
ঢাকার মিরপুরের বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ পাঁচ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৩৫ প্রজাতির ১৯৬টি প্রাণী কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে।
সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনাটি অনুমোদন দিয়েছে। চিড়িয়াখানাটিতে থাকা নিঃসঙ্গ প্রাণীদের সঙ্গী দেওয়া, আন্তপ্রজনন ঠেকানো, আয়ুষ্কাল অতিক্রম করা প্রাণী প্রতিস্থাপন, নতুন প্রজাতি সংযোজন, প্রদর্শনীর আকর্ষণ বাড়ানোর মতো বিষয় বিবেচনায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে প্রাণী কেনার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছে। চলতি বছর যেসব প্রাণী কেনা হবে, তার জন্য দ্রুতই দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
আগামী পাঁচ বছরে প্রাণী কেনার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছে। চলতি বছর যেসব প্রাণী কেনা হবে, তার জন্য দ্রুতই দরপত্র আহ্বান করা হবে।মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার, পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা
জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত তিন অর্থবছরে এলসি (আমদানির ঋণপত্র) সংকট, প্রশাসনিক জটিলতার মতো কারণে কোনো প্রাণী কেনা সম্ভব হয়নি। দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এখন এলসি খুলে আবার প্রাণী সংগ্রহের পথ সৃষ্টি হয়েছে।
যে ৩৫ প্রজাতির পশুপাখি কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো—জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, আফ্রিকান সিংহ, উল্লুক, হনুমান লেঙ্গুর, কুলু বানর, সারস ক্রেন, লোনাপানির কুমির, কমন ইল্যান্ড, ওয়াটারবাক, কেশোয়ারি, আলেকজান্দ্রিন প্যারাকিট, টারকুইজ প্যারাকিট, এশীয় কালো ভালুক, গিনি বেবুন, হামাদ্রিয়াস বেবুন, সালফার ক্রেস্টেড কাকাতুয়া, মিঠাপানির কুমির, রেড ক্যাঙারু, রেড অ্যান্ড গ্রিন ম্যাকাও, হলুদ টিয়া, ধূসর ককাটেইল, লাভ বার্ড লুটিনো ফিশার, গ্রেটার কুডু, অরিক্স, ডোরাকাটা হায়েনা, হায়েনা চিত্রা, রিং-টেইলড লেমুর, গ্রেটার ফ্লেমিঙ্গো, কালো গলা বক, অলিভ বেবুন, জিরাফ, চিতাবাঘ, আফ্রিকান গন্ডার ও ওরাংওটাং।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ১৪ প্রজাতির ৭৮টি প্রাণী কিনতে চায় জাতীয় চিড়িয়াখানা।
প্রজাতিগুলো হলো—জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, আফ্রিকান সিংহ, উল্লুক, হনুমান লেঙ্গুর, কুলু বানর, সারস ক্রেন, লোনাপানির কুমির, কমন ইল্যান্ড, ওয়াটারবাক, কেশোয়ারি, আলেকজান্দ্রিন প্যারাকিট, টারকুইজ প্যারাকিট ও এশীয় কালো ভালুক।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাণীগুলো কিনতে দরকার সাত কোটি টাকা। বরাদ্দ আছে দুই কোটি। এখন এই অর্থ দিয়ে কিছু প্রাণী কেনার জন্য শিগগির দরপত্র প্রকাশ করা হবে। বাকি প্রাণীগুলো কেনার জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ পেলে পরবর্তী দরপত্র প্রকাশ করা হবে। এ অর্থবছরে যেসব প্রাণী কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর জন্য অবকাঠামো আছে। অল্পকিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন হবে।
জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত তিন অর্থবছরে এলসি (আমদানির ঋণপত্র) সংকট, প্রশাসনিক জটিলতার মতো কারণে কোনো প্রাণী কেনা সম্ভব হয়নি। দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এখন এলসি খুলে আবার প্রাণী সংগ্রহের পথ সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে জাতীয় চিড়িয়াখানায় জেব্রা আছে পাঁচটি। একটি পুরুষ, চারটি স্ত্রী। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, এই জেব্রাগুলোর পূর্বপুরুষ একই। তাই আন্তপ্রজনন ঠেকাতে বাইরে থেকে তিনটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী জেব্রা আনতে হবে।
স্ত্রী ওয়াইল্ডবিস্ট আছে দুটি। কোনো পুরুষ ওয়াইল্ডবিস্ট নেই। কর্তৃপক্ষ বলছে, সঙ্গী দেওয়ার জন্য তারা তিনটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রী ওয়াইল্ডবিস্ট কিনতে চায়।
একটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রী আফ্রিকান সিংহ আছে চিড়িয়াখানায়। প্রজননের জন্য আরও তিনটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী আফ্রিকান সিংহ কেনার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের।
চিড়িয়াখানায় স্ত্রী উল্লুক আছে একটি। সঙ্গী দেওয়াসহ বংশবৃদ্ধির জন্য চারটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রী উল্লুক কিনতে চায় কর্তৃপক্ষ।
তিনটি পুরুষ হনুমান লেঙ্গুর আছে চিড়িয়াখানায়। তাদের কোনো স্ত্রী সঙ্গী নেই। সঙ্গী দেওয়ার জন্য এখন তিনটি স্ত্রী হনুমান লেঙ্গুর কেনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চিড়িয়াখানায় একটি পুরুষ কুলু বানর আছে। কর্তৃপক্ষ এখন তিনটি কুলু বানর (একটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী) কিনতে চায়।
পুরুষ সারস ক্রেন আছে একটি। তিনটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী সারস ক্রেন কেনার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ।
লোনাপানির পুরুষ কুমির আছে চারটি, স্ত্রী কুমির নেই। তাই সঙ্গী দেওয়াসহ প্রজননের উদ্দেশ্যে চারটি স্ত্রী কুমির কেনা হবে।
স্ত্রী কমন ইল্যান্ড আছে একটি। নিঃসঙ্গ বয়স্ক প্রাণীটির খাঁচার ধারণক্ষমতাও আছে। এখন ছয়টি কমন ইল্যান্ড (তিনটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রী) কিনতে চায় কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানায় চারটি ওয়াটারবাক আছে। সবই বয়স্ক। এগুলোর খাঁচার ধারণক্ষমতাও আছে। এখন চার জোড়া ওয়াটারবাক (চারটি পুরুষ, চারটি স্ত্রী) কেনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চিড়িয়াখানায় থাকা একটি পুরুষ কেশোয়ারির আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এর খাঁচায় ধারণক্ষমতাও আছে। এখন দুই জোড়া কেশোয়ারি (দুটি পুরুষ, দুটি স্ত্রী) কেনা হবে।
আলেকজান্দ্রিন প্যারাকিট আছে সাতটি। আরও চারটি পুরুষ ও পাঁচটি স্ত্রী আলেকজান্দ্রিন প্যারাকিট কিনতে চায় কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানায় পাঁচটি টারকুইজ প্যারাকিট পাখি আছে। প্রদর্শনীর আকর্ষণ বাড়াতে আরও নয়টি কেনা হবে।
দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী এশীয় কালো ভালুক আছে চিড়িয়াখানায়। কেনা হবে একটা পুরুষ ও একটা স্ত্রী এশীয় কালো ভালুক।
আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৯ প্রজাতির ৫৬টি প্রাণী কেনার পরিকল্পনা আছে জাতীয় চিড়িয়াখানার। এর মধ্যে আছে গিনি বেবুন, হামাদ্রিয়াস বেবুন, রেড ক্যাঙারু, রেড অ্যান্ড গ্রিন ম্যাকাও, সালফার ক্রেস্টেড কাকাতুয়া, হলুদ টিয়া, ধূসর ককাটেইল, লাভ বার্ড লুটিনো ফিশার, মিঠাপানির কুমির।
বর্তমানে জাতীয় চিড়িয়াখানায় খাঁচা থাকলেও গিনি বেবুন নেই। স্ত্রী হামাদ্রিয়াস বেবুন আছে একটি। এ কারণে তিনটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রী গিনি বেবুন এবং তিনটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী হামাদ্রিয়াস বেবুন কেনার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের।
মিঠাপানির দুটি পুরুষ কুমির রয়েছে। তাদের কোনো স্ত্রী সঙ্গী নেই। সঙ্গী দেওয়াসহ প্রজননের উদ্দেশ্যে দুটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী কুমির কেনা হবে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মনে করে, এটি করা হলে জাতীয় পর্যায়ে মিঠাপানির কুমিরের একটি প্রজনন ভান্ডার তৈরি হবে।
একটি স্ত্রী রেড ক্যাঙারু আছে চিড়িয়াখানায়। এটির খাঁচার ধারণক্ষমতাও আছে। এটিকে পুরুষ সঙ্গী দেওয়াসহ প্রদর্শনীর আকর্ষণ বাড়াতে দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী রেড ক্যাঙারু কেনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রেড অ্যান্ড গ্রিন ম্যাকাও আছে দুটি। খাঁচার ধারণক্ষমতাও আছে। এখন দুই জোড়া ম্যাকাও কেনা হবে।
এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে তিন জোড়া সালফার ক্রেস্টেড কাকাতুয়া, ৫টি হলুদ টিয়া, ১৪টি ধূসর ককাটেইল ও ৬টি লাভ বার্ড লুটিনো ফিশার কেনার পরিকল্পনা করেছে কর্তৃপক্ষ।
চলতি অর্থবছরে ১৪ প্রজাতির ৭৮টি প্রাণী কিনতে চায় জাতীয় চিড়িয়াখানা। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রাণীগুলো কিনতে দরকার সাত কোটি টাকা। বরাদ্দ আছে দুই কোটি। এখন এই অর্থ দিয়ে কিছু প্রাণী কেনার জন্য শিগগির দরপত্র প্রকাশ করা হবে। বাকি প্রাণীগুলো কেনার জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
২০২৭-২৮ অর্থবছরে ছয় প্রজাতির ৩৮টি প্রাণী সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে জাতীয় চিড়িয়াখানার। এর মধ্যে আছে আফ্রিকান প্রাণী গ্রেটার কুডু, অরিক্স ও রিং-টেইলড লেমুর।
এগুলো একসময় চিড়িয়াখানায় থাকলেও এখন নেই। এ কারণে চার জোড়া গ্রেটার কুডু, তিন জোড়া অরিক্স ও তিন জোড়া রিং-টেইলড লেমুর সংগ্রহ করা হবে।
চিড়িয়াখানায় আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হয়েছে দুটি ডোরাকাটা হায়েনা, তিনটি গ্রেটার ফ্লেমিঙ্গো ও দুটি কালো গলা বকের। এ কারণে তিন জোড়া করে হায়েনা, ফ্লেমিঙ্গো ও কালো গলা বক সংগ্রহ করা হবে।
২০২৮-২৯ অর্থবছরে সংগ্রহ করা হবে ১২টি প্রাণী। এগুলো হলো—অলিভ বেবুন, জিরাফ ও চিতাবাঘ।
বর্তমানে চিড়িয়াখানায় থাকা ছয়টি জিরাফ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে। তাই এই অর্থবছরে দুই জোড়া জিরাফ আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বহু বছর ধরে চিড়িয়াখানায় চিতাবাঘ নেই। খাঁচার উন্নয়ন শেষে ২০২৮-২৯ অর্থবছরে দুই জোড়া চিতাবাঘ কেনার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানায় থাকা দুটি অলিভ বেবুনের আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। তাই এই প্রাণী দুই জোড়া কেনার বিষয়টি পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে।
পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার শেষ ধাপে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে আফ্রিকান গন্ডার, চিত্রা হায়েনা, ওরাংওটাংসহ ১২টি প্রাণী কেনা হবে।
চিড়িয়াখানায় বর্তমানে নিঃসঙ্গ একটি স্ত্রী গন্ডার আছে। তার খাঁচা মানসম্মত নয়। নতুন অবকাঠামো তৈরি করে দুই জোড়া গন্ডার কেনা হবে।
অন্যদিকে চিত্রা হায়েনা কেনা হবে তিন জোড়া। চিড়িয়াখানায় কোনো ওরাংওটাং নেই। তাই প্রথমবারের মতো দুই জোড়া ওরাংওটাং কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণীর সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বাড়বে, নিঃসঙ্গতা ও আন্তপ্রজননের ঝুঁকি কমবে এবং চিড়িয়াখানার প্রতি দর্শনার্থীদের নতুন আকর্ষণ তৈরি হবে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নতুন প্রাণী কেনার প্রয়োজন হয় বলে উল্লেখ করেন জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বয়স্ক প্রাণীর প্রজননক্ষমতা থাকে না। ফলে চিড়িয়াখানায় প্রাণীর সংখ্যা বাড়ে না। নিঃসঙ্গ প্রাণীকেও সঙ্গী দিতে হয়। আবার বিদ্যমান প্রাণীগুলোর আন্তপ্রজননের সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া চিড়িয়াখানায় নতুন প্রাণী এলে, প্রাণীর সংখ্যা বাড়লে দর্শক বাড়বে, তারা আনন্দ পাবে। এসব কারণে দু-তিন বছর পরপর নতুন প্রাণী কেনা বা এক্সচেঞ্জের (অন্য চিড়িয়াখানা থেকে আনা) দরকার হয়।