
চারতলার চকচকে নতুন একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সামনে ফুলের বাগান, পাকা সড়ক। চমৎকার এক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলেও এখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না মানুষ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে আংশিক সেবা চালু হলেও প্রয়োজনীয় জনবলকাঠামোই অনুমোদন হয়নি। এর মধ্যেই চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। এটি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র।
সরেজমিনে এক দিন
২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উদ্বোধন করা হয়। জরুরি ও বর্হিবিভাগ চালু হলেও এখনো আন্তবিভাগের সেবা চালু হয়নি। ২১ জুলাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে গেলে সেবা নিতে আসা কাজিউল ইসলাম নামের একজন বলেন, এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া দরকার। জটিল সমস্যা হলে ময়মনসিংহে যেতে হয়, এখানে যেন সেসব ব্যবস্থা করা হয়।
আরেক রোগী মুকুল খান বলেন, ‘সকাল ৯টায় আসলেও ১ ঘণ্টা বইয়া আছিলাম। পরে ডাক্তার আইলে দেইখ্যা ওষুধ দিছে।’ ১০টা ১১ মিনিটে চিকিৎসক দেখিয়ে বের হচ্ছিলেন বানিহালা গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ছোটখাটো ওষুখের সেবা পাই। বড় ধরনের অসুখের সেবা নেই। ডাক্তার নেই। রোগী ভর্তি চলে না। কোনো সিট নেই। আমরা যদি পূর্ণ সেবা না পাই, তাহলে হাসপাতাল করা না–করা তো একই কথা।’
সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রাশেদুল হক এক আত্মীয়কে চিকিৎসক দেখাতে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে এখনো ইনডোর চালু হয়নি। রোগীরা কিছু সাধারণ সেবা পেলেও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভর্তির জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেলে যেতে হয়। যদি ইনডোর সার্ভিস চালু হয়, তাহলে এলাকাবাসী উপকৃত হবে।’
সকাল ১০টা ২৯ মিনিটে চরগোপীনাথপুর গ্রামের সুফিয়া খাতুনকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনের বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা যায়। বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ডায়বেটিস। ডাক্তার বুলে দেড়টা বাজে আইবো, ডাক্তারের লাইগ্যা বইয়া রইছি, সাড়ে ৯টায় আইছি। কী করবাম দূরফির পথ, বাড়িত গিয়া আবার আওন যাইতো না।’
ইনডোরের জিনিসে ধুলা
আন্তবিভাগের জন্য বরাদ্দ শয্যাসহ অন্যান্য জিনিসপত্রে ধুলার আস্তরণ পড়ে নষ্ট হচ্ছে। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও জনবলকাঠামো অনুমোদন না হওয়ায় চালু করা যাচ্ছে না আন্তবিভাগ। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায় রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিন। সেদিকের অবস্থা ঘুরে দেখান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অভিজিৎ লোহ। কক্ষগুলোয় আন্তবিভাগ চালুর জন্য রোগীর শয্যা, বালিশসহ অন্যান্য সমাগ্রী দেখা যায়। অনেকগুলো প্যাকেটবন্দী জিনিস। সবকিছুতেই ধুলার আস্তর পড়ছে। অপারেশন থিয়েটার থাকলেও নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি। তবে মাঝেমধ্যে এগুলো পরিষ্কার করা হয়।
সেবা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর ভাষ্য, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ছোট সমস্যা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা পাশের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।
তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অভিজিৎ লোহ বলেন, আন্তবিভাগ চালু হয়নি। সেবার মান বাড়াতে হলে স্ট্যান্ডার্ড সেটআট অনুযায়ী চিকিৎসক-কর্মচারীর পদগুলো দ্রুত সৃষ্টি হওয়া দরকার। এতে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবেন। ৩২টি পদ সৃজনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
হাসপাতালের লোকবল
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে ১০ জনের জন্য আবেদন করা হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাত্র চারটি পদ অনুমোদন দিয়েছে। চারজনের মধ্যে গাইনি, সার্জারি, অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও মেডিসিনের চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেলে সংযুক্তিতে আছেন। ৫০ শয্যার হাসপাতালের জন্য ১৯ জন মেডিকেল অফিসার দরকার থাকলেও অনুমোদন হয় মাত্র ২টি পদ।
উপজেলার ১০টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১০টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও সেখানে ১ জনের পদ শূন্য। উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৯ জন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজনসহ ১১ জন মেডিকেল অফিসার আছেন। ১১ জন মেডিকেল অফিসার, ৪ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ১ জন আরএমও ও ১ জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার মধ্যে ৩ জন মেডিকেল অফিসার, ১ জন সহকারী সার্জন ও মেডিসিনের কনসালট্যান্ট অন্য হাসপাতালে সংযুক্তিতে আছেন। ৫০ শয্যার হাসপাতালে ৩১ জন নার্সের দরকার থাকলেও মাত্র ৭ জনের পদ সৃষ্টি হয়।
চালক নেই, অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ
তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে আসা গুরুতর কোনো রোগীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যেতে হয়। কারণ, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ। গত বছরের জুনে চালক শাহ আলম অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সটি পড়ে ছিল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে। ওই অবস্থায় গত মাসে সিভিল সার্জনের নির্দেশে অ্যাম্বুলেন্সটি পাশের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফুলপুরের অ্যাম্বুলেন্সটি বিকল হয়ে যাওয়ায় সেখানে তারাকান্দার অ্যাম্বুলেন্সটি পাঠানো হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন মো. ছাইফুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, পদ সৃষ্টি না করেই বিগত সরকার এসব প্রতিষ্ঠান চালু করে দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পদ সৃষ্টির জন্য কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পদ অনুমোদন ও চিকিৎসক বরাদ্দ পেলেই ইনডোর সার্ভিস চালু করা হবে। পরে কর্তৃপক্ষের কাছে অন্য বরাদ্দগুলো চাওয়া হবে।