কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আজকের প্রযুক্তি বিশ্বে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন মাত্রায় এই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়, এটি এখন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। অনেক দেশ তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এআইয়ে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এআইয়ের মাধ্যমে তারা স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবহন, প্রশাসনসহ নানা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশ, যারা এআই ব্যবহার ও উন্নয়নে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, তাদের অবস্থান তুলে ধরা হলো।

যুক্তরাষ্ট্র এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব ধরে রেখেছে। সিলিকন ভ্যালি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিকেন্দ্র গুগল, মাইক্রোসফট, ওপেনএআই, এনভিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও উন্নয়নে বৃহৎ অবদান রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে এই খাতে। এই বিনিয়োগ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা এবং উচ্চমানের গবেষণায় ব্যয় হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এআই মডেলগুলো বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, স্বয়ংক্রিয়তা ও স্বাস্থ্য খাতে। মার্কিন নীতিমালা এআই গবেষণাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নৈতিকতার বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন এবং আর্থিক খাত পর্যন্ত মার্কিন প্রযুক্তি বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশটির স্টার্টআপ, একাডেমিয়া ও শিল্প খাত একসঙ্গে এআইয়ের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে।
চীন এই প্রযুক্তির প্রয়োগে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে। সরকার প্রধানত পরবর্তী প্রজন্মের এআই উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে এআই উন্নয়নে বিশেষ ত্বরান্বিত উদ্যোগ নিয়েছে। বাইদু, আলিবাবা, টেনসেন্টের মতো বৃহৎ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো চীনের এআই গবেষণার মূল চালিকাশক্তি। তারা স্মার্ট শহর, স্বয়ংক্রিয় যানবাহন এবং স্বাস্থ্যসেবায় এআই প্রয়োগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, চীন প্রায় ১১৯ বিলিয়ন ডলার এআইতে বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগ বাস্তবায়নে, বিশেষ করে শিল্প, নিরাপত্তা এবং জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নকে লক্ষ্য করা হচ্ছে। ফলে রাজনীতি, সামরিক, পরিবহন, কৃষি ও উৎপাদন খাতে এআইভিত্তিক পরিবর্তন এসেছে। সরকার সক্রিয়ভাবে এআই নীতিমালা গ্রহণ ও উন্নয়নে কাজ করছে। দেশের বড় বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এআই ব্যবহার বাড়িয়ে দেশকে স্মার্ট সিটি ও উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থায় পরিণত করছে।
যুক্তরাজ্য এআই গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। ডিপমাইন্ডের মতো গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এআইয়ের নৈতিক দিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকার এআই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয়, যার মধ্যে এআই খাতের ডিল এবং এআই অপরচুনিটিস অ্যাকশন প্ল্যান উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাজ্যের এআই স্টার্টআপ পরিবেশ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলছে। যুক্তরাজ্য এআইকে নৈতিক ও প্রযুক্তিগত দুই দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের নীতিমালা ও গবেষণার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, আইন, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে এআই ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। তারা প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিকতা ও আইনগত দিকও নিশ্চিত করছে।
এআই গবেষণায় শক্তিশালী একাডেমিক পরিবেশের জন্য কানাডা বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ভেক্টর ইনস্টিটিউট, মিলা ও অন্যান্য গবেষণাকেন্দ্রগুলো গভীর শিক্ষণ (ডিপ লার্নিং) ও রোবোটিকসে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। কানাডা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার এআইতে বিনিয়োগ করেছে এবং তার নীতি ও গবেষণা বেসটি বিশ্বে প্রশংসিত। দেশের উদ্যোগগুলো নতুন প্রজন্মের এআইপ্রযুক্তি উদ্ভাবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
ইসরায়েল তার সাইবার সিকিউরিটি এবং স্বয়ংক্রিয় যানবাহন ক্ষেত্রের এআই স্টার্টআপগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। দেশটিতে ৪৪২টির মতো এআই স্টার্টআপ রয়েছে, যা এর উদ্ভাবনী শক্তিকে তুলে ধরে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এআইতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক। এই দেশের উদ্ভাবনী পরিবেশ এআইকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জার্মানি তার শক্তিশালী শিল্প খাতকে আধুনিকায়নের জন্য এআই ব্যবহার করছে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ উদ্যোগের মাধ্যমে স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, অটোমেশন ও তথ্যপ্রক্রিয়ায় জার্মানি বিশ্বে অগ্রণী। এআইতে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং ৩১৯টি এআই স্টার্টআপ দেশটির উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রতিফলিত করে।
সরকারি নীতিমালা ও শিল্প সংস্থার সমন্বয়ে দেশটি তার অর্থনীতি এআই দ্বারা আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে। জার্মানি শিল্পকারখানা, গাড়ি উৎপাদন ও স্বয়ংক্রিয়তায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে সফল। পরিবেশবান্ধব নীতি ও গবেষক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে এআই উন্নয়নে জার্মানি এগিয়ে রয়েছে।
ভারত দ্রুত এআই প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। বর্তমানে প্রায় ৩৩৮টি এআই স্টার্টআপ এবং ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ দেশটির বৃদ্ধির প্রমাণ। সরকার ভারতীয় কাঠামো গড়ে তুলেছে এবং বড় আইটি কোম্পানিগুলো এআই প্রকল্পে নিয়োজিত।
জনসংখ্যার বৃহৎ পরিধি এবং প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তি ভারতের এআই খাতকে সম্ভাবনাময়ী করে তুলেছে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও রাজস্ব সেবায় এআইয়ের বিস্তার দেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছে। ২০২৫ সালে এআই শিল্পের আকার ৮০০ কোটি ডলারের আশপাশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি ও শাসনে এআই ব্যবহার করে সেবা সহজতর ও গতিশীল করছে।
ফ্রান্স এআই নীতিমালা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। মিস্ট্রাল এআইসহ বিভিন্ন স্টার্টআপ এখানে এআই গবেষণায় অবদান রাখছে। সরকার ‘ফ্রান্স ২০৩০’ পরিকল্পনার মাধ্যমে এআই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে সমর্থন করছে, যেখানে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। ফ্রান্সের দৃষ্টি এআই নৈতিকতা, নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক প্রভাবের ভারসাম্যে।
ফ্রান্স এআইয়ের নৈতিকতা, গবেষণা ও স্বয়ংক্রিয়তায় গুরুত্বারোপ করছে। সরকার স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবহন, নিরাপত্তা ও রোবোটিকসে এআই ব্যবহার বৃদ্ধি করতে অর্থায়ন ও নীতিমালা গ্রহণ করছে। নৈতিক এআই পরিচালনায় তারা সবার চেয়ে এগিয়ে।
দক্ষিণ কোরিয়া হার্ডওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবস্থান রাখে। স্যামসাং, এলজির মতো প্রযুক্তি জায়ান্টরা এআই সেমিকন্ডাক্টর, রোবোটিকস ও স্মার্ট ডিভাইসে বিনিয়োগ করছে। দেশটি প্রায় ৭০৩ কোটি ডলার এআইতে বিনিয়োগ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার এআই গবেষণা দ্রুত এগোচ্ছে এবং এটি তার অর্থনীতির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত।
দক্ষিণ কোরিয়া এআই ব্যবহার ও গবেষণায় অন্যতম শীর্ষ দেশ। সেখানে স্মার্টফোন ও গ্যাজেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এআই প্রযুক্তি তাদের পণ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করছে। সরকারও নানা আইন ও উদ্যোগে এআই বিকাশে উৎসাহ দিচ্ছে।
সিঙ্গাপুর ছোট রাষ্ট্র হলেও এআই উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ১৯৩টি এআই স্টার্টআপ, ‘স্মাট৴ ন্যাশন’ নীতি ও বিভিন্ন এআই গভর্নেন্স প্রকল্পে তারা এগিয়ে রয়েছে। প্রায় ৭০৩ কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর প্রযুক্তিগত ও নীতিমালার মাধ্যমে এআইকে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও সরকারি সেবায় অন্তর্ভুক্ত করছে।
সিঙ্গাপুর স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও শহর পরিকল্পনায় এআইকে কাজে লাগিয়ে স্মার্ট সিটি গড়ে তুলছে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও নগর উন্নয়নেও এআই ব্যবহারের মাধ্যমে তারা শীর্ষ স্থানে রয়েছে।
এই শীর্ষ ১০ দেশ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে এআই উদ্ভাবন, গবেষণা ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রযুক্তি ও বিনিয়োগে বিশ্বে সেরা হলেও ইউরোপীয় দেশগুলো নীতিমালা ও গবেষণায় সমতা রক্ষা করছে। ভারত, ইসরায়েল ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো দ্রুত নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলছে, যা ভবিষ্যতে এআই বিশ্ব মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্র: স্ট্যানফোর্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস