পরিবেশ নিয়ে নবীজি(সা.) এর ১০ শিক্ষা

আধুনিক যুগে পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি নবীজির (সা.) জীবন ও হাদিস নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়—এসব সবুজ ভাবনার গভীরতর ভিত্তি ইসলামের মধ্যেই বহু আগে থেকে বিদ্যমান।

নবীজির (সা.) পরিবেশ-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি দুনিয়ার উপকারিতা ছাড়াও পরকালের সওয়াবের সঙ্গে এ বিষয়টি জুড়ে দিয়েছেন। নিচে মহানবীর (সা.) এমন কিছু হাদিস তুলে ধরা হলো, যেগুলো চৌদ্দশো বছর আগের হলেও আজকের দিনেও একইরকম প্রাসঙ্গিক:

শেষ মুহূর্তে হলেও গাছ লাগাও

হজরত আনাস (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন ‘কিয়ামত কায়েম হওয়ার মুহূর্ত এসে পড়লেও যদি তোমার হাতে একটি খেজুর গাছের চারা থাকে, তবে তা রোপণ করে দাও।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ১২,৪৯১)

এই হাদিসটি আমাদের শেখায়, জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্তও একজন মুসলমানের দায়িত্ব রয়ে যায় পরিবেশের জন্য অবদান রাখার। গাছ লাগানোর মতো একটি ক্ষুদ্র কর্মও চিরস্থায়ী সওয়াব বয়ে আনতে পারে।

গাছ লাগানো সদকা

হজরত আনাস (রা.) কাছ থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি গাছ লাগায় বা কোনো ফসল বপন করে এবং তা থেকে যদি কোনো পাখি, মানুষ বা জন্তু খায়, তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩২০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৫৫২)

অর্থাৎ, গাছ বা ফসল রোপণ করা শুধু পার্থিব উপকারেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সদকায়ে জারিয়া (অব্যাহত দান)-এর মর্যাদা পায়। মানুষ, পাখি বা পশু—যে-কেউ উপকৃত হলে মুসলমান এর জন্য সওয়াব অর্জন করে।

ইবাদতেও অপচয় নয়

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, একদিন নবীজি (সা.) হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তখন অজু করছিলেন। নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত অপচয় কেন?’ সা’দ বললেন, ‘অজুতে কি অপচয় হয়?’ নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি যদি তুমি প্রবাহমান নদীর থেকেও অজু করো।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ৭,০৬৫)

এই হাদিস শিখায়, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সংযমী হওয়া জরুরি, এমনকি তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হলেও। যদিও অধিক পানি ব্যবহার করাকে অনেকে অপচয় বলে মনে না।

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ইমানদারের দায়িত্ব

হজরত মুআয (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সাধারণ) সতর্ক করে বলেছেন, ‘তিনটি কাজ থেকে সাবধান থেকো—যেগুলোর কারণে মানুষ অভিশপ্ত হয়: ১. এমন ছায়াযুক্ত স্থানে মলত্যাগ করা, যা মানুষ ব্যবহার করে, ২. চলাচলের পথের মধ্যে মলত্যাগ করা, ৩. পানি সংগ্রহের জায়গায় অশুচি করা।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২৬)

এই হাদিস স্পষ্টভাবে পরিবেশ ও জনসাধারণের উপযোগিতার স্থানসমূহ রক্ষা করার নির্দেশনা দেয়। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম শুধুই ব্যক্তি ইবাদতের শিক্ষা দেয় না, সামাজিক সচেতনতার দিকেও গুরুত্ব দেয়।

রাস্তা থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরানো

হজরত আবু যার গিফারী (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘রাস্তা থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে দেওয়াও এক প্রকার সদকা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,০০৯)

এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর হাদিসটি আমাদের শেখায়—পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষুদ্র কাজগুলোও আল্লাহর দরবারে সদকা হিসেবে গণ্য হয়।

প্রতিবেশীর খেয়াল রাখা

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘আসল মুমিন সে নয়, যে নিজে পরিপূর্ণ খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২০০১৭)

এই হাদিসটি আজকের ভোগবাদী সমাজে একটি অত্যন্ত মূল্যবান শিক্ষা। মুসলমানকে শুধু নিজের আরাম নয়, আশপাশের মানুষের অবস্থার প্রতিও সচেতন থাকতে হবে। একদিকে এই বার্তা খাদ্য অপচয় রোধে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে সমাজে মানবিক সহমর্মিতা গড়ে তোলে।

বস্তুর পুনর্ব্যবহার

নবীজি (সা.) ঘরে কী করতেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রিয় স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা.) বলেন: ‘তিনি নিজের জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং সাধারণ মানুষের মতো ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন।’ (আল-আদবুল মুফরাদ, হাদিস: ৫৩৮)

এই হাদিস আমাদের শেখায়, কোনো বস্তু একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার শিক্ষা নবীজির (সা.) নয়। গৃহস্থালি কাজে অবহেলা করতেন না এবং ছেঁড়া কাপড় বা জুতা সেলাই করে পরতেন, ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নষ্ট করতেন না।

অন্যায়ভাবে প্রাণী হত্যা না করা

নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া একটি চড়ুই পাখি বা তার চেয়েও বড় কোনো প্রাণী হত্যা করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জবাবদিহির জন্য ডাকবেন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, ন্যায়সংগত কারণ কী?’ তিনি বললেন, ‘যদি কেউ তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে জবাই করে, তাহলে ঠিক আছে; কিন্তু শুধু মাথা কেটে ফেলে দিলে, তা অন্যায়।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৪,৪৪৫)

এই হাদিস পরিবেশ-সচেতনতা ও প্রাণীর অধিকারের স্পষ্ট শিক্ষা দেয়। ইসলাম জীবন ও প্রাণের প্রতি অত্যন্ত সম্মান দেখায়—এমনকি একটি ছোট পাখির জীবনকেও।

পশুপাখির সেবাও পুণ্য

হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-র কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘এক ব্যক্তি একবার পথ চলতে গিয়ে তৃষ্ণায় কাতর হয়। সে একটি কূপ পেয়ে তাতে নেমে পানি পান করে। উঠে এসে সে দেখে, একটি কুকুর মাটি চেটে খাচ্ছে—তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছে। লোকটি ভাবল, ‘এই কুকুরটি তো আমার মতোই তৃষ্ণার্ত।’ সে আবার কূপে নেমে নিজের জুতা পানি দিয়ে ভরে মুখে করে তা তুলে এনে কুকুরকে পান করাল। আল্লাহ তার এই কাজকে পছন্দ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, পশুপাখিকে পানি পান করানোতেও কি সওয়াব আছে?’ তিনি বললেন: ‘প্রত্যেক প্রাণীকে সেবা করায় সওয়াব আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩৬৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৪৪)

প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘এক নারী জাহান্নামে প্রবেশ করেছে একটি বিড়ালের কারণে। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল, খাবার দেয়নি; আবার ছেড়ে দেয়নি যাতে সে মাটি থেকে পোকামাকড় খেতে পারে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩৬৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৪২)

নিষ্ঠুরতা যেকোনো জীবের প্রতিই হোক না কেন, তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত। ইসলাম শুধু উপকার নয়, অনিষ্ট থেকে বিরত থাকার নির্দেশও দেয়।

এই দশটি হাদিস চৌদ্দশো বছর আগের হলেও আজকের পরিবেশ সংকট ও সামাজিক বৈষম্যের যুগে আশ্চর্যরকম প্রাসঙ্গিক। গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পানি অপচয় রোধ, প্রাণী সেবার গুরুত্ব ও সামাজিক সহমর্মিতা—সবকিছুতেই নবীজি (সা.) আমাদের সামনে রেখে গেছেন এক অনন্য সবুজ দর্শন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি ইসলামের এই চেতনা অনুসরণ করলেই গড়ে উঠতে পারে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দায়িত্বশীল ও কল্যাণময় সমাজ।