিও দলের নামে এখনো কোনো দেশের নাম নেই। তবু এটা ভালো লাগার মতো একটা শুরু। তবে যথেষ্ট নয়।’
শুরুতে টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল দুবাইয়ে, যেখানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল চাদ, লিবিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় থাকা আফগান কিছু ফুটবলার ভিসা না পাওয়ায় জায়গা বদল হয়। ফিফা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু জানায়নি।
২০১৮ সালে সর্বশেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছিল আফগানিস্তান। ২০২১ সালে তালেবান শাসন ফেরার পর মেয়েদের সব ধরনের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগেই দেশটির ফুটবল ফেডারেশন জড়িয়েছিল ভয়াবহ কেলেঙ্কারিতে। নারী ফুটবলারদের ওপর ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হন তৎকালীন সভাপতি কেরামুদ্দিন কেমার। ফিফা তাঁকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর বহু নারী খেলোয়াড় দেশ ছেড়ে পালান। কেউ কেউ শনাক্ত না হওয়ার জন্য নিজের জার্সিই পুড়িয়ে ফেলেন। ভয়, রাগ আর লজ্জা—সব মিলিয়ে যেন গলার ভেতর জমে থাকা এক দীর্ঘ আর্তনাদ।
ফাতিমা হায়দারি বলেন, ‘আমরা এমন কিছু পার করেছি, যা ভাবতেও ভয় লাগে। নিজের দেশ, বন্ধু, পরিবার—সব ফেলে এসেছি। এখনো কিছু মেয়েকে খেলতে না দেখতে পারা কষ্ট দেয়। আমরা তাদের কণ্ঠস্বর হতে চাই।’
আফগান মেয়েদের দলের কিছু খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ ইউরোপে, কেউবা আমেরিকায় আছেন। দলের কোচ পলিন হামিল জানান, ফিফা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে ক্যাম্প করে ৭০ জন খেলোয়াড়কে ডেকেছিল। পরে সেই তালিকা থেকে ২৩ জনকে বেছে নেওয়া হয় মরক্কো টুর্নামেন্টের জন্য।
হামিল বলেন, ‘আমরা দেখাতে চাই, ভবিষ্যতে কী করতে পারি। আমাদের সম্ভাবনা তুলে ধরতে চাই। মাঠে ফেরাটাই বড় জয়, আর এই টুর্নামেন্ট আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ।’
নারী ফুটবল নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি ফিফা, তবে আফগান ফুটবল ফেডারেশনকেও নিষিদ্ধ করেনি। গত মে মাসে ফিফা কাউন্সিল ‘আফগান নারী ফুটবলের জন্য কর্মপরিকল্পনা’ অনুমোদন করেছে। তবু আফগান মেয়েরা এখনো বিশ্বকাপ বা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে অংশ নিতে পারেন না।
খালিদা পোপাল বলেন, ‘আমরা চাই আফগান নারী দল ও স্বাধীন ফুটবল ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃতি। যাতে মেয়েদের মুখ বন্ধ না করা হয় এবং তারা নিজেরাই নিজেদের পথ নির্ধারণ করতে পারে।’
গত রোববার কাসাব্লাঙ্কায় চাদের কাছে ৬–১ গোলে হেরেছে আফগান উইমেন ইউনাইটেড দল। দলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন মানোজ নূরী। কিন্তু এই ম্যাচের ফল নিয়ে কারও আক্ষেপ নেই।
অধিনায়ক হায়দারির কণ্ঠে শুধু দৃঢ়তা, ‘আমি এখন নিরাপদ। নিজেকে মুক্ত মনে হয়। আমি শুধু খেলতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই। এটা শুধু আমার স্বপ্ন নয়—এটা সেই সব আফগান মেয়েদের স্বপ্ন, যারা এখনো ফুটবল খেলতে চায়।’