
গত শতাব্দীর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার টেলিভিশন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। আর ১৯২৮ সালে জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি তিন ইঞ্চি পর্দার প্রথম যান্ত্রিক টেলিভিশন জনসমক্ষে নিয়ে আসে। এই টিভির নামকরণ করা হয় ‘অক্টাগন টেলিভিশন’। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে তৈরি হয় ‘বেয়ার্ড টিভি’। এ টিভিতেই প্রথম বেতারের মাধ্যমে চলমান চিত্র দেখা যায়।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই তো কিছুদিন আগেই আমরা সাদাকালো টিভি দেখতাম।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের নস্টালজিয়া শুরুই হয়েছিল সেই সাদাকালো যুগে। স্বাধীনতার পর ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ছিল একমাত্র চ্যানেল। সাদা আর কালো ছবির মধ্য দিয়ে টিভিতে নাটক, সংবাদ আর সিনেমা দেখাই ছিল সে সময়ের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। আশির দশকে যখন দেশে রঙিন টেলিভিশন আসে, তখন সেটি ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। রঙিন ছবির আকর্ষণ সবাইকে টিভির সামনে আরও বেশি করে টেনে আনল।
এরপর শুরু হয় কেব্ল টিভির যুগ। বিদেশি চ্যানেলের আগমন বদলে দেয় টিভি দেখার অভ্যাস। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ডিশ অ্যানটেনার কল্যাণে মানুষ প্রথমবারের মতো সীমাহীন বিনোদনের স্বাদ পায়। আন্তর্জাতিক খবর, অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সবই তখন হাতের নাগালে। টিভি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের একটি মাধ্যম। এখন চলছে ফ্ল্যাট স্ক্রিনের সময়—যেখানে বিশাল আকারের টিভিগুলোর জায়গা নিয়েছে স্লিম ফর্মের আধুনিক ডিজাইনের টিভি। সিআরটি থেকে এলসিডি, তারপর এলইডি—প্রতিটি ধাপে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে ছবির মান, তেমনি হ্রাস পেয়েছে বিদ্যুৎ খরচ ও অতিরিক্ত জায়গার চাহিদা।
এখন আমরা বাস করছি স্মার্ট টিভির যুগে। টিভি এখন আর শুধু সম্প্রচারিত প্রোগ্রাম দেখার মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট-সংযুক্ত একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিভাইস। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স থেকে শুরু করে সবই দেখা যায় সরাসরি টিভিতেই। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের এই স্মার্ট টিভিগুলোতে রয়েছে ভয়েস কন্ট্রোল, মাল্টিডিভাইস কানেক্টিভিটি, অ্যাপ ইন্টিগ্রেশন এবং এআইযুক্ত রিকমেন্ডেশন সিস্টেম। যেমন স্যামসাংয়ের ভিশন এআই। এখন এই স্মার্ট টেলিভিশনগুলো এআইয়ের সাহায্যে গ্রাহকদের রুচি আর পছন্দ বুঝে নিয়ে কনটেন্ট সাজেশন দিতে পারে।
এ ছাড়া স্মার্ট টিভির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এর অ্যাপ ইকোসিস্টেম এবং গেমিং পাওয়ার। বর্তমানে স্মার্ট টিভিগুলো কেবল প্রথাগত স্ট্রিমিং অ্যাপস নয়, বরং এতে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য, ফিটনেস এবং শিক্ষার মতো হাজারো অ্যাপ্লিকেশন। বিশেষ করে গেমিংয়ের ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কনসোল বা পিসির পাশাপাশি কিছু স্মার্ট টিভিতে সরাসরি ক্লাউড গেমিং ফিচার ইন্টিগ্রেটেড থাকে। এতে কোনো অতিরিক্ত হার্ডওয়্যার ছাড়াই কেবল উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে অত্যাধুনিক গ্রাফিকসের গেম খেলা সম্ভব। টিভির লো ল্যাটেন্সি মোড এবং হাই রিফ্রেশ রেট গেমিং এক্সপেরিয়েন্সকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
প্রযুক্তির এই দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বাজারেও এসেছে নানা ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক টিভি। বাংলাদেশের ‘সুপারব্র্যান্ডস’ স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান স্যামসাং এই বিবর্তনের অগ্রভাগে রয়েছে। তাদের টিভিগুলো শুধু ভিজ্যুয়াল বা ডিজাইনেই নয়, বরং গ্লেয়ার-ফ্রি ডিসপ্লে, এআই আপস্কেলিং, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং শক্তিশালী প্রসেসরের মাধ্যমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া এনে দিয়েছে ঘরে ঘরে। ওমডিয়ার (২০২৪) তথ্য অনুযায়ী, ১৯ বছর ধরে গ্লোবাল নাম্বার ওয়ান টিভি ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে স্যামসাং।
ভবিষ্যতের টেলিভিশনগুলো আরও চমকপ্রদ হতে চলেছে। গবেষকেরা ইতিমধ্যে কাজ করছেন হলোগ্রাফিক ডিসপ্লে, ফোল্ডেবল ও রোলেবল স্ক্রিনের ওপর, যা সহজে ভাঁজ করে রাখা যাবে। হলোগ্রাফিক ডিসপ্লে প্রযুক্তি গ্রাহককে দেবে ত্রিমাত্রিক অভিজ্ঞতা, টিভি দেখে মনে হবে পর্দার চরিত্রগুলো রয়েছে চোখের সামনে। এ ছাড়া অগমেন্টেড রিয়ালিটি (এআর) ও ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটির (ভিআর) সমন্বয়ে টেলিভিশন হয়ে উঠবে এক সম্পূর্ণ ইমার্সিভ জগৎ, যেখানে দর্শক নিজেই হবে স্টোরির অংশ।
তবে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, টিভির আসল ভূমিকা এখনো অপরিবর্তিত। সবাই একসঙ্গে বসে হাসি, কান্না, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবেই টিভি আজও আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।