
আশুগঞ্জ থেকে সরাইল—মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কপথের জন্য পুরো সিলেট বিভাগ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে।
ভারতীয় ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করেনি। স্বাভাবিক মেরামতও বন্ধ। ফলে খানাখন্দের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই অংশে প্রতিদিনই যানজট, ভোগান্তি হচ্ছে।
এই ভোগান্তি লাঘবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আর কাজ তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছে ১২ সদস্যের একটি কমিটি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরাইলে স্থাপন করা হয়েছে ক্যাম্প অফিস। এই ক্যাম্প অফিসে প্রকৌশলীদের অবস্থান করে সার্বক্ষণিক মেরামত ও নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মহাসড়কের কাজ ও সবশেষ পরিস্থিতি দেখতে আগামী বুধবার আশুগঞ্জ যাবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
মহাসড়কটির দুরবস্থা নিরসনে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে আছে—ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনা। কমিটি প্রতিদিন সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে কাজের অগ্রগতিসহ বাস্তব পরিস্থিতি অবহিত করবে।
সরকারি চাকরিজীবী ফেরদৌস ভূঁইয়ার অফিস সিলেটে। বাড়ি আশুগঞ্জ। গতকাল রোববার সকাল ছয়টায় তিনি আশুগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন। মহাসড়ক স্বাভাবিক থাকাকালে সিলেট যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তু গতকাল সরাইল বিশ্বরোড মোড় পার হতেই সোয়া দুই ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানান তিনি।
ফেরদৌস ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহের শনি বা রোববার সিলেট যান তিনি। আর আশুগঞ্জ ফেরেন বৃহস্পতিবার রাতে। যাওয়া-আসায় তাঁকে প্রতিনিয়ত একই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গত এক বছরে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এখন আশুগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে-আসতে গড়ে ছয় ঘণ্টা করে সময় লাগে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে গত বুধবার থেকে টানা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে দীর্ঘ যানজট হয়েছিল। আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে সরাইল উপজেলার বেড়তলা, সরাইল বিশ্বরোড মোড় ও শাহবাজপুর সেতু হয়ে হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার এলাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়েছিল।
মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ভারতীয় ঋণে সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। ঠিকাদার সময়মতো কাজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী এক মাসে দৃশ্যমান উন্নতিসহ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।মো. এহসানুল হক, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব
এই মহাসড়ক দিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে দিনে এক হাজারের বেশি বাস চলাচল করে। এর বাইরে চলে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও মালবাহী যানবাহন। এই পথে চলাচলকারীদের মধ্যে পর্যটক আছেন। আছেন বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা যাত্রী। মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে যাত্রীদের নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
কমিটি গঠন
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কমিটিতে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়, কুমিল্লা জোন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক সার্কেল ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা আছেন। তাঁদের সরাইলে স্থাপন করা ক্যাম্প অফিসে অবস্থান করে চলমান কাজের তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই মহাসড়ক দিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে দিনে এক হাজারের বেশি বাস চলাচল করে। এর বাইরে চলে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও মালবাহী যানবাহন। এই পথে চলাচলকারীদের মধ্যে পর্যটক আছেন। আছেন বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা যাত্রী। মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে যাত্রীদের নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে আছে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনা। কমিটি প্রতিদিন সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে কাজের অগ্রগতিসহ বাস্তব পরিস্থিতি অবহিত করবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহসানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ভারতীয় ঋণে সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। ঠিকাদার সময়মতো কাজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী এক মাসে দৃশ্যমান উন্নতিসহ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সওজের তথ্য অনুসারে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ইটাখোলা পর্যন্ত অংশে দিনে গড়ে ৩০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ইটাখোলা থেকে সিলেটের শেরপুর অংশে ১০ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন চলে। আর সিলেটের শেরপুর থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত অংশে চলে গড়ে ২৭ হাজারের মতো যানবাহন। এই মহাসড়কে চলাচল করা যানবাহনের বড় অংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
যেভাবে বেহাল
ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সওজের একটি প্রকল্প চলমান। এর আওতায় ২০৯ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর আওতায় চার লেনের মহাসড়কের দুই পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক নির্মাণ করা হবে।
সম্প্রসারণকাজ চলার কারণে পুরো মহাসড়কেই যানবাহনের গতি কমেছে। তবে আশুগঞ্জ অংশে মহাসড়ক এতটাই বেহাল যে তা যান চলাচল একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদার কাজ শুরুর পর থেকে ভোগান্তি চলছে। কারণ, তারা বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
তবে এই মহাসড়কের আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়ায় ভারত সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে আগে থেকে প্রকল্প চলমান। প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। একবার সংশোধনের পর প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা দেবে সরকার। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্ধেক কাজ হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ তিনটি প্যাকেজে (ভাগে) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সব কটির ঠিকাদার ভারতের এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
সওজ সূত্র বলছে, করোনা মহামারির সময় ভারতীয় ঠিকাদার তেমন একটা কাজ করেনি। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়। স্থানীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের পাশাপাশি তিন শর মতো ভারতীয় নাগরিক এই প্রকল্পে কাজ করতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয়রা চলে যান। এ কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেও বাড়তি কাজের টাকা (ভ্যারিয়েশন) দাবি করে। এ সময় বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকমতো মেরামত করা হয়নি। এ কারণেই মূলত যানজট ও ভোগান্তির সূত্রপাত।
সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রসারণকাজ চলার কারণে পুরো মহাসড়কেই যানবাহনের গতি কমেছে। তবে আশুগঞ্জ অংশে মহাসড়ক এতটাই বেহাল যে তা যান চলাচল একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদার কাজ শুরুর পর থেকে ভোগান্তি চলছে। কারণ, তারা বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।’
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধরখার থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত অংশের প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার কাজে ভারতীয় ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, ভারতের সঙ্গে এখন সীমান্ত বাণিজ্য সীমিত। তাই এটি অগ্রাধিকারে নেই। সরাইল থেকে ধরখার পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার অংশও বেহাল। তবে এই অংশের কাজ অব্যাহত রাখা হবে।
আশুগঞ্জ থেকে সরাইল পর্যন্ত মহাসড়কের অংশ। এই অংশে আগে পরিকল্পনা ছিল মূল সড়কের পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য দুই পাশে সাড়ে তিন মিটার চওড়া সড়ক নির্মাণ করা হবে। পরে তা সম্প্রসারণ করে সাড়ে ৫ মিটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর জন্য প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা বাড়তি অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অর্থ থেকে এখন সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান সড়ক মেরামত করা হবে।