মাগুরার রাজনীতিতে গত ১৫ বছর দাপট দেখিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একসময়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাইফুজ্জামান শিখর এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসনে সাইফুজ্জামানকে সরিয়ে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে আনে আওয়ামী লীগ। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপি-জামায়াতের দখলে। এখন মাগুরার দুটি আসনে পরবর্তী কান্ডারি কারা হবেন, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
৫ আগস্টের আগে মামলায় কোণঠাসা বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন চাঙা। দলীয় কার্যালয়ের পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত কার্যালয়গুলো এখন বেশির ভাগ সময় নেতা-কর্মীতে ঠাসা দেখা যায়। গত ডিসেম্বরে জেলা বিএনপির ছয় বছরের পুরোনো আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন জেলায় দল পুনর্গঠনে চলছে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম। পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী হওয়ার জানান দিচ্ছেন।
নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরায় দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতি মোটাদাগে দুটি ধারায় বিভক্ত। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ ও সভা-সমাবেশে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমানে বিএনপির এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম। অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মনোয়ার হোসেন খান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাগুরা–১ ও ২ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন মনোয়ার হোসেন খান ও নিতাই রায় চৌধুরী। বৈরী পরিবেশে ভোটের লড়াইয়ে থাকা ওই দুই নেতাকে নিয়ে এবারও আলোচনা আছে। সভা-সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে তার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে মাগুরা বিএনপির রাজনীতিতে এসেছে নতুন সমীকরণ; বিশেষ করে মাগুরা-২ আসনে। এখানে গত ডিসেম্বর থেকে নিতাই রায় চৌধুরীর বিপরীতে ‘ঐক্যবদ্ধভাবে’ মাঠে নেমেছেন মাগুরা-২ (মহম্মদপুর, শালিখা ও সদরের একাংশ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল (কাজী কামাল) ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় প্রায় সাত বছর কারাভোগের পর গত আগস্টে মুক্তি পান কাজী কামাল। এরপর এই দুই নেতা মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলায় বড় সমাবেশ করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। তাঁরা দুজনই আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন।
মাগুরা-১ (সদরের একাংশ ও শ্রীপুর) আসনে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মনোয়ার হোসেন খানের পাশাপাশি আহ্বায়ক আলী আহমেদের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া তরুণ নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন এই আসনে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
মাগুরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হচ্ছে দল পুনর্গঠন। এর অংশ হিসেবে ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় সদস্য সংগ্রহ শেষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জেলা সম্মেলন আয়োজনের কাজ চলছে।’ দলে বিভক্তি ও আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। বড় দলে প্রতিযোগিতা আছে, তবে সেটাকে বিভক্তি বলা যাবে না। দলের কাজ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই করছি।’
মাগুরায় ২০১৪ সালের পর ১০ বছর জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা চোখে পড়েনি। ওই বছর সর্বশেষ উপজেলা পরিষদে নির্বাচনে অংশ নেন জামায়াতের প্রার্থীরা। এরপর মামলা ও রাজনৈতিক চাপে দলটির নেতা-কর্মীরা গোপনে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর কৌশল নেন। তবে আগস্টের পালাবদলের পর থেকে তাঁদের নানা রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা গেছে। গত ১০ বছরে দলের কোনো কার্যালয় না থাকলেও শহরের হাজী সাহেব সড়কে নতুন কার্যালয় নেওয়ার কাজ চলছে বলে জানানো হয়েছে দলের পক্ষ থেকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরার দুটি আসনের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীও ঘোষণা করেছে দলটি। প্রার্থী দুজন হচ্ছেন মাগুরা-১ আসনে জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আবদুল মতিন এবং মাগুরা-২ আসনে জেলা জামায়াতের বর্তমান আমির এম বি বাকের।
জেলা জামায়াতের আমির এম বি বাকের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। এমনকি নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে কেন্দ্র পরিচালনা কমিটিও করা হয়েছে।’
মাগুরায় সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে বেশ কিছু জায়গায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা। চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের দলের নেতারা সামনের নির্বাচনগুলোয় মাগুরায় আগের চেয়ে ভালো ফল প্রত্যাশা করছেন। জামায়াতে ইসলামীর মতো তাদেরও ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে মাগুরা-২ আসনে দলটির জেলা সভাপতি মুফতি মোস্তফা কামালকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
মুফতি মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে নানা রকম চাপের মধ্যেও আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ভালো ভোটও পেয়েছি। এবার নির্বাচনের ভালো পরিবেশ হলে ফল আরও ভালো হবে।’
মাগুরায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। এমনকি দলটির কোনো তৎপরতাও লক্ষ করা যায়নি। জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনসিপির বিষয়ে আমাদের এখনো কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’
মাগুরায় শহরের জামরুলতলায় ছিল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। ৫ আগস্ট ওই কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ওই কার্যালয়ের নামফলক ঢেকে সেখানে ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিয়েছে ভবনের মালিকপক্ষ। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে সাকিব আল হাসানের জয়ের পর শহরের কেশব মোড়ে একটি ভবনের নিচতলা তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। সেটিকে সম্প্রতি একটি তৈরি পোশাকের শোরুম হিসেবে দেখা গেছে।
৫ আগস্ট মাগুরা শহরে সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ও বীরেন শিকদারের বাসভবনসহ বেশ কিছু নেতা-কর্মীর বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়। নেতাদের অনেকের নামে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা হয়েছে। সাকিব আল হাসানের নামে মাগুরায় কোনো মামলা না থাকলেও ঢাকায় হত্যা মামলাসহ নানা চাপে তিনি দেশে আসতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ নেতা-কর্মীই গ্রেপ্তার এড়াতে দেশে ও দেশের বাইরে আত্মগোপনে আছেন।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতিতে দল গোছানোর তৎপরতা লক্ষ করা গেছে গণ অধিকার পরিষদের। আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় নানা ইস্যুতে মাগুরায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ জাসদের তৎপরতা চোখে পড়ছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কংগ্রেস সক্রিয়ভাবে জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বাসদের জেলা আহ্বায়ক শম্পা বসু প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। এখনো সক্রিয় আছি। নির্বাচনের ভালো পরিবেশ হলে তার জন্যও আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।’
তবে জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ (জাসদ) আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত দলগুলোর কোনো কর্মসূচি সেই অর্থে দৃশ্যমান নেই।