
বোর্ডের ওপর সাজানো সাদা-কালো ঘুঁটি। একপাশে বসে সাড়ে ৯ বছরের খুদে এক কিশোর। চোখে শিশুসুলভ কৌতূহল। বিপরীতে রাশিয়ার নামী গ্র্যান্ডমাস্টার আনাতোলি লতিকভ। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব, সময়টা ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর। ২০ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৯ জন হেরেছিলেন লতিকভের কাছে। হারেনি শুধু একজন, সেই ছোট্ট ছেলেটি ড্র করেছিল লতিকভের সঙ্গে। ৯ বছর বয়সেই সবাইকে চমকে দেওয়া ছেলেটিই পরে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের গর্ব। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার—নিয়াজ মোরশেদ।
সেই ছোটবেলা থেকে যে সাদা-কালো বোর্ডের সঙ্গে মন আটকে ফেলেছেন, সেখান থেকে এখনো বের হতে পারেননি। এখনো চলছে নিয়াজ মোরশেদের দাবাজীবন। এই ডিসেম্বরে পূর্ণ হয়েছে তাঁর দাবাজীবনের ৫০ বছর।
তিনি চাইলে আমাকে হারাতে পারতেন, কিন্তু হারাননি। বুঝতে পেরেছিলেন আমার মধ্যে দাবার কিছু আছে। একপর্যায়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমি তা হইনি। তখন দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী পাশ থেকে বললেন, “তুই ড্রয়ের অফার দে।” যে অফার পেয়ে লতিকভ প্রথমে মুচকি হাসলেন, পরে বললেন, “ওকে।” তার আগে সব বোর্ডের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল।নিয়াজ মোরশেদ, বাংলাদেশের কিংবদন্তি দাবা খেলোয়াড়
লতিকভের সঙ্গে সেই ম্যাচ ছিল প্রদর্শনী, মূলত সাংবাদিকদের জন্য। তবু ছোট্ট নিয়াজ তাতে অংশ নেন। দ্বিতীয় জাতীয় দাবার বাছাইপর্বের পর বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন লতিকভকে ঢাকায় আনে। তখন ৫ রাউন্ডের বাছাইয়ে মাত্র ২ পয়েন্ট পাওয়া নিয়াজের প্রথম বিদেশি কারও সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা হয়। পরে লতিকভ প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, যেখানে একই সময়ে আলাদা বোর্ডে ৪০ জন দাবাড়ুর বিপক্ষে খেলেন এই গ্র্যান্ডমাস্টার।
রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে খেলার স্মৃতি নিয়াজের কাছে আজও জ্বলজ্বলে, ‘সেই ড্রয়ে পাওয়া প্রচার আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছিল। এমন উৎসাহ মানুষের জীবনও বদলে দিতে পারে।’ নিয়াজ ফিরে যান সেই দিনটিতেও, ‘সকালে লতিকভের সঙ্গে খেলা। আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। তখন আমার এক মামা ঢাকায় আমাদের বাসায় ছিলেন, তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন প্রেসক্লাবে। যাত্রাপথে অতিরিক্ত রোমাঞ্চে আমি তাঁর হাত থেকে ছুটে গিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একটি ট্রাকের নিচে প্রায় চাপা পড়তে বসেছিলাম।’
লতিকভের সঙ্গে ড্র করার ব্যাপারটা নিয়াজের মামা মাকে বলেননি। বলেছেন শুধু ট্রাকের নিচে চাপা পড়তে যাওয়ার ঘটনাটা। মা ছেলেকে মার দেন। কিন্তু সন্ধ্যায় নিয়াজের বাবার লন্ডনফেরত এক বন্ধু বাসায় এসে জানান, আজ প্রেসক্লাবে ৯ বছরের এক ছেলে রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করেছে। টিভিতেও খবর এসেছে। লতিকভ বলেছেন, এই ছেলে গ্র্যান্ডমাস্টার হবে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
নিয়াজের বাবাকে তাঁর ওই বন্ধু বলেন, ‘ছেলেটার নাম তোমার ছেলের নামে।’ তখনই নিয়াজের মায়ের মনে হলো, ‘আরে এ তো আমার ছেলে!’ সবাই বেশ খুশি হয়ে ছোট্ট নিয়াজকে চকলেট দেন। ‘আমার দাবাড়ু হওয়ার পেছনে এ ঘটনা বিরাট প্রভাব ফেলেছে’—সেই স্মৃতি এত দিন পরও রোমাঞ্চ জাগায় নিয়াজের মনে।
১৯৭৪ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পাওয়া লতিকভ ৫৬ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে মারা যান। নিয়াজ স্মরণ করেন প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টারকে, ‘তিনি চাইলে আমাকে হারাতে পারতেন, কিন্তু হারাননি। বুঝতে পেরেছিলেন আমার মধ্যে দাবার কিছু আছে। একপর্যায়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমি তা হইনি। তখন দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী পাশ থেকে বললেন, “তুই ড্রয়ের অফার দে।” যে অফার পেয়ে লতিকভ প্রথমে মুচকি হাসলেন, পরে বললেন, “ওকে।” তার আগে সব বোর্ডের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল।’
পাড়ার বড়দের কাছে দাবা শিখেছেন নিয়াজ। পেছন ফিরে বললেন, ‘জামিলুর রহমান ভাই, ফরহাদ ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। মূলত ফরহাদ ভাই-ই আমাকে দাবা শিখিয়েছেন। তাঁর বন্ধু আলী ইশতিয়াক ও আলী ইফতেখার জাতীয় দাবায় খেলতে আমার নাম সুপারিশ করেন। এভাবেই ১৯৭৫ সালে আমি জাতীয় দাবায় খেলতে গিয়েছিলাম।’
শুধু দাবায় মন দিলে আরও এগোতে পারতাম। মেধার পাশাপাশি জীবনে সঠিক সিদ্ধান্তও জরুরি।নিয়াজ মোরশেদ, বাংলাদেশের কিংবদন্তি দাবা খেলোয়াড়
১৯৭৭ সালে তৃতীয় জাতীয় বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত পর্বে ১৬ জনের মধ্যে অষ্টম হন নিয়াজ। পরের বছর তৃতীয়। ১৯৭৯ সালে মাত্র ১২ বছর ১১ মাস বয়সে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। টানা চারবার জয়ী হওয়ায় ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় দাবায় খেলতে হয়নি; জাতীয় দলে সরাসরি জায়গা পেয়েছেন। এরপরও চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন, কিন্তু দাবা খেলা ছাড়েননি। ৫০ বছরের যাত্রায় ৫৯ বছর বয়সে গত অক্টোবরে সপ্তমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কদিন আগে প্রিমিয়ার দাবা লিগে তিতাস ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৮১ সালে মাত্র ১৫ বছর ৫ মাস বয়সে দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) হয়েছিলেন। এশিয়ারও সবচেয়ে কম বয়সী আইএম নিয়াজ। ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া নিয়াজকে তুলে নেয় অনেক উঁচুতে। তাঁর আগে গোটা এশিয়ায় গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন মাত্র চারজন। নিয়াজের পর এশিয়ার ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ, যিনি পরে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
নিয়াজ মোরশেদের বড় প্রেরণা ছিলেন তাঁর মা নাজমা আহমেদ। ১৯৯২ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মা মারা যান। মাকে ভুলতে পারেন না নিয়াজ, ভুলতে পারেন না আরও কয়েকজনের অবদানও, ‘দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন মোহাম্মদ রেজা হাই স্যার শুধু দাবাই নয়, জীবনের মূল্যবোধও শিখিয়েছেন। সালেহ চৌধুরীর সমর্থনও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা না থাকলে এত দ্রুত গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারতাম না। ১৯৮৪ সালে হংকংয়ে দ্বিতীয় কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে আমাকে পাঠাতে চাইছিল না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। তখন যুব ও ক্রীড়াসচিব আসাফউদ্দৌলার হস্তক্ষেপেই টুর্নামেন্টে যাই এবং প্রথম জিএম নর্ম করি।’
৫০ বছরের যাত্রাপথে নিয়াজের অনুভূতি অম্লমধুর। আনন্দের মধ্যেই আবার আছে অপূর্ণতা, ‘শুধু দাবায় মন দিলে আরও এগোতে পারতাম। মেধার পাশাপাশি জীবনে সঠিক সিদ্ধান্তও জরুরি।’ যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়াকে বড় ভুল মনে করেন নিয়াজ। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সময়ই পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে চার বছরের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় একটানা খেলা হয়নি, যা তাঁর ক্যারিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তবে ৫০ বছরের এই যাত্রা নিয়াজের কাছে রোমাঞ্চকর ও বর্ণাঢ্য, ‘৪০-৫০টা দেশে গেছি, কয়েক শ টুর্নামেন্ট খেলেছি। অনেক স্মরণীয় ম্যাচ আছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়ায় (এখন সার্বিয়া) অলিম্পিয়াডের দ্বিতীয় রাউন্ডে বুলগেরিয়ার ১ নম্বর খেলোয়াড় কিরিল জর্জিয়েভকে হারিয়েছিলাম। ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় জয় এটি। বুলগেরিয়ার কাছে আমরা হেরেছিলাম আড়াই-দেড় পয়েন্টে। আমি খেলেছিলাম ১ নম্বর বোর্ডে।’
নিয়াজ স্প্যানিশ, রুশ, ফ্রেঞ্চ ভাষা কিছুটা জানেন। গান গাইতে ভালোবাসেন। গানের ক্যাসেট বের করেছেন। কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। বহুমুখী প্রতিভায় অনন্য এই দাবাড়ু ৫০ বছর ধরে সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে।