
মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে চেঙ্গিস খানের নাম অথবা উল্টোটি বললেও ভুল হবে না। মধ্যযুগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। ভ্রমণকারী এলিজা বিনতে এলাহী একবিংশ শতাব্দীতে কেমন দেখলেন আজকের মঙ্গোলিয়া? সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছেন ধারাবাহিকভাবে।
প্রাচীন কারাকোরাম শহরের স্বপ্নে বিভোর আমি। কারাকোরাম জাদুঘর চোখের সামনে মেলে ধরেছে শহরকে। সেই অনুভূতি নিয়ে বেরোলাম জাদুঘর থেকে। নতুন গের–এ চেক-ইন তারপর লাঞ্চ।
তুসিনতুরের ভাষায় এই গের কমপ্লেক্স কারাকোরামের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক। তিন বছর আগে এই কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। মূল সড়ক থেকে একটি পথ চলে গেছে কমপ্লেক্স বরাবর। সরু পথটির দুই ধারে কাঠের ল্যাম্পপোস্ট। ল্যাম্পপোস্টের ডিজাইনে ব্যবহার করা হয়েছে নানা দেবতার মুখশ্রী কিংবা পৌরাণিক চরিত্র। এই কমপ্লেক্সটি আসলে একটি রিসোর্ট। নামটিও চমৎকার ‘সিক্রেট অব দ্য সিল্করোড’। প্যাগোডা স্টাইলের কয়েকটি বিল্ডিং এবং একটি মাঠে ৪০–৫০টি গের। আমাদেরকে গেরের চাবি দেওয়া হলো।
বাহ্, বেশ সুন্দর। গেরের সঙ্গে স্নানঘর, রেস্টরুম সবই রয়েছে। গত রাতে নোমাড পরিবারের সঙ্গে কাটানোর পর আধুনিক এই গেরকে মনে হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেল। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলের দিকে গেলাম। বেশ বড় একটি হলরুম। সাজসজ্জাও দারুণ। পর্যটকে ঠাসা ঘর। বেশির ভাগই ইউরোপিয়ান। লাঞ্চে মঙ্গোলিয়ান ও কন্টিনেটাল খাবার রয়েছে। পেট পুরে খেলাম।
আবারও বের হলাম কারাকোরামের পথে।
মঙ্গোলিয়ার প্রথম মনেস্ট্রি। মনেস্ট্রি চত্বর বেশ বড়। রোদের তাপও প্রচুর। এরডেন জুউ মনেস্ট্রির নির্মাণকাল ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দ। এ বছরই মঙ্গোলিয়া তিব্বতি বৌদ্ধধর্মকে সরকারি ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। মনে করা হয়, ১৫৮৫ সালে যখন কারাকোরাম পরিত্যক্ত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তখন তৎকালীন খালখা-মঙ্গোলীয় রাজপুত্র কর্তৃক পরিচালিত এই বৌদ্ধবিহারের মাধ্যমে শহরটি মুক্ত হয়। তৃতীয় দালাই লামার সঙ্গে রাজপুত্রের সাক্ষাৎ এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মকে মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণার ফলেই এরদেন জুউ মঠ মঙ্গোলিয়ার প্রথম বৌদ্ধবিহারে পরিণত হয়।
১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েতের শুদ্ধি অভিযানের সময়, স্ট্যালিন নিজেই কয়েকটি প্রধান মন্দির ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, এগুলোকে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতীক বলে অভিহিত করেছিলেন। মঠ কমপ্লেক্সটি অবশেষে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। মনেস্ট্রিতে ১০০টির বেশি মন্দির, প্রায় ৩০০টি ইয়ুর্ট এবং ১ হাজার সন্ন্যাসীর আবাসস্থল ছিল।
এরদেন জুউ মঠে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বৌদ্ধ গুরুদের মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান কিছু নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৩টি বৃহৎ মন্দির, একটি তিব্বতীয় শৈলীর মন্দির, একটি বৃহৎ গের মন্দির, স্তূপ, চারপাশের প্রাচীর, আরও কিছু ছোট মন্দির এবং ভবন। মন্দির চত্বরের প্রাচীর তৈরি হয়েছে ১০০টির বেশি একই রকম স্তূপার সাহায্যে।
পুরো চত্বরটিকে আমার কাছে খোলা আকাশের নিচে একটি জাদুঘর মনে হয়েছে। মূল তিনটি জুউ মন্দির (পশ্চিম জুউ মন্দির, মধ্য জুউ মন্দির ও পূর্ব জুউ মন্দির) রয়েছে, যা একটি পৃথক উঠানে অবস্থিত এবং একটি ইটের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। বর্তমানে, এরদেন জুউ বৌদ্ধ মঠটি মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে পবিত্র বৌদ্ধমন্দিরগুলোর মধ্যে একটি, বৌদ্ধ-অনুসারী মঙ্গোলরা তাঁদের জীবনে অন্তত একবার এই কমপ্লেক্সটি পরিদর্শনের চেষ্টা করেন।
মনেস্ট্রি থেকে বেরিয়ে গেলাম কারাকোরামের সবুজ প্রান্তরে। আমাদের রিসোর্টের খুব কাছেই ভ্যালি। গাড়ি দিয়ে বেশ কিছু দূর ওঠা যায়। ওমা! চারদিকে সবুজ। এত সবুজ মঙ্গোলিয়া ভীষণ অন্য রকম লাগছিল। মানে, বিশ্বাস হতে চাইছিল না। তুসিনতুর আর আর্থ বলল, এটিই আমাদের সুইজারল্যান্ড। গাড়ি একটি নির্দিস্ট স্থানে রেখে, কতক সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠলাম। ভ্যালির একদম ওপরে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে। মেলখি তোলগো উপত্যকা থেকে এই শহর কেমন দেখায়, সেটি আমাদের গাইড দেখাল। সামনে পুরো শহর। ভ্যালির ওপরেও ঘোড়া, ভেড়া চড়ছে। প্রকৃতি, মানুষ আর প্রাণীর অপূর্ব মেলবন্ধন।
বর্তমানে এই শহরে বাস করে মাত্র দশ হাজার মানুষ। শান্ত এক শহর। শহরের এক পাশে সবুজ প্রান্তর অন্য পাশে স্তেপ অঞ্চল। পথের ধারে ঘোড়া, ভেড়া, গরু, উটের সংখ্যা অগনিত। অযথা আধুনিকতার কোনো ভাব নেই শহরজুড়ে। ভ্যালির এক পাশে কারাকোরাম শহর, অন্য পাশে ওরখান নদী। এ নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন কারাকোরাম।
ভ্যালির ওপরে দেখতে পেলাম একটি টারটেল স্টোন। পাশেই একটি মন্দির। তারা মাথার ওপর খোলা আকাশকে প্রধান দেবতা মনে করেন। খোলা স্তেপে একটা ছোট পাথরের ঢিবির ওপর রঙিন কাপড় জড়ানো একটা লাঠি পোঁতা। ব্যস, এই হলো মন্দির। শুভ কাজের আগে এখানে ওরা আকাশ-ভগবানের উদ্দেশে প্রার্থনা করেন।
এখানে বেশ কয়েকটি ভ্যালি রয়েছে। তুসিনতুর অনেকগুলো নাম বলেছিল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। সব নাম মনে নেই। তবে ওরখান ভ্যালি আর নদীর কথা ভুলিনি। তুসিনতুরের পেছনে পেছনে হাঁটছি ওরখান নদী দেখব বলে। সামনে দেখতে পাচ্ছি একটি স্থাপনা। মঙ্গোল রাজ্যের মনুমেন্ট। যেহেতু ওরখান নদীর পাড়ে এই রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তাই ভ্যালির ওপর এই মনুমেন্ট বানানো হয়েছে।
এই স্মৃতিস্তম্ভটি ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। মঙ্গোল রাজ্যগুলোর উত্তরাধিকার (জিওনগনু, তুর্কি খাগানাতে এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্য) এবং তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে সম্মান জানাতেই মূলত নির্মাণ করা হয়। বৃত্তাকার স্মৃতিস্তম্ভটিতে একটি ওভু (পবিত্র পাথরের স্তূপ), ঐতিহাসিক ফলক, মূর্তি এবং প্রাচীন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং আঞ্চলিক পরিসরে চিত্রিত মানচিত্র রয়েছে। কেন্দ্রীয় ওভু প্রকৃতির সঙ্গে যাযাবর মানুষের সংযোগের প্রতীক, অন্যদিকে চারপাশের পাথর এবং নয়টি সাদা পতাকা মহান মঙ্গোল সাম্রাজ্যের স্থায়ী শক্তির প্রতীক।
মনুমেন্ট থেকে ভ্যালির দিকে অল্প কিছু দূর গেলেই চোখে পড়বে ওরখান নদী। শেষ বিকেলের আলো গিয়ে পড়েছে ওরখান ভ্যালির ওপর। তাতে নদী আরও মায়াময় লাগছে। নদীর পাড়ে দেখছি কয়েকটি গাড়ি। পর্যটকেরা একেবারে নদীর কাছে চলে গেছেন। অজানা কারণে ওরখানের স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দূর থেকেই ভালো লাগছিল ওরখান। দূরে ভ্যালির ওপরে দেখছি এক–দুটি গের। ভ্যালিতে বসেই আমরা উপভোগ করছি ভ্যালির শান্ত পরিবেশ, সবুজ আর বয়ে যাওয়া ওরখান।
আচমকা চোখ গেল একটি স্তূপার দিকে। একটিমাত্র স্তূপা। সেটিও বেশ যত্নে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্প্রতি রং করা হয়েছে। অবাক লাগছে এত ওপরে একটি স্তূপার যত্ন কে নিচ্ছে! এখানে প্রাণীগুলোর মালিক খুঁজে পাই না আর স্তূপাগুলোর পাশে কাউকেই দেখি না, কিন্তু স্তূপার চারপাশ পরিষ্কার দেখি।
মনে হচ্ছে গের বানিয়ে আজ রাত এখানেই কাটিয়ে দিই। চারদিকে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। ক্ষীণ স্বরে তুসিনতুর যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। সে হয়তো আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে। দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
রিসোর্টে পৌঁছালাম। রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং হলে গেলাম। গুড়ভানবুলাগ গ্রামে নোমাড পরিবারের সঙ্গে তাদের গেরে থাকবার পর, কারাকোরাম শহরে আধুনিক গেরে রাত্রিযাপন হলো। তাতে অভ্যাসগত কারণে শরীর আরাম বোধ করেছে; কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে গ্রামীণ যাযাবরদের গেরে। তাদের খাদ্যাভাস, জীবনধারণ, প্রাণিপ্রেম, কঠোর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করবার অভিপ্রায়, সবকিছুই বিস্ময় জাগায়। এই গেরগুলো রিসোর্টের অংশ। পুরো মঙ্গোলিয়াজুড়ে বাণিজ্যিক গেরে থাকবার সুযোগ রয়েছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিটি রিসোর্টে এ সময়টাতে পর্যটকে পূর্ণ থাকে। কারাকোরামের রাত ফুরালে কাল সকালের গন্তব্য গোবি।