
মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে চেঙ্গিস খানের নাম অথবা উল্টোটি বললেও ভুল হবে না। মধ্যযুগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। ভ্রমণকারী এলিজা বিনতে এলাহী একবিংশ শতাব্দীতে কেমন দেখলেন আজকের মঙ্গোলিয়া? সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছেন ধারাবাহিকভাবে।
কারাকোরাম শহরে ‘সিক্রেট অব সিল্করোড রিসোর্ট’–এর ডাইনিং হলে সবাই মিলে নাশতা করলাম। গোবি মরুভূমির কাছাকাছি একটি নোমাড পরিবারের বাড়িতে যাব ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল রাইড প্রোগ্রাম রয়েছে। তুসিনতুর জানাল, এই পরিবারের নিজস্ব ৫০–এর অধিক ব্যাকট্রিয়ান উট আছে।
সেই একই রকম প্রান্তরে প্রবেশ করেছি। এই প্রান্তরে একটু পরপর দু–তিনটি করে গের রয়েছে। আপ্যায়নের ধরনও একই রকম। দুধ–চা লবণসহ, হাতে বানানো রুটি আর দুধের সরের পিঠা খেতে দিলেন। আপ্যায়নের পর ক্যামেল রাইডের পালা এল। মিসরে উটের পিঠে চড়েছিলাম। এই প্রাণীর লম্বা পাগুলো দেখলে মনে হয়, এই বুঝি হোঁচট খেল। কেনিয়ার মাসাইমারাতে যখন জিরাফ দেখেছি, তখনো একই রকম ঠেকেছে।
আরও একটি বিষয় হলো, নিজের মনোরঞ্জন কিংবা অভিজ্ঞতা যা–ই বলি না কেন, শুধু সে কারণে নিরীহ এই প্রাণীগুলোকে কষ্ট দিতে কেমন জানি লাগে। মানে খুব বেশি উপভোগ্য লাগে না আমার কাছে। যখন পৃথিবীতে বাহন ছিল না, সে সময়ের কথা আলাদা কিংবা এখনো যেসব অঞ্চলে বাহনের অপ্রতুলতা রয়েছে, তারা প্রাণীদের ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অকারণে প্রাণীকে ব্যবহার করা ভালো ঠেকে না। গেরমালিকের তিন ছেলে সবাই তাকে সাহায্য করে পশু লালন–পালনে। ছোট ছেলে রেসলার। তিনিই আমাদের ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল রাইডে সাহায্য করলেন।
যা–ই হোক তুসিনতুর, ক্যামেল মালিকের জোরাজুরিতে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য রাজি হলাম। গেরের চারদিকে দেখছি মেলা ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল। রাইড শেষ করার পর গেরমালিক আমাদের একটি ক্যামেল দেখিয়ে বললেন এটি মঙ্গোলিয়ার সব থেকে বড় ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল (বয়স ও উচ্চতায়)।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা নিজেদের গেরের উদ্দেশে রওনা করলাম। গোবি মরুভূমির কাছাকাছি আমাদের গের ক্যাম্প। প্রান্তর থেকে বেরিয়ে পিচের রাস্তা ধরলাম আমরা। নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে মানুষের চেয়ে বাইসাইকেলের সংখ্যা বেশি, আর মঙ্গোলিয়ায় মনুষ্য জাতির তুলনায় ঘোড়া অনেক অনেক বেশি।
কেনিয়ার মাসাইমারা প্রান্তরে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণী রয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা মঙ্গোলিয়ার স্তেপ অঞ্চলগুলোতে ঘোড়া, গরু, ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল, ভেড়া ও নানা জাতের ছাগলের সংখ্যাকে অবশ্যই ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কেউ কেউ হয়তো গ্রেট মাইগ্রেশনের কথা বলবেন। কিন্তু সেটি একটি বিশেষ সময়। আর মঙ্গোলিয়াতে সাধারণ সময়টাই প্রাণী পূর্ণ। যেতে যেতে আর্থের গাড়ি একটু ব্রেক করল। আমার চোখ বুজে গিয়েছিল, চোখ খুলে দেখি পথে ঘোড়ার জটলা। আমি বুঝতে পারছিলাম না। তুসিনতুর বলল, ‘হর্স ইজ ফিডিং হার চাইল্ড।’ একটি মা ঘোড়াকে ঘিরে অনেকগুলো বাচ্চা ঘোড়া। গাড়ি থামিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম। অল্প সময় পরেই চলতে আরম্ভ করলাম। এ রকম চলতে চলতে আগের মতোই আচমকা ড্রাইভার আর্থ প্রবেশ করল বালুকাময় একটি পথে। পথ তো খানাখন্দে ভর্তি।
এসে পৌঁছালাম গের ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পের নাম বায়ান গোবি। একটি বালুকাময় চত্বরে ৩০–৪০টি গের। মাঝে একটি বড় গের রয়েছে, সেটি ডাইনিং হল। গেরগুলোতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিছুটা দূরে স্নান করার জায়গা তার পাশেই টয়লেট। এখানকার তাপমাত্রা ভীষণ তেজি। মরুভূমির পাশে, তাপমান বেশি হওয়ারই কথা। গেরগুলোতে কোনো সিলিং ফ্যান নেই। তার অর্থ রাতে তাপমাত্রা নেমে যায়। মরক্কো ভ্রমণে সাহারা মরুভূমিতে সে রকমটাই দেখেছি।
ভিন্ন রকম গের
এই চত্বরে সব কটি গের একই রকম কিন্তু প্রবেশমুখে দুটি গের রাখা হয়েছে, যেটির আকৃতি একটু ভিন্ন। সেখানে একটি বোর্ডে লেখাও রয়েছে সুভ্যেনির। চারটি বড় বড় চাকাযুক্ত একটি বাহনের ওপর গেরটিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। গেরের আকারটিও বড়। এই গেরটির ব্যাখ্যা চাইলাম তুসিনতুরের কাছে। আমি বুঝতে পারছিলাম গের টেনে নেওয়ার বাহন এটি। তাই আমি জানতে চেয়েছি চারটি না ছয়টি ঘোড়া বা মহিষ টেনে নিয়ে যায় বাহনটি। তুসিনতুর বলল ২০ থেকে ৩০টি ষাঁড় টেনে নিয়ে যায় এ ধরনের বাহন। কারণ, বাহনে শুধু গের থাকে না, তাদের পালিত প্রাণীও এই বাহনে টেনে নেওয়া হতো প্রাচীন সময়ে।
গোবি মরুতে বৌদ্ধমন্দির
দুপুরের খাবার শেষ করে আমাদের গন্তব্য একটি বৌদ্ধমন্দির দেখা। তারপর গোবি দর্শন। গোবির বালিয়াড়ি পার হয়ে পাথুরে পাহাড়ের ওপরে বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। গোবির পাশ দিয়ে আমাদের গাড়ি যে কোথায় যাওয়া শুরু করল। শুধু দেখছি বড় বড় পাথরের বিশাল পাহাড়। মাঝে তৃণভূমি। প্রতিটি পথই এ রকম। সামনে তাকালে মনে হয়, আসলে কি কোথাও যাচ্ছি? এ রকম ঘণ্টাখানেক চলার পর, গাড়িতে বসেই পাহাড়ের ওপর একটি স্তূপা দেখতে পেলাম। বুঝলাম আশপাশে কোনো মন্দির আছে। জিপ এসে দাঁড়াল একটি পর্বতের কোনায়!
একটি সরু রাস্তা চলে গেছে পর্বত বরাবর। অল্প দূরত্বেই একটি মন্দির। দুপাশে দুটো স্তূপা। মন্দিরের ভেতরে গেলাম। কী গোছানো, সাজানো এবং রঙিন। কর্তব্যরত একজন নারী ঘুরিয়ে দেখালেন সব। মূল বৌদ্ধমন্দিরটি পাহাড়ের ওপরে রয়েছে। সেদিকে রওনা করলাম। পাথুরে পথে বেশ সাবধানে যাচ্ছি। তুসিনতুর আমাদের ছেড়ে তরতর করে উঠে গেল।
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার শুরু। মাঝখানে কমিউনিজমের সময় ধর্মকর্মে ভাটা পড়েছিল, ইদানীং আবার উৎসাহ বেড়েছে। মনে করা হয় মন্দিরটি ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। মন্দিরের চাতালে ছিল ১০০টির বেশি স্তূপ। এখন নেই। কয়েকটি ধ্বংসাবশেষ বেঁচে আছে।
পাহাড়ের ওপরের মন্দিরটি তিব্বতীয় বৌদ্ধমন্দির। চারপাশের বাতাবরণও ঠিক তিব্বতের মতোই। অনেক ছোট–বড় মন্দির বা তাদের ভগ্নাংশ শহরে ও মরুভূমিতে ছড়ানো। গণতান্ত্রিক মঙ্গোলিয়ায় এগুলোর সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে, তার সঙ্গে ট্যুরিজমেরও উন্নতি চলছে। নিচে নেমে ধ্বংসাবশেষের দিকে এগোলাম। কক্ষের অবয়বে কয়েকটি দেয়াল রয়েছে। সংস্কারকাজ চলছে। আমেরিকান সরকার সংস্কারকাজ করছে।
বেশ কিছুক্ষণ মন্দির ও পাথুরে পাহাড়ে সময় কাটিয়ে আবারও একই পথে ঝাঁকি খেতে খেতে গের ক্যাম্পে ফিরলাম। সূর্যাস্তের কিছু আগে যাব মরুভূমিতে। কারণ, এখন ভীষণ তপ্ত।
ল্যান্ড অব ডাইনোসরস..!!
গোবি দর্শনের আগে রাতের খাবার খেয়ে যেতে হবে। কারণ, ডাইনিং বন্ধ হয়ে যাবে সাড়ে সাতটায়। বাইরে চকচকে রোদ। রাতের খাবার খাচ্ছি। কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে মরুভূমি থেকে ফিরে আবারও খিদে পাবে।
গোবি মরুভূমির নতুন নামকরণ হয়েছে এক শতক আগে। ২০২৩ সালে সাহারায় তাঁবুবাস করেছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল কবে গোবি মরু দেখব। নানা বাস্তবতায়, বেশ সময় লেগে গেল সাক্ষাৎ পেতে। সাহারায় যেমন মরু অঞ্চলেই তাঁবুবাসের সুযোগ আছে, গোবিতে সে রকম নয়। বালিয়াড়ির বাইরে তৃণভূমি অঞ্চলে মঙ্গোলিয়ান যাযাবরদের ঐতিহাসিক গেরের মতো তৈরি বাসস্থানগুলোতে থাকবার ব্যবস্থা রয়েছে।
অবশ্য লাখ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি অঞ্চলের অল্প দেখেই তো আর পুরো অঞ্চল সম্পর্কে বলা যায় না। মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ ভাগজুড়ে গোবির অবস্থান। আমি কেবল দক্ষিণ-পূর্ব দিকের গোবি মরু দেখলাম।
বালুর ঢিবির একদিকে এসে আমাদের গাড়ি থামল। তুসিনতুর বলল, যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাও। আমরা হাঁটছি। কোথায় যাচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি, জানি না। অল্প দূরত্বে বেশ কয়েকজন পর্যটককে দেখতে পেলাম। তারা উঁচু বালুর ঢিবি থেকে একবার নিচের দিকে নামছেন, আবার ওপরে উঠছেন। তাদের দেখে আমার ভ্রমণসঙ্গীও তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, আমি বালুর ওপর বসে সবার কাণ্ডকারখানা দেখছি। অনেক দূরে দেখতে পাচ্ছি পর্যটকেরা ব্যাকট্রিয়ান রাইড করছে।
গোবিকে দুনিয়ার সামনে এনেছেন ইতালীয় বণিক মার্কো পোলো আর ডাইনোসরের ফসিল। তাই গোবির নতুন নাম দ্য ল্যান্ড অব ডাইনোসর। এক শতক আগে বায়ানজাগে নামের জায়গাটিতে অভিযাত্রীরা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ডাইনোসরের ডিম খুঁজে পান।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির দলটির বাকি সদস্যদের সঙ্গে ১৯২০-এর দশকের ভ্রমণের সময় জীবাশ্মবিদ রয় এনড্রিউজ জায়গাটির নাম রাখেন ‘দ্য ফ্লেমিং ক্লিফস’। কারণ, এখানকার লাল বেলে পাথরে পড়ন্ত সূর্যের আলো আশ্চর্য এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। গোটা এলাকা এ সময় আগুনে লাল রং ধারণ করে।
গোবি মরুভূমি তার রুক্ষ পরিবেশ এবং চরম আবহাওয়ার জন্য পরিচিত। শীতকালে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায় এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ চড়া। বিকেল ৮টায় মরু অঞ্চল ভ্রমণে গেলাম। কারণ, সূর্য অস্ত যাবে সাড়ে নয়টায়। এই মরুভূমির কিছু অংশে বালুভূমি থাকলেও, এটি পাথুরে। বালিয়াড়ির পেছনেই পাথুরে পাহাড়। মার্কো পোলোর গোবি মরুভূমি অতিক্রমের ঘটনাটি তাঁর ভ্রমণকাহিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা এই মরুভূমি এবং এর চারপাশের অঞ্চলের প্রতি সবার আগ্রহ তৈরি করেছে। তিনি গোবি মরুভূমি অতিক্রম করে চীন ভ্রমণ করেছিলেন, যেখানে তিনি কুবলাই খানের দরবারে প্রায় ১৭ বছর কাটিয়েছিলেন।
মরুর পেছনেই রয়েছে পাহাড়, পাথুরে পথ আর স্তেপ অঞল। এই জন্যই গোবি বৈচিত্র্যময়। ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে প্রায়। সেই মিষ্টি রোদে সোনালি রং ধারণ করেছে গোবি। কী যে মায়াময় লাগছে। পশ্চিমে মেঘ জমেছে। মরুভূমিতে বৃষ্টি হবে! এই অঞ্চলের মানুষ মনে হয় বৃষ্টি দেখার জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকে।
সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে চারদিকে তার লাল আভা ছড়িয়ে দিল। যদিও মেঘের কারণে তা কিছুটা ম্রিয়মাণ। ওই বালুর পাহাড়ে সূর্য লুকিয়ে গেল। আমারও গাড়ির খোঁজে গেলাম!