আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে মুক্তির গান সিনেমা নির্মাণের নেপথ্য অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্যাথরিন মাসুদের এই স্মৃতিচারণাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘মুক্তির গান: ২৫ বছর নির্মাণাধীন একটি ছবির নেপথ্য কথা’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।
বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।
‘মুক্তির গান’ বিনির্মাণ করতে গিয়ে আর্থিক বা রাজনৈতিক যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখে আমাদের পড়তে হয়েছিল, তার বিবরণ দিতে এ লেখা নয়। বরং একজন নিবেদিতপ্রাণ বিদেশির তোলা প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ থেকে সমকালীন বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য একটি নতুন ছবি জন্ম নেওয়ার জটিল অথচ মজার প্রক্রিয়ার বিবরণ দিতেই আমার এ লেখা।ক্যাথরিন মাসুদ
১৯৯০ সালের শেষ দিক। আমি আর তারেক তখন আমেরিকায়। শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন ও শিল্পের ওপর তারেকের প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ নির্মাণ শেষ হয়েছে মাত্র। প্রচণ্ড কাজের চাপের পর একধরনের বিরাম নিচ্ছিলাম আমরা। ‘স্ট্র্যান্ড’ নামের নিউইয়র্কের এক বিখ্যাত বইয়ের দোকানে তারেক কাজ নিয়েছে। আমি বিখ্যাত একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় নির্বাহী হিসেবে যোগ দিয়েছি। সংস্থার প্রথাগত উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে এগিয়েও যাচ্ছি। কিন্তু পুরোপুরি মন বসছিল না। আসলে তখন আমরা দুজনেই একটা কোনো অর্থবহ নতুন চলচ্চিত্র প্রকল্পে জড়াতে চাচ্ছিলাম ভীষণভাবে। কিন্তু কীভাবে বা ঠিক কোত্থেকে শুরু করা যায়, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
একদিন তারেকের চাচাতো ভাই বেণুর পুরোনো বন্ধু তারিক আলির সঙ্গে দেখা। তিনি পার্শ্ববর্তী শহর লরেন্সভিলে একটা ওষুধের ফার্মে কাজ করতেন। তারিক ভাই আমাদের পরের ছুটির দিনে তাঁর ওখানে দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। যথারীতি পরের শনিবার তারিক ভাইয়ের বাসায় খাওয়াদাওয়া সেরে দেশের গল্প, ঢাকার গল্প আর দেশে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। একসময় গল্পের মোড় ঘুরল মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
একাত্তরে বেণু ভাই প্রধান গায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের কলকাতায় গড়ে ওঠা একটি গানের দলের। সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে এবং কলকাতার নিবেদিতপ্রাণ কথাসাহিত্যিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছিল দলটি। এ দলের শিল্পীরা সীমান্ত এলাকায়, ট্রেনিং ক্যাম্পে, শরণার্থীশিবিরে ও সুযোগ হলে এমনকি মুক্তাঞ্চলেও গান গেয়ে সবার মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করতেন। তারিক আলি মূলত গায়ক না হয়েও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এই দলের সঙ্গে। তারিক ভাই বললেন, তখন একটা মার্কিন শুটিং দলও তাঁদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিল। বেণু ভাই ’৭২-’৭৩ সালের দিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক চিত্রগ্রাহকের নাম বলেছিলেন, এ কথাও তারেকের আবছাভাবে মনে ছিল। তারিক ভাই যত দূর মনে করতে পারলেন, তাঁর নাম ছিল লিয়ার লেভিন। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। খুব জানতে ইচ্ছা করছিল ফুটেজগুলোর কী হলো? হয়তো যুদ্ধসংক্রান্ত তথ্যাগারের ক্যাটালগে পড়ে আছে! হয়তো লিয়ার আর নিউইয়র্কে থাকেনই না! হয়তো বেঁচেও নেই।
পরের এক কি দুই সপ্তাহ তারেক আর আমি লিয়ার লেভিনের কথা প্রায় ভুলেই ছিলাম। কিন্তু এক শনিবার মনে পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনবুক খুলে ‘এল’ আদ্যক্ষরের সারিতে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। তালিকায় কাঙ্ক্ষিত নামটি দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ‘লিয়ার লেভিন!’ লিয়ার লেভিন প্রোডাকশনস! টেলিফোনে কথা বলায় আমি বরাবরই অস্বস্তিবোধ করি। তাই ফোনটা তারেককে দিলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এরপরও একটা মেসেজ তো অন্তত রাখা যাবে। কিন্তু কেউ একজন ফোন ধরল।
তারেক: আমি কি লিয়ার লেভিনের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
লিয়ার: বলছি।
তারেক: আপনি কি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং শুটিং করেছিলেন?
লিয়ার: হ্যাঁ, কেন?
তারেক: আমি একজন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি বেণুর চাচাতো ভাই। বেণুর কথা মনে আছে?
বেণুর নাম শুনেই লিয়ার যেন কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, যা টেলিফোনের এ প্রান্ত থেকেও অনুভব করে তারেক।
লিয়ার: ১৯৭১ সালে আমি যুবক, বয়স ৩০ বছর। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমার অনেক কিছুই ওই ছবিতে দিয়েছি—অনেক টাকা, অনেক সময়। কিন্তু ছবিটি শেষ করতে পারিনি। এত দিন পর আজ বাংলাদেশের কেউ একজন আমাকে ফোন করল। আমি প্রায় ২০ বছর এই ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
লিয়ারের ফুটেজ দেখতে চাইল তারেক, ওগুলো নিয়ে কিছু করতে চায় ও। উত্তরে লিয়ার বলল, ‘আমার ফুটেজ যদি বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগে, আমি খুবই খুশি হব।’
‘ফিল্ম ভিডিও আর্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা যন্ত্র ভাড়া করে আমরা ঘণ্টাখানেকের মতো ফুটেজ দেখলাম। ফুটেজ দেখার পর আমাদের ঘোর কাটতে সময় লাগল! রঙিন সবাক একাত্তর দেখে, তরুণ বয়সের বেণুসহ পরিচিত এতগুলো মুখ দেখে তারেক প্রায় বাক্রুদ্ধ! আমরা ধরে নিয়েছিলাম, ২০-৩০ মিনিটের নিউজরিল পাব। যখন শুনলাম, এ রকম আরও ১৭-১৮ ঘণ্টার ফুটেজ রয়েছে লিয়ারের কাছে, আমাদের আবেগ ও উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলাম না।
এ দলের শিল্পীরা সীমান্ত এলাকায়, ট্রেনিং ক্যাম্পে, শরণার্থীশিবিরে ও সুযোগ হলে এমনকি মুক্তাঞ্চলেও গান গেয়ে সবার মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করতেন। তারিক ভাই বললেন, তখন একটা মার্কিন শুটিং দলও তাঁদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। খুব জানতে ইচ্ছা করছিল ফুটেজগুলোর কী হলো?
এভাবেই শুরু হলো ‘মুক্তির গান’ ছবি নির্মাণের দ্বিতীয় অধ্যায়। বহু বাধাবিপত্তি, ধৈর্য ও কষ্টের মধ্য দিয়ে পাঁচ বছর ধরে ছবিটির কাজ চলল। তবে ‘মুক্তির গান’ বিনির্মাণ করতে গিয়ে আর্থিক বা রাজনৈতিক যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখে আমাদের পড়তে হয়েছিল বা দিনের পর দিন যে প্রাণান্তকর শ্রম আমাদের দিতে হয়েছিল, তার বিবরণ দিতে এ লেখা নয়। বরং ২০ বছর আগে একজন নিবেদিতপ্রাণ বিদেশির তোলা প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ থেকে সমকালীন বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য চার বছরের সম্পাদনায় একটি নতুন ছবি জন্ম নেওয়ার জটিল অথচ মজার প্রক্রিয়ার বিবরণ দিতেই আমার এ লেখা। যদিও এ লেখায় ‘প্রামাণ্য দলিলে’র জনপ্রিয় মিথটির আবরণ কিছুটা খসে পড়বে। তবে একই সঙ্গে ছবিটি বিনির্মাণের পেছনের স্বতন্ত্র ও সৃজনশীল প্রক্রিয়াটি উন্মোচিত হবে।
লিয়ারের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর আমরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে তাঁর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করি। আমাদের কাজ ছিল ফুটেজগুলো দেখা ও তালিকা তৈরি করা। লিয়ারের বাড়ির বেজমেন্ট আর সব বাড়ির মতো ধুলা আর আবর্জনায় ভরা ছিল না। ওটা ছিল একজন পেশাদার চিত্রনির্মাতার সংরক্ষণাগার। রক্ষণাবেক্ষণেও পেশাদারত্বের ছাপ স্পষ্ট।
দেয়ালের তাকগুলো ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। থরে থরে সাজানো চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ক্যান ও বাক্স। একদিকের দেয়ালে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন লিয়ার। দেখলাম অনেক কার্ডবোর্ড বাক্স। প্রতিটা বাক্সের গায়ে স্পষ্ট হাতে লেখা ‘বাংলাদেশ’, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরম যত্নে তুলে রাখা আছে। পরের কয়েক সপ্তাহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা পোর্টেবল ভিউয়ার মেশিনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফুটেজগুলো দেখলাম। সব মিলে ৯১টি ক্যান, দৈর্ঘ্যে যা প্রায় ৩৬ হাজার ফুট, অর্থাৎ ১৮ ঘণ্টার ফুটেজ। একটা জাতির জন্ম নেওয়ার অবিশ্বাস্য, দুর্লভ চিত্র আমাদের চোখের সামনে। কাব্যিক এসব ফুটেজে চিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিনের প্রতিভা ও সংবেদনশীলতার ছাপ সুস্পষ্ট। নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তাঞ্চলে আসার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দলটির দেখা হওয়ার ফুজেটও কিছু পাওয়া গেল।
অবশ্য লিয়ারের ফুটেজের প্রধান অংশে ঠিক মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গানের দল ছিল না। ফুটেজগুলো জুড়ে ছিল শরাণার্থীশিবিরের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন, গ্রামবাংলার দৃশ্য। লোকজন ধান মাড়াই করছে, বাজারে যাচ্ছে, মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে গরুর গাড়ি, নদীতে লোকজন গোসল করছে। শরণার্থীশিবিরের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ের ব্যাপক ফুটেজ পাওয়া গেল, যা দিয়ে ভিন্ন একটা ছবি হতে পারত। যেমন উদ্বাস্তু শিবিরে মহিলারা রান্না করছে, শিশুরা পানি আনছে, পানিতে দাপাদাপি করছে, লোকজন রেশন নিচ্ছে, শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে ফেরার কয়েক মাস পর লিয়ার তাঁর ফুটেজ নিয়ে টানা এক মাস সম্পাদনা করে প্রায় এক ঘণ্টার একটি ছবিও দাঁড় করিয়েছিলেন। ‘জয় বাংলা’ নামের এ ছবি ছিল নৈসর্গিক ও নৃতাত্ত্বিক ধাঁচের। যুদ্ধের পরোক্ষ পটভূমিতে অত্যন্ত মানবিক ভঙ্গিতে তিনি বাংলাদেশের মানুষের জীবনচেতনা, উদ্দীপনা আর সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বিখ্যাত আমেরিকান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রবার্ট ফ্ল্যাহার্টির মতোই লিয়ারও প্রথাগত ধারাভাষ্যের ফাঁদে পা না দিয়ে বিমূর্ত ভঙ্গিতে যুদ্ধের বাস্তবতাকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন সাবলীলভাবে। লিয়ার আসলে একটা কোলাজধর্মী গল্প দাঁড় করিয়েছিলেন। বাংলার গ্রামীণ সৌন্দর্যের বিপরীতে শরণার্থীশিবিরের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তুলে ধরে লিয়ার বোঝাতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ না হলে জীবন কত সুন্দর হতো! নান্দনিক বিচারে চমত্কার হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় লিয়ারের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ওই যুদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও তার বিরদ্ধে গড়ে ওঠা সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি।
১৯৭১ সালে আমি যুবক, বয়স ৩০ বছর। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমার অনেক কিছুই ওই ছবিতে দিয়েছি—অনেক টাকা, অনেক সময়। কিন্তু ছবিটি শেষ করতে পারিনি। এত দিন পর আজ বাংলাদেশের কেউ একজন আমাকে ফোন করল। আমি প্রায় ২০ বছর এই ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।লিয়ার লেভিন
ছবির একটা প্রধান দৃশ্যে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত। পরের দৃশ্যেই দেখি, চিরাচরিত বাংলার শান্ত নদীর ঝিকিমিকি ঢেউয়ে নৌকা বাইছে এক মাঝি। প্রথম দৃশ্যের মরিয়া আর করুণভাব এবং পরবর্তী দৃশ্যের কাব্যিক সৌন্দর্য এক গভীর দ্বন্দ্বের দ্যোতনা তৈরি করেছে। লিয়ারের সম্পাদনায় বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে এবং যুদ্ধকালে শিল্পীদলটিকে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায়, ওরা যেন আরও জটিল কোনো গল্পের অংশমাত্র। শিল্পীদলের রাজনৈতিক বক্তব্যপূর্ণ সংগীতের পরিবর্তে লিয়ার বরং তাঁর ছবিটি বিমূর্ত ও কাব্যিক কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঘরানার মার্গীয় যন্ত্রসংগীত ব্যবহার করেন।
লিয়ার হয়তো ভেবেছিলেন, ‘জয় বাংলা’ আমেরিকার রুচিশীল দর্শকদের কাছে আবেদন জাগাবে। প্রাচ্যের রহস্যময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি তাঁদের মুগ্ধ করবে। তাঁরা পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের দুরবস্থাও দেখতে পাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লিয়ারের এ ছবি কাঙ্ক্ষিত দর্শকদের কাছে পৌঁছায়নি। লিয়ারের আমেরিকা ফেরার অল্প কিছুদিন পরই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এক মাস পরিশ্রম করে সম্পাদনার পর লিয়ার দেখলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকানদের আগ্রহে দ্রুত ভাটা পড়েছে। লিয়ার ছবি শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও পাননি। ফলে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে তাঁর প্রকল্প। বলা যেতে পারে, ২০ বছর ধরে প্রকল্পটি তাঁর বেজমেন্টে পড়ে থাকে। এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প পরিত্যক্ত হওয়ায় লিয়ারের যে দুঃখ, তা আমাদেরও গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাঁর মহতী উদ্যোগের দুঃখজনক পরিণতি আমাদের মধ্যে এক প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির জন্ম দেয়—যেকোনো মূল্যে ছবিটি আমাদের শেষ করতে হবে।
সব ফুটেজ দেখা শেষ হলে আমরা ছবিটির একটা খসড়া চিত্রনাট্য প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’র চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ছবির ধারণা এল মাথায়। বিদেশি দর্শকদের বদলে বরং বাংলাদেশের সমকালীন দর্শক, বিশেষ করে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে আমরা দর্শক হিসেবে বেছে নিলাম, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের উপাখ্যান সম্পর্কে নানাভাবে বিভ্রান্ত, যাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি অনেকটাই ধোঁয়াশা। এ ভাবনা থেকেই আমরা উদ্বাস্তু শিল্পীদলটির ওপর বেশি গুরুত্ব দিলাম। আমাদের মনে হলো, তাদের প্রতিদিনের জীবন ও সংগ্রাম, সর্বোপরি তাদের গানগুলো ছবির গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সহজেই বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে তুলে ধরবে। আমরা তাই লিয়ারের তোলা শরণার্থীশিবির ও গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের ব্যাপক দৃশ্য সম্ভার বাদ দিয়ে গেলাম। প্রথম দিকে আমরা গতানুগতিক ধাঁচ অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম। আমরা ভাবলাম, গানের দলটির শিল্পীদের সবার আলাদা আলাদা সাক্ষাৎকার নেব। সাক্ষাৎকারে শিল্পীরা তাঁদের একাত্তরের অভিজ্ঞতা স্মৃতিচারণা করবেন। স্মৃতিচারণার সূত্র ধরে আমরা লিয়ারের ক্যামেরায় ধরা পড়া একাত্তরের ফুটেজগুলোতে ফিরে যাব।
পরে এ পরিকল্পনা থেকে আমরা সরে আসি। কারণ, আমাদের মনে হয়েছিল বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকদের কাছে এ কাঠামো বা ধরনটি আকর্ষণীয় হবে না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা যুদ্ধ দেখেনি একাত্তরের আদর্শায়িত গানের শিল্পীদের ফুটেজের সঙ্গে আজকের বয়স্ক শিল্পীদের স্বপ্নভঙ্গের অভিব্যক্তি তরুণ প্রজন্মের দর্শককে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আরও হতাশ করে তুলবে। আমরা বরং গল্পের ঢঙে ছবিটিকে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক হলো গানের দলটিকে নিয়ে একটা গল্প দাঁড় করিয়ে তাদের পাওয়া গানগুলো দিয়ে ছবিটাকে অনেকটা সংগীতনির্ভর করে তোলা হবে। আমাদের মনে হলো, গানের দলটিকে কেন্দ্র করে গাঁথা গল্প বিষয়–গুণেই সাবলীল গতিতে এগিয়ে যাবে। আমরা কিছুটা ‘রোড মুভি’ও কিছুটা ‘মিউজিক্যাল’-এর চরিত্র অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর এক রাতের মধ্যে আমরা একটি ভিডিও রাফকাট তৈরি করে ফেললাম। উদ্দেশ্য প্রবাসীদের মধ্যে প্রদর্শনী করে তহবিল সংগ্রহ। আমরা গল্পটাকে কিছুটা ঢিলেঢালাভাবেই সাজালাম। আর শিল্পীদলের এই একরৈখিক কাহিনির স্বাভাবিক পরিণতি ছিল তাঁদের মুক্তাঞ্চলে গমন। এর সঙ্গে আমরা জুড়ে দিলাম লিয়ারের তোলা অসাধারণ কিছু দৃশ্য। বেশির ভাগই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লোজআপ—যোদ্ধারা গান শুনছেন, বৃষ্টিতে আটকা পড়ে আছেন, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবিগুলো ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ও চিরন্তন। আর এগুলো এমনই চমৎকার উপলব্ধি জাগায় যে সাধারণ কোনো ফটোসাংবাদিকের লেন্সে ধরা পড়ার কথা নয়।
আমাদের রাফকাট প্রদর্শনীতে অনেক ধরনের দর্শক প্রতিক্রিয়া পেলাম। এটা আমাদের ছবির চিত্রনাট্য চূড়ান্ত করতে ভীষণ কাজে লাগল। আমরা বুঝতে পারলাম, লিয়ারের ফুটেজ থেকে তৈরি করা শিল্পীদলের গল্পটিই যথেষ্ট নয়, আরও কিছু চায় দর্শক। আরও নিবিড় একটা গল্প চায় তারা, চায় আরও বাড়তি উপকরণ। অবশ্য আমরা সেখানে কোনো ধারাবর্ণনা ব্যবহার করিনি। আমাদের মনে হয়েছিল, এতে এটি হয়তো একটি ব্যক্তিগত গল্প হয়ে উঠবে।
কিছু দর্শক ছবি দেখে বললেন, তাঁরা বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে আরও কিছু দেখতে চান। শুধু গানের দলটি গল্পে প্রধান হয়ে ওঠায় তাঁদের মনে হয়েছে, ছবিটা ‘মধ্যবিত্ত চরিত্রের’। কেউ কেউ বললেন, তাঁরা ছবিতে যুদ্ধ ও গণহত্যার ফুটেজ আশা করেছিলেন, চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আরও অ্যাকশনের দৃশ্য। যুদ্ধের কিছু প্রধান ঘটনার উল্লেখ থাকা উচিত ছিল বলেও অনেকে মন্তব্য করেন। কিছু দর্শক হতাশা ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ফুটেজ না থাকায়। এসব প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে আমরা ঠিক করলাম, দুটো প্রধান বিষয় ছবিতে যুক্ত করা হবে। প্রথমত, বিভিন্ন উৎস সন্ধান করে যুদ্ধের কিছু প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক দৃশ্য সংযোজন করে ছবির বৈচিত্র্য ও পরিধি বাড়ানো; দ্বিতীয়ত, ছবির গল্পধর্মী গাঁথুনি ধরে রাখতে ধারা বর্ণনায় উত্তম পুরুষের ব্যবহার।
১৯৯২ সালের শরৎকালে আমার নানার বাড়ি কানেক্টিকাটে আমরা এক সপ্তাহের স্বেচ্ছানির্বাসনে গেলাম। এ সময় কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের ছবির প্রাথমিক চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেললাম। এই চিত্রনাট্যের জন্য প্রয়োজন পড়ল যুদ্ধের কিছু স্টক ফুটেজ—গণহত্যা, লড়াই, হাজার হাজার শরণার্থীর নিরাপদ আশ্রয় সন্ধান, বিজয় উৎসব ইত্যাদি। চিত্রনাট্যের অংশ হিসেবেই আমরা ধারাভাষ্যের একটা খসড়াও লিখে ফেলেছিলাম। বর্ণনাটি ছিল শিল্পীদলের একজন সদস্যের চোখ দিয়ে দেখা। আর শিল্পীদলের একজন হিসেবে আমরা তারিক আলিকে বেছে নিলাম। কারণ, বেশির ভাগ ফুটেজেই তিনি উপস্থিত। এ ছাড়া তিনি ছিলেন একজন সাদাসিধে, হাসিখুশি চরিত্রের মানুষ, যা বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের ভালো লাগবে। লিয়ারের ফুটেজে তাঁর উপস্থিতি অনেক বেশি থাকলেও তাঁকে তুলনামূলকভাবে দলের মধ্যে খানিকটা নিষ্ক্রিয় সদস্য হিসেবে দেখা যায়। তবে ধারাভাষ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ সংযমী ছিলাম—ঠিক যতটা না হলে চলে না, ততটুকুই ব্যবহার করতে চাইছিলাম। তা যেন কোনোভাবেই দৃশ্যগুলোর সরাসরি অর্থ নির্দেশ করার মতো হয়ে না ওঠে, নিজেরাই যেন অর্থ খুঁজে নিতে পারেন দর্শকেরা।
২২ বছর পর গানের দলের সবাই একসঙ্গে মিলিত হলেন। জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের সম্পাদনা যন্ত্রে আমরা তাঁদের দুটো সম্পূর্ণ দৃশ্য—নৌকা পার হয়ে মুক্তাঞ্চলে আসা ও ‘জনতার সংগ্রাম’ গান—দেখালাম। আবেগে তাঁদের কেউ কেউ কেঁদে ফেললেন, কেউ পর্দায় নিজের তরুণ চেহারা দেখতে পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
মূল ধারাভাষ্যটি আমরা লিখেছিলাম ইংরেজিতে। আমাদের বন্ধু আলম খোরশেদ, তখন তিনি নিউইয়র্কে, এটির বাংলা করে দেন। কিছু গানের একটি তালিকাও তৈরি করলাম আমরা, লিয়ারের রেকর্ডিংয়ে যে গানগুলো ছিল না। গানগুলো একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা গাইতেন। এর বেশির ভাগই ছিল লোকসুর, শব্দগুলো শুধু পরিবর্তন করে নেওয়া হতো সে সময়। ছবির গল্পটাকে একসুরে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে এই গানগুলোর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, আমরা চাইছিলাম গানগুলো তার সঙ্গের দৃশ্যগুলোকে বর্ণনা করুক।
মূল চিত্রনাট্য শেষ হওয়ার পর শুরু করলাম সবচেয়ে শ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ কাজ—ফুটেজ সম্পাদনা। আমি ও তারেক দুজনেই এর মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, যাতে ছবির জন্য পুরোপুরি সময় দেওয়া যায়। আমার পরিবার, প্রবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠী, এমনকি আমাদের বাড়িওয়ালাও আমাদের এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করে। মাসিক চুক্তিতে একটি ‘ফিল্ম এডিটিং মেশিন’ ভাড়া করে বাসায় এনে বসালাম। আমরা তখন নিউইয়র্কের এক নির্জন প্রান্তে ‘স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে’ থাকি। ম্যানহাটান থেকে ফেরিতে ৩০ মিনিটের পথ। পাহাড়ের ওপর ছোট ছিমছাম বাসা। শহরের কোলাহল এড়িয়ে আমরা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছিলাম।
প্রকৃত সম্পাদনার কাজ শুরুর আগে আমাদের বেশ সময় নিয়ে লগিং ও ট্রান্সক্রিপশন করতে হয়েছিল। আমাদের সহকারী সম্পাদক ছিলেন দিনা হোসেন। তিনি তখন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে চলচ্চিত্র ও নৃতত্ত্বে মাস্টার্স শেষ করছিলেন। ছবির ৯১টি ক্যান নিয়ে কাজ করা, কম্পিউটারে শটের পর শট নির্ভুলভাবে লগিং করা—এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। লিয়ার অনেক দৃশ্য শুটিং করেছিলেন এলোমেলোভাবে। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথোপকথন ও গান আমাদের ট্রান্সক্রাইব করতে হয়। মূল গান ও সংলাপের রেকর্ডিং বেশির ভাগই ছিল কারিগরিভাবে নিম্নমানের, কোনোটা এমনকি ব্যবহার উপযোগী ছিল না। আমরা ওই শিল্পীদলের সদস্যদের দিয়ে আবার নতুন করে এগুলো ডাবিং করার কথা ভাবলাম।
একই সঙ্গে আর্কাইভের ফুটেজ নিয়ে আমাদের গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্কের সিবিএস ও এনবিসি এবং লন্ডনের আইটিএন, বিবিসি ও ভিসনিউজের সঙ্গে ফ্যাক্স যোগাযোগ চলতে থাকল। মুম্বাই ফিল্ম ডিভিশনেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ যথেষ্ট পরিমাণ ছিল, যা সুকদেব তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’-এর জন্য শুটিং করেছিলেন। এর অংশবিশেষ যুদ্ধবিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘নিউজরিল সিরিজ’-এ দেখানো হতো। গীতা মেহতার ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’-এর কিছু নেগেটিভ ফিল্ম ডিভিশনের কাছে ছিল। ছবিটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকশনের চমৎকার কিছু দৃশ্য আছে।
১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে সম্পাদিত ছবির একটা প্রাথমিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে গেলে আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। বাংলাদেশে ছবির প্রধান অংশের ডাবিং ও রেকর্ডিং করা হবে। লন্ডন থেকে বেণু ভাইকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে এলাম। ২২ বছর পর গানের দলের সবাই একসঙ্গে মিলিত হলেন। জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের সম্পাদনা যন্ত্রে আমরা তাঁদের দুটো সম্পূর্ণ দৃশ্য—নৌকা পার হয়ে মুক্তাঞ্চলে আসা ও ‘জনতার সংগ্রাম’ গান—দেখালাম। আবেগে তাঁদের কেউ কেউ কেঁদে ফেললেন, কেউ পর্দায় নিজের তরুণ চেহারা দেখতে পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। পরের কয়েক সপ্তাহ একটা অডিও স্টুডিও এবং এফডিসিতে পরপর কয়েকটি সেশন চলল। ছবির অনেক গান ওই সময়েই রেকর্ড করা। গানগুলো হচ্ছে ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘কিষান মজুর ভাই’, ‘যশোর–খুলনা’ ও ‘বাংলা মার দুর্নিবার’। ছবির ধারাবর্ণনা রেকর্ড করে আমরা ঢাকার কাজ শেষ করার চেষ্টা করি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল পেশাদার অভিনেতার বদলে তারিক আলির কণ্ঠেই ধারাবর্ণনা রেকর্ড করা। আমরা আসলে স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য পাঠ চাইছিলাম এবং তারিক আলি ভাইয়ের ধারাবর্ণনা সত্যি সত্যিই চলচ্চিত্রের প্রামাণ্য চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল।
রেকর্ডিং শেষ হলো। লন্ডনে ফিরে গেলেন বেণু ভাই। ফিল্ম ডিভিশনের ফুটেজ কিনতে মুম্বাই রওনা হলো তারেক। আমরা তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকশন ও শরণার্থীদের দেশত্যাগের ফুটেজ খুঁজছি। লিয়ারের সংগ্রহে শরণার্থীশিবিরের জীবন নিয়ে প্রচুর ফুটেজ ছিল। তবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে শরণার্থীর দেশত্যাগের দৃশ্য ধারণ করতে দেরি করে ফেলেছিলেন তিনি। কারণ, অক্টোবর ও নভেম্বরে তিনি মুক্তাঞ্চলে ও পশ্চিমবঙ্গে শুটিং করেছিলেন, তত দিনে শরণার্থীর স্রোত প্রায় থেমে গিয়েছে। তারেক মুম্বাইয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গীতা মেহতা, সুকদেব ও নিউজরিলের ফুটেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে এক সপ্তাহ কাটাল। অন্যান্য জায়গায় ফুটেজের চেয়ে মুম্বাইয়ের ফুটেজগুলোর সুবিধা হলো, এগুলো ৩৫ মিলিমিটার ও রঙিন, যা আমাদের ছবির চূড়ান্ত ফরম্যাট। গীতা মেহতার ফুটেজ ছাড়া তারেক প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ ফুটেজই সংগ্রহ করতে সমর্থ হলো। গীতা মেহতা তখন নিউইয়র্কে। ফিল্ম ডিভিশন তাঁর অনুমতি ছাড়া ফুটেজগুলো বিক্রি করতে রাজি নয়। সুতরাং স্টক ফুটেজ সংগ্রহের এ পর্যায়ে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হলো।
মুম্বাই থেকে আনা ফুটেজগুলোর মধ্যে রঙিন ফুটেজের সঙ্গে গেরিলা আক্রমণ ও উদ্বাস্তুদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ওপর যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ সাদা-কালো ফুটেজও ছিল। ভাবলাম, যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি হিসেবে এ ফুটেজগুলোকে টাইটেলের আগে ব্যবহার করাটাই ঠিক হবে। নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে আমরা এই নতুন উপাদানগুলো যখন মূল কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে দিলাম, তখন ছবিটি আরও পরিণত চেহারা নিল। আমাদের মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ টাইটেলের আগের দৃশ্যে যুক্ত না করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সম্পূর্ণ ভাষণটা ৩৫ মিলিমিটারে এবং সাদা-কালোয়। ভাষণের মূল নেগেটিভ ছিল ঢাকায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে। আমরা ডুপ্লিকেট নেগেটিভ স্টক কিনে নিউইয়র্ক থেকে পাঠালাম ঢাকায়। জুনায়েদ হালিম এই দুষ্প্রাপ্য স্টকে ঐতিহাসিক ভাষণটি ডুপ্লিকেট করার কাজটি সম্পন্ন করেন। সহৃদয় ড. হামিদা হোসেন ঢাকা থেকে তা নিয়ে এলেন। আমরা সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের রেডিও ঘোষণাও টাইটেলপূর্ব দৃশ্যে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলাম। ভাষণটি আমরা জার্মান বেতার ডয়েচে ভেলের আর্কাইভে খুঁজে পাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ও বর্তমানে ডয়েচে ভেলেতে কর্মরত আবদুল্লাহ আল ফারুক এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। ‘একদল মুক্তিযোদ্ধা একটা রেডিওর চারপাশে বসে অস্ত্র পরিষ্কার করছে এবং রেডিওর নব ঘুরিয়ে কিছু একটা শুনছে’—ফিল্ম ডিভিশনের এ ফুটেজের সঙ্গে আমরা জুড়ে দিলাম জিয়াউর রহমানের ঘোষণার অডিও।
ঢাকায় রেকর্ড করা গান, সংলাপ ও ধারাবর্ণনার অডিও সংযোজনের কাজ যখন শুরু করলাম, তখন ছবির পুরো কাঠামো আমাদের সামনে দাঁড়াতে শুরু করেছে। অবশ্য এরপরও কিছু দুর্বলতা ছিল। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে রঙিন স্টক ফুটেজ ছিল না। বিশেষ করে ছবির শেষ অংশে গিয়ে সমস্যাটা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। আমরা চাইনি যে গানের দলটির মুক্তাঞ্চলে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে ছবি শেষ হোক। পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই ছবির সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু লিয়ারের ফুটেজে ঐতিহাসিক এ মুহূর্ত ছিল না। ফলে আমাদের নিউইয়র্ক ও লন্ডনের বাণিজ্যিক লাইব্রেরির স্টক ফুটেজ ক্রয় ও অডিও ম্যানিপুলেশনের ওপর ভরসা করতে হয়। এভাবেই সম্পাদনাপূর্ব চিত্রনাট্য অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উল্লাসের একটি বাস্তব আবহ দিয়ে শেষ হয় ছবিটি।
এক মাস পরিশ্রম করে সম্পাদনার পর লিয়ার দেখলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকানদের আগ্রহে দ্রুত ভাটা পড়েছে। লিয়ার ছবি শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও পাননি। ফলে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে তাঁর প্রকল্প। বলা যেতে পারে, ২০ বছর ধরে প্রকল্পটি তাঁর বেজমেন্টে পড়ে থাকে।
যৌথ বাহিনী ও বিজয় উল্লাসের দৃশ্যের জন্য আরও গেরিলা তৎপরতার ফুটেজ আমাদের দরকার ছিল। ছবিতে কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক মাত্রা আনতে আমরা ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘে ভুট্টোর বক্তৃতার নাটকীয় একটা অংশ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফুটেজটি আমরা জাতিসংঘ থেকে বের করে ডুপ্লিকেট নেগেটিভ করে ফেরত দিই। এ ক্ষেত্রে নীরব সহযোগিতার মাধ্যমে ছবিটিকে বিরাটভাবে সমৃদ্ধ করেন জাতিসংঘে কর্মরত লেখক হাসান ফেরদৌস। গানের দলটির ট্রাকে চড়ে গান গাওয়ার বিচ্ছিন্ন কিছু ফুটেজও আমরা ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম, যাতে অডিও ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে বোঝানো যায়, যুদ্ধ শেষে তারা ঢাকা ফিরছে। গানের দলটি ট্রাকের মধ্যে একটি কীর্তন গাইছে, এমন কিছু ফুটেজ আমাদের হাতে ছিল। পেছনে উড়তে থাকা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার সামনে চলন্ত ট্রাকে হাত নেড়ে নেড়ে স্বপন চৌধুরী গাইছেন আর সবাই হাস্যোজ্জ্বল মুখে তালি দিয়ে গানের মুখটি গাইছেন। তারেক ভাবল, নতুন গান দিয়ে ডাবিং করলে এটি গল্পের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হবে।
মুম্বাইয়ে তারেক গানটি লেখা শুরু করল। মূল কীর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারেককে এমন শব্দ চয়ন করতে হয়েছিল, যেন গানটি মূল গানের সঙ্গে মিলে যায়। লিয়ারের ফুটেজে স্বপনদার গাওয়া মূল কীর্তনের কথা ছিল ‘শ্যামের লাগিয়া পরবাসী হইনু, শ্যাম কোথা গেল আমায় দাও বলে দাও না’। উচ্চারণে মিল রেখে তারেক লিখল, ‘দ্যাশেরও লাগিয়া পরদেশী হইনা শ্যাম চাচা গেল কোথায় দাও বলে দাও না।’ এ গান ও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছবি সম্পাদনা শেষ করতে আরও কয়েক মাস আমাদের প্রাণান্ত শ্রম দিতে হয়। নিউইয়র্কে আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গানটির রেকর্ডিং করা হয়। স্বপন চৌধুরীর গান রেকর্ড হয় সুদীপ্ত চ্যাটার্জির কণ্ঠে, বাদ্যযন্ত্রে সহযোগিতা করেন প্রতিবেশী বন্ধু মাহমুদ হাসান দুলু। ছবির শেষ অংশে দর্শকেরা দেখেন, গানের দলটি ঢাকার রাস্তায় বিজয় উল্লাসের মধ্যে। আসলে গানের দল সেখানে কখনোই ছিল না। আমরা শরণার্থীশিবিরে ট্রাকে গানের দলের কিছু ক্লোজআপ শটের সঙ্গে আইটিএন থেকে কেনা বিজয় উল্লাসের স্টক ফুটেজ ইন্টারকাট করে জুড়ে দিয়ে এই আবহটি তৈরি করেছিলাম।
ছবির শেষ অংশকে আরও জোরালো করতে ইয়াহিয়া খানের পাপেটটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। তার কণ্ঠে জুড়ে দেওয়া হয় তারেকের লেখা সংলাপ। সংলাপে জাতিসংঘে ভুট্টোর নাটকীয় বক্তৃতার পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের এক কৌতূককর দৃশ্য ফুটে ওঠে। ইয়াহিয়ার একক পাপেট দৃশ্যের জন্য তারেক কিছু কমিক সংলাপ লেখে—‘সপ্তম নৌবহর আসতে দেরি করছে কেন?’ ‘ভুট্টো মিঞা নিউইয়র্কে বসে করছেটা কী?’ ‘ওই ব্যাটা ব্যাটা গো...গো... গোলাম...’ ইত্যাদি।
ছবির শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃষ্টিতে আটকে পড়ার একটি সিকোয়েন্স আমরা রেখেছি। এ দৃশ্যেও অডিও ম্যানিপুলেশনের প্রয়োজন হয়েছিল। লিয়ার গেরিলা দলটির সঙ্গে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলেন। তিনি সময় নষ্ট না করে বৃষ্টিতে গেরিলাদের অপেক্ষার চমৎকার ওই দৃশ্য ধারণ করেন। আমরা এ ফুটেজকে ‘যশোর–খুলনা’ গানে উচ্ছ্বসিত গেরিলাদের প্রস্তুতির দৃশ্য এবং ‘বাংলার মা’ গানের দৃশ্যে গেরিলাদের কুচকাওয়াজ দৃশ্যের মাঝখানে ব্যবহার করতে চাইলাম।
ধারাবর্ণনায় বিষাদের আবহ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে আমরা আকাশবাণীর বিশেষ একটি সম্প্রচার ব্যবহার করার কথা ভাবলাম। ১৯৭১ সালে আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়মিত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘সংবাদ পরিক্রমা’। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণহত্যা ও গেরিলাযুদ্ধের ওপর নিয়মিত কথিকা প্রচার হতো। আমরা চেয়েছিলাম গেরিলা যোদ্ধাদের বিষণ্ন মুখাবয়বের সঙ্গে এ বেতার অনুষ্ঠান সংযোজন করে দেওয়া, যাতে তা একটা বিষাদময় আবহ তৈরি করে। প্রশ্ন দাঁড়াল, কে আকাশবাণীর ওই সম্প্রচার খুঁজে পেতে সাহায্য করবে, দেবদুলাল নিজেই?
সংলাপে জাতিসংঘে ভুট্টোর নাটকীয় বক্তৃতার পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের এক কৌতূককর দৃশ্য ফুটে ওঠে। ইয়াহিয়ার একক পাপেট দৃশ্যের জন্য তারেক কিছু কমিক সংলাপ লেখে—‘সপ্তম নৌবহর আসতে দেরি করছে কেন?’ ‘ভুট্টো মিঞা নিউইয়র্কে বসে করছেটা কী?’ ‘ওই ব্যাটা ব্যাটা গো...গো... গোলাম...’ ইত্যাদি।
নিউইয়র্কে আমাদের কয়েকজন বন্ধু বলল, দেবদুলাল অনেক দিন হয় মারা গেছেন। তবে ফোনে কলকাতায় অনেক যোগাযোগের পর দেখা গেল, দেবদুলাল দিব্যি বেঁচে আছেন। তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বুঝলাম, তিনিও আমাদের সাহায্য করতে খুবই আগ্রহী। কয়েক বছর আগে তিনি আকাশবাণী থেকে অবসর নিয়েছেন বটে, তারপরও এখনো তাঁর সেখানে বেশ যোগাযোগ আছে। ১৯৭১ সালে সম্প্রচারিত অডিও টেপ জোগাড় করতে দেবদুলাল নিজেই আকাশবাণীর আর্কাইভে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর এ চেষ্টা পুরো ব্যর্থ হলো। আকাশবাণী সংরক্ষণাগারের স্থানাভাবের কারণে প্রতি ১০ বছর পরপর পুরোনো টেপ ফেলে দেয়। এভাবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত অমূল্য টেপগুলো ১৯৮১ সালে ফেলে দেওয়া হয়।
সৌভাগ্যক্রমে আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমার লেখক সত্যেন মিত্র কিছু মূল ট্রান্সক্রিপ্ট সংরক্ষণ করেছিলেন। ওগুলো পেলেও আমাদের কাজ চলে যায়। তাঁর মাধ্যমে ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড় হলো এবং দেবদুলালকে নিয়ে আমরা তা রেকর্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। তরুণ বন্ধু জুনায়েদ হালিম ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়ে দেবদুলালের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দেবদুলালের দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মূল পাণ্ডুলিপিগুলো থেকে বাছাই করে জুনায়েদ আমাদের কয়েকটি কথিকা পাঠালে তার থেকে তিনটি কথিকার অংশবিশেষ বেছে নিয়ে আমরা একটি কথিকা লিখলাম। আমরা কথিকাগুলো টাইপ শেষে একটু বড় প্রিন্টআউট করে কলকাতায় ফ্যাক্স করলাম। তিনটি কথিকা রেকর্ড করে আমাদের কাছে নিউইয়র্কে পাঠানো হলো। এর ভিত্তিতে আমরা আহত গেরিলা যোদ্ধাদের বীরত্ব ও উদারতা নিয়ে একটা কথিকা সম্পাদনা করলাম। কিন্তু এই কথিকা ব্যবহার করতে লিয়ারের তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিষণ্ন ক্লোজআপগুলোই যথেষ্ট নয়। দরকার কোনো টুলে বা টেবিলের ওপর রাখা ওই আমলের একটি রেডিওর কিছু দৃশ্য। জুনায়েদের সহায়তায় প্রখ্যাত ক্যামেরাম্যান বেবী ইসলামকে দিয়ে তাঁরই টিনশেডের পুরোনো গ্যারেজে তা শুটিং করে আমাদের কাছে পৌঁছায়।
১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাস। আর্কাইভের ফুটেজ জোগাড় করতে আমি লন্ডনে গেলাম। লন্ডনে একটানা সাত দিন ৩০ ঘণ্টার যুদ্ধের ফুটেজ দেখলাম, এগুলোর বেশির ভাগই আইটিএনের। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আইটিএনের ফুটেজ সস্তা, ডুপ্লিকেশন ব্যয়সহ প্রতি সেকেন্ড প্রায় ৬০০ টাকা। কিন্তু আমাদের কাছে তো এ দামই অনেক। এরপরও আমি শরণার্থীদের দেশত্যাগ, গণহত্যা, গেরিলা কর্মকাণ্ড, যুদ্ধদৃশ্য, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং বিজয় উৎসবের বিস্তারিত ফুটেজ কেনা শেষ করলাম। আরও বেশি দামে ভিজনিউজ থেকেও কিছু ফুটেজ কিনলাম, যেগুলো সত্যিকারের যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গীতা মেহতা তাঁর ছবিতে অনেক স্টক ফুটেজ ব্যবহার করেছিলেন এবং আমাদের সৌভাগ্য যে কাঙ্ক্ষিত ফুটেজগুলোর বেশির ভাগই আমি লন্ডনে পেয়ে যাই। অবশ্য গীতা মেহতার ছবি থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ নেওয়া তখনো বাকি।
নিউইয়র্কে ফিরে মরিয়া হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। আসলে বিশ্বের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা কফের প্রধান নির্বাহীর স্ত্রী গীতা মেহতার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সহজ ছিল না। তিন মাস ধরে নানা উৎস থেকে তাঁর টেলিফোন নম্বর জোগাড়ের চেষ্টা করলাম। কারও কাছ থেকেই পাওয়া গেল না, এমনকি তাঁর ভাগ্নির কাছ থেকেও নয়। শেষ চেষ্টা হিসেবে কফ অফিসে তাঁর স্বামীর সচিবের কাছে আমরা একটা বার্তা লিখে এলাম। তাতে কাজ হলো। গীতা মেহতা আমাদের আসতে বলেন এবং তাঁর ফুটেজগুলো আমাদের ছবিতে ব্যবহারের তাৎক্ষণিক অনুমতি দেন। আমরা স্বস্তির হাঁপ ছেড়ে তাঁর স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্রটি মুম্বাইয়ের ফিল্ম ডিভিশনে পাঠাই। সময় গড়ায়, কোনো সাড়া আসে না। কয়েক মাস অপেক্ষার পর হাল ছেড়ে দিলাম। আর অত দূর থেকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে সহজও ছিল না।
এদিকে ছবির আরও কিছু অংশ এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মেজর গিয়াস তাঁর সহযোদ্ধাদের যে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, তা অনুসরণ করে আমরা দিনের বেলার অ্যামবুশ দৃশ্য তৈরি করলাম। মুম্বাই ও লন্ডন থেকে আনা ভিন্ন ফুটেজ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষের দৃশ্য সম্পাদনা করা হলো। কাজ প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছে। এ পর্যায়ে আমাদের মনে হলো গল্পটার একটা যথাযথ নাটকীয় সমাপ্তি দরকার। তারেক সুকদেবের ছবি থেকে বেশ কিছু ভালো ফুটেজ এনেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল শত শত মুক্তিযোদ্ধা চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছেন। আমরা প্রথমে স্লোগানগুলোকে ডাবিং করার চিন্তা করলাম। কিন্তু এডিটিং মেশিনে নিঃশব্দ ফুটেজগুলো চালিয়ে দেখা গেল, তাঁদের ঠোঁটের ভাষা পড়া খুবই কঠিন।
এবার আমাদের প্রয়োজন পড়ল মূল অডিওর। ঠিক করলাম, ‘এই না বাংলাদেশের’ গানটির সঙ্গে পানিতে লাশ ভাসছে এ ধরনের কোনো ফুটেজ রাখা হবে। কিন্তু লন্ডনে এ ধরনের ফুটেজ দেখিনি। নিউইয়র্কে যে ফুটেজগুলো দেখেছি, সেগুলোও ভালোভাবে চিত্রায়িত নয়। অবশ্য তারেক ‘নদীতে লাশ ভাসছে’ এ রকম ফুটেজ সুকদেবের ছবিতে আগেই দেখে এসেছে। তার মানে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ডিভিশন থেকে আমাদের আরও ফুটেজ কেনা দরকার। তারেক ইতিমধ্যে যে ফুটেজগুলো দেখে এসেছে ও লগিং করেছে, সেগুলো খুঁজে বের করে পাঠাতে আমরা মুম্বাইয়ে আমাদের এক সম্পাদক বন্ধু গৌরীকে অনুরোধ জানালাম। সে ফুটেজ খুঁজতে গিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের একটা খবর পাঠাল, যে খবরটির জন্য আমরা ভেতরে–ভেতরে মুখিয়ে ছিলাম। গীতা মেহতার ছবি কেনার জন্য আমাদের অনুরোধ কয়েক মাস আগেই অনুমোদিত হয়েছে। সুতরাং প্রয়োজনীয় সব ফুটেজই এখন আমরা মুম্বাই থেকে কিনতে পারি।
অধিকাংশ দৃশ্যের সম্পাদনা যখন শেষ, তখন আমরা সর্বশেষ ও সবচেয়ে জটিল কাজ অডিও সম্পাদনা ও সংমিশ্রণের জন্য তৈরি হলাম। এর জন্য আমরা উন্নত কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রটুল ব্যবহার করতে চাইছিলাম, যাতে জটিল এডিটিং ও মিক্সিংয়ের ওপর আমাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে ‘হারভেস্ট ওয়ার্কস’ নামের একটি অডিও স্টুডিও বিশেষ ছাড় দিল। হারভেস্ট ওয়ার্কস স্বাধীন (ইনডিপেনডেন্ট) চিত্রনির্মাতাদের সব সময়ই কিছু সুবিধা দিয়ে থাকে। যাহোক, আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত সব শব্দ বাদ দিলাম, পুরোনো বাজে শব্দ নতুন করে তৈরি করলাম এবং সবশেষে শব্দগুলোকে ছবির সঙ্গে যত্নের সঙ্গে জুড়ে দিলাম। এটা সত্যি যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আমাদের পক্ষে মুক্তির গান বিনির্মাণ করা ছিল অসম্ভব। ট্রাকে গাওয়া কীর্তন গানের দৃশ্য এডিটিং করতে প্রয়োজন হয়েছিল ২০টি ভিন্ন শব্দ চ্যানেলের। চিত্রের সঙ্গে শব্দের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতেও দীর্ঘদিন সম্পাদনা করতে হয়।
টাইটেলের আগের দৃশ্যে জাতিসংঘে বিতর্ক, শরণার্থীদের দুরবস্থা ও যুদ্ধের নাটকীয় অডিও মন্তাজ তৈরি করতে কয়েক স্তরে শব্দের পর শব্দ সাজাতে হয়। মেজর গিয়াস (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী) নিউইয়র্কে আসেন এবং সরাসরি কম্পিউটারে নিজের কণ্ঠ দেন, যা মূল দৃশ্যে শোনা যাচ্ছিল না। তিনি ছবিতে বিভিন্ন সামরিক কমান্ড যুক্ত করতেও আমাদের পরামর্শ দিলেন। তবে এগুলোর অডিও আমাদের সংগ্রহে না থাকায় তারেক ও সুদীপ্তের কণ্ঠে রেকর্ড করে নিই। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিও আমরা ট্র্যাকে কয়েকবার ডাবিং করলাম। টাইটেল শুরুর আগের দৃশ্যে দর্শকেরা দেখেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা মেগাফোনে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার করছেন। কণ্ঠটি আসলে তারেকের। নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিও আমাদেরই রেকর্ড করা। প্রবাসীদের দিয়ে ব্রুকলিনে একটা স্কুলের পেছনে আমরা এ রেকর্ডের কাজটি করি এবং পরে তা কম্পিউটারের মাধ্যমে ছবিতে যুক্ত করা হয়।
আসলে মুক্তির গান ছবির অধিকাংশ শব্দই পুরোপুরি সম্পাদনা পর্যায়ে তৈরি। ছবির শেষে তারিক আলির ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ শিসটি আসলে আমার নিজের দেওয়া। মূল দৃশ্যে তারিক আলি শিস দিয়ে আসলে চাইকোভস্কির সুর করছিলেন। ঝোপঝাড়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার সাউন্ড ইফেক্টটাও আমি করেছিলাম। নানাবাড়ির পেছনের জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে আমি এ শব্দ সৃষ্টি করি, তারেক তা রেকর্ড করে। সিডিতে ও টেপে এ ধরনের অনেক সাউন্ড ইফেক্ট আমরা সংগ্রহ করেছিলাম। ‘তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা’, ‘স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন’ থেকে শুরু করে ‘পুরোনো ট্রাক স্টার্ট নেওয়া’—এই সবকিছুর শব্দই জোগাড়ে ছিল।
আমাদের শব্দ সংযোজনের কাজ তখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। একদিন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই আমাদের ফোন করে জানালেন, তিনি এখন নিউইয়র্কে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি স্টুডিওতে এলেন, গেরিলা অ্যামবুশের সাউন্ড এডিটিং দেখলেন। সূক্ষ্মভাবে শব্দ সম্পাদনা করার জন্য গভীর মনোযোগ দরকার। এ জন্যই আমরা সাধারণত একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শব্দ সম্পাদনা বা মিশ্রণের কাজ করতাম। হাসনাত ভাইয়ের উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রাণিত করল। শ্রমসাধ্য এ কাজ শেষ করতে আমাদের ছয় মাস লাগল। তবে এভাবে নিরবচ্ছিন্ন যে সাউন্ডট্র্যাক আমরা তৈরি করি, সেটি প্রামাণ্যচিত্রের বাস্তবতাকে আরও জোরদার করেছিল।
অডিওর সব কাজ গুছিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছবির চূড়ান্ত কাঠামোও দাঁড় করাতে চাইলাম। আর্কাইভ ফুটেজগুলোকে ব্যবহার করে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে দেখানোর চেষ্টা করলাম। তবে আমাদের কাছে যুদ্ধের ফুটেজগুলো ছিল সব দিনের বেলার। যুদ্ধ চলাকালে খুব কম ফিল্ম ইউনিট সন্ধ্যার পর শুটিং করে তাদের জীবন ও যন্ত্রপাতির ঝুঁকি নিত। সামরিক অপারেশন চলার সময়ও শুটিং করার সুযোগ তারা পেত না। এদিকে অধিকাংশ গেরিলা হামলাই চালানো হয়েছিল সূর্য ডোবার পর। আমরা ভেবে দেখলাম, সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরতে গেলে অবশ্যই রাতের গেরিলাযুদ্ধ ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু দিনের বেলার যুদ্ধ দেখালে তা হবে ইতিহাস বিকৃতির শামিল।
তাই কয়েকজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে সাভার প্রভৃতি বাস্তব লোকেশনে রাতের গেরিলা লড়াইয়ের দৃশ্য নির্মাণ করে তবেই আমরা সন্তুষ্ট হলাম। পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাউকে নেতা করে, কাউকে প্রশিক্ষক করে, তরুণ প্রজন্মের কয়েকজনকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে আরিচা রোডের জলাভূমি এলাকায় টানা তিন রাত শুটিং চলল। এ এলাকাতেই ১৯৭১ সালে একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দৃশ্যায়নের জন্য বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেলেও গেরিলাযুদ্ধের শুটিংয়ের জন্য বেশ কয়েকজন তরুণের দরকার পড়ল, যাঁদের অস্ত্র চালানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। সৈয়দ শামীম নামের একজন উঠতি চলচ্চিত্র ও সাহিত্যকর্মী এ ধরনের কয়েকটি ‘ক্যাডার’ ছেলেকে শুটিংয়ের প্রয়োজনে জোগাড় করে এনেছিল। শুটিংয়ে অংশ নেওয়া এই তরুণদের মধ্যে তিনজন কয়েক মাস পর নিজেদের কোন্দলের শিকার হয়ে সংঘর্ষে মারা পড়েন। সাভারে ধারণ করা রাতের গেরিলাযুদ্ধের এই সম্পাদিত অংশ তারেক নিউইয়র্কে পাঠাল। আমি ছবিতে নিয়ে তাতে সাউন্ড ইফেক্ট দিলাম। যুদ্ধের দৃশ্যের সঙ্গে সুজেয় শ্যামের অর্কেস্ট্রায় ‘জনতার সংগ্রাম’ অডিওটিও মেইল করা হয়েছিল। সর্বশেষ সংযোজনা হিসেবে অডিওটি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্মস্পর্শী শেষ ক্লোজআপগুলোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো।
মুক্তির গান ছবির অধিকাংশ শব্দই পুরোপুরি সম্পাদনা পর্যায়ে তৈরি। ছবির শেষে তারিক আলির ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ শিসটি আসলে আমার নিজের দেওয়া। মূল দৃশ্যে তারিক আলি শিস দিয়ে আসলে চাইকোভস্কির সুর করছিলেন। ঝোপঝাড়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার সাউন্ড ইফেক্টটাও আমি করেছিলাম।
অডিও সম্পাদনার কাজ শেষ হলে আমরা ছবিটাকে আমেরিকার সেরা ল্যাবের একটি পেনসিলভেনিয়ার ‘সিনেমা আর্ট’-এ পাঠালাম। কাকতালীয়ভাবে এটা সেই ল্যাব, যেখানে ‘পথের পাঁচালী’সহ সত্যজিতের অন্য ক্ল্যাসিক ছবিগুলো ডিজিটাল ও অন্যান্য অত্যাধুনিক কারিগরি প্রক্রিয়ায় পুনরুদ্ধার করার জন্য সনি ক্ল্যাসিক ও মার্চেন্ট আইভরি কোম্পানি পাঠিয়েছিল, যাতে ছবিগুলো সারা বিশ্বে মুক্তি দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ল্যাবে অগ্নিকাণ্ডে ছবিগুলো আংশিক নষ্ট হয়েছিল।
পেনসিলভেনিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা ‘সিনেমা আর্ট’-এ রয়েছে দুর্লভ চিত্রকর্ম নির্মাণের সব রকমের সুবিধা। ল্যাবমালিক জন অ্যালেন বাবা জন অ্যালেন সিনিয়রের মতোই সিনেমাপাগল। তাঁর ছেলে ১০ বছর বয়সী জন অ্যালেন জুনিয়রও বাবা বা দাদার চেয়ে কম যায় না। এ বয়সেই সে শিখে ফেলেছে কীভাবে ফিল্মের নেগেটিভ নিয়ে কাজ করতে হয়, কীভাবে কম্পিউটারে ফুটেজ কাউন্ট যুক্ত করতে হয়। ‘মুক্তির গান’–এর ফুটেজ কাউন্টার ও কম্পিউটার লগিংয়ের কাজ বালক জনই করেছিল। এটি সত্যি যে নিউইয়র্কের অনেক ল্যাবের তুলনায় ‘সিনেমা আর্ট’ অনেক ব্যয়বহুল। তবে তাদের কাজ খুবই ভালো। জন অ্যালেন নিজে আমাদের কাজটি তত্ত্বাবধান করেন, যেন আমরা আমাদের নেগেটিভ থেকে সবচেয়ে ভালো মানের প্রিন্ট পেতে পারি। বিভিন্ন ও বিচিত্র উৎস থেকে সংগৃহীত ৩৫ মিমি, সুপার ১৬, নেগেটিভ ইন্টার নেগেটিভ স্টকগুলো থেকে সূক্ষ্ম কালার কারেকশনের মাধ্যমে চমৎকার মসৃণ একটা প্রিন্ট তৈরি করে দেন অ্যালেন।
আমাদের কাজ যখন পুরোপুরি শেষ, ল্যাব থেকে প্রিন্ট নিয়ে দেখলাম। ছবিটি দেখে আমাদের মধ্যে একধরনের শূন্যতাবোধ তৈরি হলো। এত দিন স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের কাজ করতে আর দেখতে ঠিক এ রকমই বিচ্ছিন্নতাবোধ আমাদের পেয়ে বসত। এখন ছবি দেখতে গিয়ে আমরা আসলে কিছুই অনুভব করলাম না শুধু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা ছাড়া। ’৭১-এ লিয়ারের ত্যাগ ও শ্রমের পর আমাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল এ ছবি। কিন্তু প্রথমবারের মতো এটি দেখতে গিয়ে আমাদের শুধু পরিশ্রমের কথাই মনে ভেসে এল। মনে এল দিনার স্বেচ্ছাসেবী পরিশ্রম, লিয়ারের উদারতা, বাড়িওয়ালার ধৈর্যশক্তি, অনেক বাংলাদেশি তরুণ ক্যাবচালকসহ প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তার কথা। মনে পড়ল, সর্বোপরি, সুদূর বাংলাদেশ থেকে ছবি শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল জোগান দিতে শহিদুল্লাহ খান বাদল, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও হাবিব খানের অবদান।
ছবি তৈরির সময় আমাদের সারাক্ষণ একটি ইচ্ছা তাড়া করত—আরও ফুটেজ জোগাড় করব, আরও আরও অনেক উপকরণ ছবিতে যুক্ত করব, যাতে আমাদের কাজটি পূর্ণাঙ্গ হয়। আমাদের এমনও হতাশার সময় গিয়েছে, যখন মনে হতো ছবি আদৌ শেষ হবে কি না। কাজের মাঝখানে এটিও অনুমান করা কঠিন ছিল—বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে ছবিটি কতখানি প্রভাব ফেলবে। হাজার হাজার মাইল দূরে আমাদের জন্য কী প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা করে আছে, তার সামান্যই আমরা অনুমান করতে পেরেছিলাম। ছবিটি শেষ হওয়ার পরও সেদিন আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর কত সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পরিবেশক খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম, নিজেদের দু-তিন বছর ধরে ছবি প্রদর্শনী করার সংগ্রাম।
এই হলো ‘মুক্তির গান’ মুক্ত পাওয়ার গল্প। তার সঙ্গে জড়ানো আনন্দ-বেদনার বিবরণ একান্তই ভিন্ন বিষয়, যা অন্য সময়ে বলা যাবে। ‘মুক্তির গান’ তৈরির এ সংগ্রাম অবশেষে ২৫ বছর পর শেষ হলো।