প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে কোচদের কয়েকজন
প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে কোচদের কয়েকজন

ফুটবল কোচের চাকরি: কেন কেউ চায়, কেন কেউ ফেরায়

প্রিমিয়ার লিগে কোনো ক্লাবের কোচের পদ খালি হলেই (যা বেশ ঘন ঘনই হয়) আলাপ শুরু হয়, নতুন কোচ কে হতে যাচ্ছেন? গুঞ্জন শুরু হয়, নানাজনের নাম আসে। সবচেয়ে বেশি আসে ঠিক ওই সময়ে যাঁরা চাকরিহীন বা ‘বেকার’ আছেন, সেই সব কোচের নাম।

অন্য যেকোনো বেকার মানুষের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা চাকরি পাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার। ফুটবল কোচদের ক্ষেত্রেও কি তা-ই? বেকার থাকলেই কি নতুন প্রস্তাব পেলে ‘হ্যাঁ’ বলে দেন কোচরা?

উদাহরণ হিসেবে ধরুন গ্যারি ও’নিলকে। উলভারহ্যাম্পটন তাঁকে বিদায় করে দেওয়ার পর প্রায় এক বছর তিনি চাকরিহীন। দল পয়েন্ট তালিকার ১৯ নম্বরে নেমে যাওয়ার পর গত বছর ডিসেম্বরে তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নিয়ে উলভসকে অবনমন থেকে বাঁচিয়ে দেন ভিতর পেরেইরা। কিন্তু এই মৌসুমে সেই পেরেইরার অধীনে আবার ২০ নম্বরে নেমে গেছে উলভস। গত ২ নভেম্বর তাই বরখাস্ত হয়েছেন পেরেইরা। তারপর ক্লাব আবার ও’নিলকে প্রস্তাব দিয়েছিল কোচের দায়িত্বে ফিরে আসার জন্য।

গ্যারি ও’নিল ফিরিয়ে দিয়েছেন উলভসে ফেরার প্রস্তাব

ও’নিলের হারানোর কিছু ছিল না। পয়েন্ট তালিকায় ২০-এর নিচে তো আর নামা সম্ভব নয়। কিন্তু চাকরিটা নিলেন না ৪২ বছর বয়সী কোচ। তিনি মনে করেছেন, এই মুহূর্তে এটা তাঁর জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। বেকার থাকারই সিদ্ধান্ত নিলেন।

আচ্ছা, নতুন চাকরির প্রস্তাব পাওয়ার পর একজন বেকার কোচের মাথায় কী কী বিষয় ঘুরতে থাকে? কে জানে, ও’নিল হয়তো ভেবেছেন উলভসকে যদি তিনি অবনমন অঞ্চল থেকে টেনে তুলতে না পারেন, আবার বেকার হয়ে যেতে হবে এবং তারপর হয়তো আর কখনো তাঁর জন্য প্রিমিয়ার লিগের দরজাই খুলবে না। হয়তো এ ভেবেই সম্মান হারানোর ঝুঁকিটা নিতে চাননি।

গ্যারি নেভিল

আবার কেউ কেউ ঝুঁকি নেন। জেনেবুঝেই নেন। ২০১৫ সালে ভ্যালেন্সিয়ার দায়িত্ব নেওয়ার সময় গ্যারি নেভিলের যেমন মনে হয়েছিল, সুযোগটা যদি ফিরিয়ে দেন, তাহলে তাঁর নিজের সুনামই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নেভিল বলেছিলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটা প্রস্তাব পেয়েছি, কিন্তু সময়টা কখনোই ঠিক ছিল না। গত কয়েক বছর টিভিতে বসে অন্যদের বিশ্লেষণ করেছি, এখন সময় এসেছে নিজে কিছু করার। যদি এই চ্যালেঞ্জটা না নিতাম, নিজেকে কোচ বলার মুখ থাকত না।’

পদটা ‘ফুটবল কোচ’ হলেও লিগভেদে কিংবা ক্লাবভেদে সেটার মর্যাদা কিন্তু আলাদা। যেমন লিভারপুল বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাক মানে অন্য রকম আকর্ষণ। ইতিহাসের ভার সেখানে এখনো টানে। যদিও ইউনাইটেডের সেই সোনালি যুগ আর নেই, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সময়টা তো পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনার লোভ কে সামলায়? ‘ফুটবল ম্যানেজার’ গেমে যাঁরা তুরিনো, বুদাপেস্ট হনভেদ বা বোর্দো নিয়ে খেলেছেন, তাঁরা জানেন কেমন লাগে এমন দায়িত্ব নিতে।

রুবেন আমোরিম গত মৌসুমের মাঝামাঝি ইউনাইটেডে যোগ দেন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এই ক্লাবের ইতিহাস আমাকে টেনেছে। এখানে সবাই সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত। আমি অনুভব করেছি, এই ক্ষুধার অংশ হতে চাই আমি নিজেও। এখানেই আমি বিশেষ কিছুর অংশ হতে পারব। এটা কোনো সাধারণ ক্লাব নয়।’

রুবেন আমোরিম।

ইয়ুর্গেন ক্লপ যখন ২০১৫ সালে লিভারপুলের দায়িত্ব নিলেন, তাঁকেও তো অ্যানফিল্ডের ইতিহাস আর রোমাঞ্চই বেশি টেনেছিল। লিভারপুল তখন পয়েন্ট তালিকার দশে। সে জন্যই দায়িত্ব নিয়ে ক্লপ বলেছিলেন, ‘এই ক্লাবের বিশালতা, আবেগ সবকিছুই আমাকে টেনেছে। আমি ফুটবল রোমান্টিক। অন্য অনেক ক্লাবের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, কিন্তু ওদের কথায় ফুটবলের গন্ধ ছিল না। মনে হচ্ছিল, সবটাই বাজারজাতকরণ—এই খেলোয়াড়কে নিতে হবে, ওই চুক্তি করতে হবে। আমার মনে হয়েছে, এটা তো সেই খেলা নয়, যেটা আমি ভালোবাসি। লিভারপুল যখন নিজেদের সমস্যার কথা বলল, বুঝেছিলাম, আমিই হয়তো তাদের জন্য সঠিক মানুষ। এটা একটা ফুটবল ক্লাব…সত্যিকারের ফুটবল ক্লাব।’

অবশ্য ক্লপের সেই রোমান্টিকতা কিছুদিন আগেই রেড বুলের মতো একটা ক্লাবে যোগ দেওয়ায় কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভাগ্য কত রকম পথ দেখায়!

ক্লপ আগেই বলে রেখেছেন, ইংল্যান্ডে আর কোনো ক্লাবের কোচ হবেন না। কখনো ফিরলে শুধুই লিভারপুলে। মানে, তাঁকে যদি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, চেলসি কিংবা ম্যানচেস্টার সিটি ডাকেও, তিনি নীতির কারণেই ফিরিয়ে দেবেন। আর্সেন ওয়েঙ্গারও আর্সেনাল ছাড়ার পর একই কথা বলেছিলেন, ‘আমি আর্সেনালের মানুষ। তাই ইংল্যান্ডে আর কোনো দলের দায়িত্ব নেব না। অনেক প্রস্তাব পেয়েছি, ফিরিয়েও দিয়েছি।’

ইংল্যান্ডে লিভারপুল ছাড়া আর কোনো ক্লাবের কোচ হবেন না, এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ

কখনো কখনো একটা ক্লাব এতই আপন হয়ে ওঠে! তখন আর অন্য কারও হতে মন চায় না।
তবে বড় ক্লাবের ঐতিহ্য যেমন আকর্ষণ করে, তেমনি ভয়ও দেখায়। টমাস ফ্রাঙ্ক যেমন। ব্রেন্টফোর্ডে থাকতে চার মৌসুম সময় নিয়ে নাকি ভেবেছেন, এরপর যদি অন্য কোনো ক্লাবের দায়িত্ব নিতে হয়, কোনটা ভালো হবে তাঁর জন্য। একসময় ইউনাইটেডসহ অনেক বড় ক্লাবই তাঁকে চেয়েছিল। ফ্রাঙ্ক অনেক ভেবেচিন্তে ব্রেন্টফোর্ড ছেড়ে টটেনহামে গেছেন।

ডেনিশ এই কোচ একবার বলেছিলেন, ‘বড় ক্লাবের কোচ হলেই যে জীবন সুখী হয়ে যাবে, এমন নয়। সেখানে সুখ বাড়ে না, চাপই বাড়ে। আমি জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। জাতীয় দলের হয়ে কাজ করতে গিয়ে টানা পাঁচ বছর সন্তানের জন্মদিনে পাশে থাকতে পারিনি। ৩০ বছর ধরে সপ্তাহে ৬০-৭০ ঘণ্টা কাজ করেছি। অন্য কোনো চাকরিতে গেলে কেমন হবে, সেটা আপনি জানেন না। আবার নতুন এক দৌড়ে নামতে চাই কি না, সেই ভাবনাটা কঠিন।’

ভাষাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। ওটমার হিটজফেল্ড ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর ইংরেজি যথেষ্ট ভালো ছিল না। বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আমাকে যদি ইংরেজিতে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাহলে আমি তাদের কাছে আমার আবেগ আর অনুভূতি সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারব না।’

রেঞ্জার্সে ফেরার প্রস্তাব পেয়েও স্টিভেন জেরার্ড ফিরিয়ে দিয়েছেন

পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণও থাকে। পরিবার, শহর, মানিয়ে নেওয়ার পরিবেশ—সবই গুরুত্ব পায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। রেঞ্জার্সে ফেরার প্রস্তাব পেয়েও স্টিভেন জেরার্ড তাই সময় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সময়টা সঠিক ছিল না। আমার পরিবার তখন বাহরাইনে। ভাবার সময়ও কম ছিল।’
নতুন ক্লাবের মালিকদের সঙ্গে বোঝাপড়াও জরুরি। একবার এক প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব নাকি কোচকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘আমরা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দলে নেব!’ শুনেই সেই কোচ চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। দুই বছর পর যখন এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদে গেলেন, তিনি বুঝলেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সময়ও অনেক কিছু ঠিক করে দেয়। গ্রাহাম পটার একাধিকবার লেস্টার সিটিতে যোগ দেওয়ার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে ব্রেন্ডন রজার্স বিদায় নেওয়ার পর একবার, আর ডিন স্মিথ যাওয়ার পর আরেকবার। কিন্তু পটারের নিজের দল–স্টাফদের নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। শেষে গেলেন ওয়েস্ট হামে। কী পরিণতি হয়েছিল তাঁর, তা তো সবারই বোধ হয় জানা। ৯ মাসও টেকেননি!

চেলসির সাবেক কোচ গ্রাহাম পটার

সবশেষে আসে ‘মনের টান’। নিজের পুরোনো ক্লাব ডাকলে, না বলা কখনো কখনো কঠিন। আবার এই যোগসূত্র অনেকের জন্য বড় সুযোগও। ওলে গুনার সুলশার, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, কেনি ডালগ্লিশ—তাঁরা কি নিজেদের ক্লাব ছাড়া অন্য কোথাও এত সহজে সুযোগ পেতেন? কিংবা ৭৩ বছর বয়সে মার্টিন ও’নিল কি সেল্টিক না হয়ে অন্য কোনো ক্লাব ডাকলে কোচিংয়ে ফিরতেন? ছয় বছর ফুটবলের বাইরে থাকার পর!

কেন কেউ ‘হ্যাঁ’ বলেন, কেন কেউ ‘না’, সব সময় আসলে এই হিসাব মেলানো যায় না।
ফুটবলের কিছু সিদ্ধান্ত শুধু হৃদয়ই ঠিক করে দেয়।