
খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তরপর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…
আজকের তারকা: জোবেরা রহমান লিনু
টেবিল টেনিসে ১৬ বার বাংলাদেশের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সেটারই স্বীকৃতি মিলেছে গিনেস বুকে নাম তুলে। জোবেরা রহমান লিনু শুধু জয় করেননি, এগিয়েছেন নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে। এই সাক্ষাৎকারে খেলা ছাপিয়ে ধরা দিয়েছে এক নারীর অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ আর এগিয়ে চলার কাহিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
আপনি সম্প্রতি ‘জীবন জালের এপার-ওপার’ নামে আত্মজীবনী লিখেছেন। নামকরণের পেছনে কোনো বিশেষ গল্প আছে?
জোবেরা রহমান লিনু: না, কোনো গল্প নেই। নামটা আমার ভেতর থেকেই এসেছে। আমার জীবনের সঙ্গে খুব ভালোভাবে যায় বলেই এমন নাম দিয়েছি। ‘জাল’ মানে তো নেট, যেটার এক পাশে দাঁড়িয়ে আমি টেবিল টেনিস খেলেছি। আবার এই জালের ওপারে হয়তো পরকাল। যে যার মতো ভাবতে পারে।
আত্মজীবনী লেখার প্রেরণা কীভাবে এল?
লিনু: এর পেছনে এক দীর্ঘ গল্প আছে। ২০০২ সালে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর আমি ভীষণ হতাশায় ছিলাম। চোখের সামনে অন্যরা চ্যাম্পিয়ন হচ্ছিল, পুরস্কার নিচ্ছিল। সবকিছু সহ্য করা কঠিন ছিল। তখনই ভাবি, আমার জীবনে যা ঘটেছে, তার কিছু লিখে রাখি। যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম জানতে পারে। তখনই শুরু করি লেখা। কিন্তু শেষ করতে লেগেছে ২১ বছর।
কোন অধ্যায়টি লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন?
লিনু: আমি যখন টিনএজার। বয়স ১৬ বা ১৭ হবে, তখন একবার আত্মহত্যার চিন্তা করেছিলাম। সেই অধ্যায়টা লেখার সময় ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। আমার তৃতীয় বোনকে একদিন বলি, আমি আত্মহত্যা করব। সে খুব সহজ-সরল, বলে, কবে করবি? আমি বলি, কালকে। তখন আমরা তখন কলোনিতে থাকতাম। একদিন ভবনের ছাদে উঠে নিচে তাকিয়ে ভয় লাগল। পরে বুঝলাম, জীবনে বেঁচে থাকাই আসল শক্তি। আমি টিকে ছিলাম, ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম।
আপনি তো এখনো একা। বিয়ে করেননি। কোনো কারণ আছে?
লিনু: অবশ্যই আছে। আমার একমাত্র ভাইয়ের ছেলের জন্যই শেষ পর্যন্ত আর বিয়ে করিনি। ওর বয়স তখন চার (এখন ১৯, নাম ইয়াদ আলাভি), আমি ওকে মানুষ করেছি। ও আমাকে ‘মা’ ডাকে। একবার আমাদের বিল্ডিংয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান, ও প্রশ্ন করল, ‘এত আলো কেন?’ বললাম, ‘বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে হলে মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়।’ তখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ তখনই মনে হলো, আমি বিয়ে করলে হয়তো ও বাঁচবে না। সিদ্ধান্ত নিই, আমার ছেলেকে নিয়েই থাকব।
এ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন মনে হয়নি তখন?
লিনু: ছেলের জন্যই আসলে আমি আর বিয়ের কথা ভাবিনি। আমি বিয়ে করিনি; কারণ, আমি তখন থেকেই একজন মা। মা হয়ে উঠতে হয়তো বিয়ে লাগে না। বিয়ে নয়, আমি একজন শিশুর পৃথিবী হয়ে উঠেছিলাম। আসলে এক শিশুর একটুখানি কথা বদলে দিয়েছিল আমার জীবন।
আপনার জীবনে কি কখনো প্রেম ছিল?
লিনু: টিনএজ বয়সে কাউকে ভালো লাগেনি বললে সেটা মিথ্যা হবে। প্রেমের গভীরতা, ভালোবাসা—এসব অনুভব করেছি। তবে তা সম্পর্কের পরিণতি পর্যন্ত গড়ায়নি। আমি একজন রোমান্টিক মানুষ। এটা নিশ্বাসের মতো আছে, ছিল।
প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে কাউকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?
লিনু: তখন চিঠির যুগ ছিল। প্রচুর চিঠি পেতাম। প্রেমের প্রস্তাব আসত। চট্টগ্রামের এক ছেলে তার ঘরজুড়ে আমার পোস্টার লাগিয়ে রেখেছিল। একদিন এসে হাজির বাসায়। বুঝিয়ে ফেরত পাঠালাম। সে একসময় ড্রিংক করতে শুরু করে। রাস্তায় পড়ে থাকে। ওর বন্ধু আমার বাসায় ফোন দেয়, আমি নাকি এর জন্য দায়ী! আমি বললাম, আমি তো তাকে পছন্দ করি না। একজন ব্যবসায়ী, প্রতিদিন খেলা দেখতে আসতেন আমার। পরে প্রস্তাবও দেন। আমি সেটা গ্রহণ করিনি। এখন তিনি দেশের নামকরা শিল্পপতি। অনেকে বলে আমি অহংকারী, মুডি। আসলে তা নয়। আমি নিজেকে বরাবরই গুটিয়ে রেখেছি।
গুঞ্জন ছিল, ক্রীড়াঙ্গনের একজনের সঙ্গে আপনার হয়তো বিয়ে হতে পারত...
লিনু: না না, এসব রটনা। ওনাকে হয়তো কেউ বলেছিল হয়তো, ‘আপনিও সিঙ্গেল, উনিও।’ পরে সামনে এলে দুজনই বিব্রত হতাম। ওনার সঙ্গে আমার সেই ধরনের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
আত্মজীবনীতে এমন কোনো সত্য বলার সাহস পেয়েছেন, যা আগে বলেননি?
লিনু: আত্মহত্যার চেষ্টা নিয়ে লেখা, এটা তো সবাই বলে না। আমি লিখেছি।
কিন্তু আত্মহত্যার চিন্তা কেন এসেছিল?
লিনু: এটা বলব না। একান্তই ব্যক্তিগত।
বইটি কেমন সাড়া পেয়েছে?
লিনু: অনেক ভালো। প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে গত বইমেলায়। প্রথম সংস্করণ শেষ, দ্বিতীয় সংস্করণ এসেছে। পাঠকের প্রশংসা পেয়েছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে সিনিয়র সাংবাদিক কামরুজ্জামান ভাইয়ের একটা কথা। উনি নাকি বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ কারেন ভাইকে বলেছেন, ‘লিনুর বইটা পড়ুন। এটা পুরস্কার পেতে পারে।’ তাঁর এমন কথা আমার জন্য বড় পুরস্কার।
আপনি খেলোয়াড়, সংগঠক, লেখক। কোন পরিচয়টি সবচেয়ে ভালো লাগে?
লিনু: অবশ্যই খেলোয়াড় লিনু। আপনারা আমায় বলতেন ‘টেবিল টেনিস কুইন’। এটাই আমার প্রিয় পরিচয়। তারপর লেখক পরিচয়। আমি নাটক, কবিতা, উপন্যাস—সবই লিখেছি। টিভিতে চারটি নাটক প্রচারিত হয়েছে, নিজেই প্রযোজনা করেছি।
অভিনয় করলেন না কেন?
লিনু: অভিনয়ের আগ্রহ ছিল না কখনো। পর্দার পেছনেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
একা জীবন থেকে কী শিখলেন?
লিনু: নিঃসঙ্গ থাকলেও আমি একা নই। আমি ভ্রমণ পছন্দ করি। ঘুরে ঘুরেই নিঃসঙ্গতা ভুলেছি। ইউরোপের প্রায় ২০টি দেশে গেছি, বেশির ভাগ সময় একা। আমি জানি, কীভাবে নিজেকে প্রটেক্ট করতে হয়। কাকে বলব, কে যাবে সঙ্গে! ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...।’ এই ৬০ বছর বয়সেও আমি একা ঘুরি।
কতগুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন?
লিনু: একাধিক দেশে সাত-আটবারও গেছি। মোট মিলিয়ে হবে ৬০টির মতো।
কোথায় ঘুরতে সবচেয়ে ভালো লেগেছে?
লিনু: ইউরোপ। বাস্তায় যখন গিটার বাজায়, গান গায়, আমি দাঁড়িয়ে শুনি। জীবনে নানা সংস্কৃতির স্বাদ পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে বেশি ঘোরা হয়নি।
কেন?
লিনু: বাংলাদেশে একা ঘুরতে নিরাপদ বোধ করি না। বন্ধুবান্ধবও তেমন নেই, যোগাযোগ সীমিত।
সর্বশেষ কোথায় গিয়েছিলেন?
লিনু: ভুটান। এটা আমার পঞ্চম সফর সেখানে। এর আগে গিয়েছি গ্রিস, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে...।
এখন সময় কীভাবে কাটে?
লিনু: ছেলেকে সময় দিই। এখনো তাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিই। অনেকে ভাবতে পারেন, সে হয়তো স্বাবলম্বী নয়। কিন্তু সে খুবই স্বাবলম্বী। এখনকার শিশুরা মায়ের আদর পায় না। আমি চাই, আমার সন্তান যেন তা পায়। মায়ের গন্ধ, মায়ের স্পর্শ, সে যেন তা মনে রাখে।
প্রিয় বই?
লিনু: আমি বই লিখি, পড়ি খুব কম। ‘ন হন্যতে’ খুব ভালো লাগত। হুমায়ূন আহমেদের কিছু বই পড়েছি। সবচেয়ে পছন্দ রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। ‘শেষের কবিতা’য় অমিত-লাবণ্য যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল, সেই জায়গায় গিয়েছি। শিলংয়ের সেই বাড়িতে গেছি, যেখানে বসে কবিগুরু গল্পটি লিখেছিলেন।
প্রিয় সিনেমা?
লিনু: ‘সানফ্লাওয়ার’ ভালো লেগেছে। রোমান্টিক গল্প খুব পছন্দ।
প্রিয় গান?
লিনু: পুরোনো দিনের বাংলা গান খুব প্রিয়। মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়দের গান শুনেছি। তবে এখন আগের মতো গান শুনি না, একটু দূরে সরে গেছি সেই সাংস্কৃতিক ধারা থেকে।
ফ্যাশন বা স্টাইল নিয়ে খুব ভাবতেন?
লিনু: একদম না। তরুণ বয়সেই রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আমার মনে দাগ কেটে যায়, ‘ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী!’ আমি কখনো ফ্যাশন করিনি। নিজস্ব স্টাইল খুঁজে নিয়েছি। এখন হিজাব পরি, সেটার মধ্যেও স্টাইল থাকে। আমি যা পরতে ভালোবাসি, সেটাই পরি।
প্রিয় খাবার?
লিনু: আগে রিচ ফুড, কোল্ড ড্রিংকস খুব পছন্দ করতাম। এখন সেগুলো বাদ দিয়েছি। ঘরোয়া বাঙালি খাবার খাই। একসময় কই মাছ, শিং মাছ খুব প্রিয় ছিল। এখন তো সেগুলো পাওয়া যায় না।
রান্না করেন?
লিনু: রান্না আমার খুব প্রিয় নয়। তবে ছেলের জন্য মাঝেমধ্যে পাস্তা-টাস্তা করি।
প্রিয় ফল?
লিনু: আম, শরিফা, সফেদা। একসময় আম খেতে গিয়ে পেটে ব্যথা হতো। এখন কম খাই। ফ্রুট ড্রিংকস, জুস, পিৎজা...এসব এখন আর তেমন খাই না।
প্রিয় পোশাক, প্রিয় রং?
লিনু: কালো, ফিরোজা। এখন শার্ট-প্যান্ট পরা হয় না। স্টাইলিশ পোশাক পরি, তবে নিজের ছাপ রেখে। সালোয়ার-কামিজ পরা হয় না।
সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি?
লিনু: গিনেস বুকে নাম ওঠার পর সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার মুহূর্তটা।
জীবনে সবচেয়ে বেশি কাকে মিস করেন?
লিনু: বাবা। তিনি বলতেন, ‘যা দেখবা, লিখে রাখবা। ছবি তুললে লেখো, কোথায়, কবে।’ আর বলতেন, ‘ভ্রমণ করো, শেখো।’ সেই শিক্ষা আজও কাজে লাগছে।
ফিরে যেতে চাইলে কোন বয়সে ফিরে যেতেন?
লিনু: ২৪ বছর বয়সে।
বিশেষ কোনো কারণ?
লিনু: আছে। তবে সেটা আমার ভেতরেই থাক।
জীবনের কোনো অনুশোচনা?
লিনু: আছে। বড় ভুলও আছে, তবে সেটা একান্ত ব্যক্তিগত।
কোনো অপূর্ণ স্বপ্ন?
লিনু: ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ী হব। সেই সুযোগ বা প্ল্যাটফর্মটা পাইনি।
আবার জন্মালে?
লিনু: খেলোয়াড়ই হতাম। বিখ্যাত কোনো খেলোয়াড়।
আপনার আইডল কে?
লিনু: ছোটবেলা থেকে আমার বাবা (প্রকৌশলী)। খেলোয়াড়দের মধ্যে ভালো লাগত স্টেফি গ্রাফ আর আন্দ্রে আগাসিকে। তারা তো পরে সংসারও করেছে।
আপনার বোন মনিরা মোর্শেদ হেলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী টিটি চ্যাম্পিয়ন। আপনার জীবনে বোনের প্রভাব কতটা?
লিনু: অনেক। তাঁর খেলা দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমরা ডাবলস খেলেছি ন্যাশনালে। ১৯৭৭ পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। তারপর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি সরে যান।
ছোটবেলার কোনো স্মৃতি?
লিনু: তখন বয়স ৮-৯। সিলেট শাহজীবাজারে থাকি বাবার চাকরির সুবাদে। বাড়ির সামনে পাহাড় ছিল, লাল পাহাড়। কেউ একজন বলল, লাফ দিতে পারিস? আমি ভাবিনি কিছু, তিনতলা সমান উঁচু পাহাড় থেকে লাফ দিই। মাঝখানে কাদায় পড়ে বেঁচে যাই। মৃত্যুর খুব কাছে গিয়ে ফিরে আসা কয়েকটি মুহূর্ত আছে জীবনে।
শত শত ট্রফির মধ্যে প্রিয় কোনটি?
লিনু: ১৯৭৭ সালের প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। আর ২০০১ সালের জাতীয় ট্রফিটা নিইনি। এত খারাপ ছিল যে ফেরত দিয়ে দিয়েছি। কেউই সেবার ট্রফি নেয়নি।
এমন কোনো ঘটনা আছে, যা মনে পড়লে হাসি পায় আজও?
লিনু: ১৯৭৯ সালে কুমিল্লায় জাতীয় সাইক্লিংয়ে ফিনিশিং লাইনে যে আমাকে ধরার কথা ছিল, সে এমনভাবে ধরেছিল যে সরাসরি খালে পড়ে গিয়েছিলাম! সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়লে হাসি পায়।
সব মিলিয়ে লিনুর জীবনটা কেমন?
লিনু: আমি ঘরোয়া মানুষ। বোনের বাচ্চারা আমাকে ‘মনি’ বলে ডাকে। ওরা বলে আমাকে দেখলে নাকি মনে হয় না আমি একটা গিনেস রেকর্ডের মালিক। আসলে আমি সাধারণ একটা মানুষ হিসেবেই বাঁচতে চেয়েছি এবং সেভাবেই কাটছে আমার জীবন। এই তো মাত্রই হজ করলাম।