সাম্প্রতিক সহিংসতার ঢেউ জনজীবনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেওয়ার পরদিন, ১২ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তরুণ রাজনৈতিক নেতা শরিফ ওসমান হাদি আহত হন এবং পরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। হাদির হত্যাকাণ্ড একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—ভিন্নমত প্রকাশ করা এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
বিষয়টি শুধু রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ও দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং প্রকাশ্যে একজন সংখ্যালঘু নাগরিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের দেখায় যে সমাজের পরিবেশ ক্রমেই সহিংসতা ও ভয় দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে হামলা কেবল তাদের অবকাঠামোর ওপর আঘাত নয়। এগুলো নাগরিকদের জানার, প্রশ্ন করার এবং ভিন্নমত পোষণের অধিকারের ওপর আক্রমণ। কারণ, স্বাধীন গণমাধ্যম সমাজের সামনে একটি আয়না ধরে রাখে। সেই আয়না ভেঙে দিলে ক্ষমতাসীনেরা আর প্রশ্নের মুখে পড়ে না, এবং মিথ্যা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। ছায়ানট ও উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলাও সমানভাবে উদ্বেগজনক।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো সহনশীলতা, মানবিক মর্যাদা এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখে। গান, কবিতা ও শিল্প আমাদের বিবেক গঠনে ভূমিকা রাখে। সে কারণেই এসব প্রতিষ্ঠান প্রায়ই প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয়। একইভাবে ময়মনসিংহে পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা এবং পরে শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনা অসহিষ্ণুতার আরেকটি চরম উদাহরণ, যেখানে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।
এই ঘটনাগুলো একত্রে দেশবাসী ও বিশ্বের কাছে বার্তা দিচ্ছে যে অসহিষ্ণুতা ব্যাপকভাবে বাড়ছে এবং জননিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়ছে। যে সমাজ কণ্ঠরোধ করে, সংস্কৃতিকে দমিয়ে দেয় এবং ভিন্নতাকে ভয় পায়, সে সমাজ হয়তো কার্যত টিকে থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার মানবিকতা, আত্মবিশ্বাস ও উন্নত ভবিষ্যতের আশা হারিয়ে ফেলে।
এসব হামলা সংঘটিত হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে। এসব সহিংসতায় শান্তিকামী ও প্রগতিশীল মানুষের বিবেক গভীরভাবে নাড়া খেয়েছে। অনেক দেশেই নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ ও সংঘাত দেখা যায়। বাংলাদেশেও নির্বাচনের আগে সহিংসতা নতুন নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আলাদা।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা ক্রমেই জনতার একটি অংশের সহিংসতার সামনে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভাঙচুর ও জনশৃঙ্খলার অবনতি উদ্বেগজনকভাবে স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। এখন মূল প্রশ্ন আর সহিংসতা আছে কি না তা নয়। বরং কেন একটি সরকারের অধীন এসব সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে, যার প্রধান দায়িত্ব ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের দুর্বলতা গভীরভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এটি সরকারের অনুপস্থিতি নয়, বরং তার নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তার দুর্বলতাকে নির্দেশ করে।
সামনে এগোনোর পথটি হতে হবে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা ও অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার ওপর ভিত্তি করে। এখন যে বিষয়টি ঝুঁকির মুখে, তা হলো জন–আস্থা ও জননিরাপত্তা। নাগরিকেরা অনুভব করতে চান যে রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁদের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়।
অতএব, মূল সমস্যা কেবল সহিংসতার উপস্থিতি নয়, বরং এর প্রতি প্রতিক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রম ছিল দ্বিধাগ্রস্ত ও অপর্যাপ্ত। বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দৃশ্যমান ফলাফল খুবই সীমিত। ওসমান হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে অগ্রগতির অভাব প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতার ধারণাকে আরও জোরদার করেছে। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রেরই কার্যকরভাবে কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে। বাংলাদেশের কার্যকর প্রতিষ্ঠান আছে, অভিজ্ঞ প্রশাসক রয়েছে। সুতরাং মূল চ্যালেঞ্জটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
বাংলাদেশে আজ জনমনে যে উদ্বেগ, তার উৎস কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গভীরভাবে প্রোথিত প্রতিদিনের অর্থনৈতিক দুর্দশায়। লাখ লাখ পরিবারের কাছে আসল সংগ্রাম ক্ষমতা কার হাতে তা নয়, বরং ক্রমবর্ধমান দাম ও সংকুচিত সুযোগের মধ্যে কীভাবে টিকে থাকা যায়। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উঁচু আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা কমলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য এখনো তীব্র রয়ে গেছে। চাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি, পরিবহন ব্যয়, বাড়িভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ পারিবারিক আয়ের বেশির ভাগ অংশ গ্রাস করছে। মজুরিভিত্তিক শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী— যাঁদের আয় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি, তাঁদের কাছে জীবন ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
আগস্ট ২০২৪-এ পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া নাজুক অবস্থা থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। এর জন্য সরকারকে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব দিতে হবে। তবে অর্থনীতিতে এখনো গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে সংস্কার কার্যক্রম চলমান। বৈদেশিক খাতের উন্নতি হয়েছে।
২০২৪ অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি, আমদানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিক পতনের অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের একই তারিখে সেটা ছিল ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। তবু নিম্ন প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দুর্বল বিনিয়োগ থেকে অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
গড় মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের নভেম্বরের ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বরে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এলেও, আয়ের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানে উন্নতির ইঙ্গিত থাকলেও, মজুরি না বাড়ায় অনেকের দৈনন্দিন জীবন সহজ হয়নি। ২০২৫ সালের নভেম্বরে মজুরি প্রবৃদ্ধি স্থবির থেকে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০২৪ সালের নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ—এর ফলে পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ আরও বেড়েছে।
কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি সৃষ্টি ধীর হয়েছে, আর অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্পমেয়াদি কাজ বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী নিয়োগ এড়িয়ে চলেছে এবং আংশিক বেকারত্ব ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে (এনইইটি) রয়েছে, যা শ্রমবাজারের গভীর চাপকে প্রকাশ করে। শ্রমবাজারে প্রবেশ করা তরুণদের জন্য স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ চাকরি পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে, যা হতাশা ও সামাজিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ দুর্বল। ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেমে এসেছে রেকর্ড সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৩ শতাংশে, যা বিনিয়োগের দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতাকে প্রতিফলিত করে। উচ্চ ব্যবসায়িক ব্যয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা স্থগিত রেখে টিকে থাকার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) জিডিপির এক শতাংশের কমে সীমিত রয়েছে; নতুন ও বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, কারণ অর্থনীতির বৈচিত্র্য ও উন্নত মানের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্বের কাছে একটি বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা ও উন্নয়ন সাফল্যের জন্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তবে মব সহিংসতার ছবি ও শাসনব্যবস্থার অনিশ্চয়তা আন্তর্জাতিক অংশীদার ও বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করছে। আন্তসংযুক্ত বিশ্বে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কীভাবে পথ খুঁজে নেবে, তা আগামী মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক ধারণাকে প্রভাবিত করবে।
অতএব, সামনে এগোনোর পথটি হতে হবে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা ও অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার ওপর ভিত্তি করে। এখন যে বিষয়টি ঝুঁকির মুখে, তা হলো জন–আস্থা ও জননিরাপত্তা। নাগরিকেরা অনুভব করতে চান যে রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁদের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়।
২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অপেক্ষায় থাকা এই সময়ে, অন্তর্বর্তী সরকারের তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নাগরিকদের সুরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
ফাহমিদা খাতুন নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
মতামত লেখকের নিজস্ব