
নিউইয়র্কে জন্ম। গুগলে চাকরি করেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে। হৃদয়ে তাঁর বাংলাদেশ। ছোটবেলায় খেলাধুলা করেননি। অথচ আজ বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ২৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক বক্সিংয়ে নাম লেখান। মাত্র চার বছরে সাতটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছেন পাঁচটি পদক, যার তিনটি সোনা। সেই জিনাত ফেরদৌস এই প্রথম খেলছেন বাংলাদেশের ঘরোয়া বক্সিংয়ে। আজ নামবেন পল্টনে মোহাম্মদ আলী বক্সিং রিংয়ে। গতকাল সন্ধ্যায় সেখানে বসেই প্রথম আলোর মুখোমুখি হলেন—
ছোটবেলায় কোথায় কীভাবে বেড়ে উঠেছেন?
জিনাত ফেরদৌস: বাবা বেলায়েত হোসেন আর মা শাহনাজ ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ১৯৮৭ সালে। আমার জন্ম নিউইয়র্কে ১৯৯৪ সালে। বাবার বাড়ি ঢাকার আজিমপুরে, মা পাবনার। ছোটবেলায় খেলাধুলা করিনি। ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বাবা-মা খেলতে দিতেন না। বড় হয়েছি বই নিয়ে, খেলাধুলা নয়।
বক্সিংয়ে এলেন কীভাবে?
জিনাত: আমার স্বামীও নিউইয়র্কেই জন্মেছেন, মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভূত। তিনি বক্সিং পছন্দ করেন। আমি তখন ২১ বছরের, একদিন উনি আমাকে জিমে নিয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে খেলাটার প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে একটা ফাইট দেখে মনটা ছুঁয়ে গেল। সেদিনই ঠিক করি, আমিও বক্সার হব।
শুরুটা কখন?
জিনাত: ২০২১ সালে আমার প্রথম আন্তর্জাতিক ফাইট। বয়স হয়ে গেছে ২৭। অনেকে তখন ক্যারিয়ারের শেষের দিকে থাকে, আমি শুরু করলাম।
তারপর?
জিনাত: এখন পর্যন্ত সাতটি আন্তর্জাতিক মিটে খেলে পাঁচটি পদক জিতেছি। তিনটি সোনা। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যান্ডেলা কাপে, পর্তুগালে, পোল্যান্ডে পদক জিতেছি।
কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে প্রথম খেলার অভিজ্ঞতা তো ভালো হয়নি আপনার। ২০২৩ সালে হাংজু এশিয়ান গেমসে প্রথম রাউন্ডে বাই পাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে মঙ্গোলিয়ান বক্সার ইয়ুসগেনের কাছে ৫-০ পয়েন্টে হেরে গেমস থেকে বিদায় নিয়েছেন।
জিনাত: আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তখন মাত্র দুই বছরের অভিজ্ঞতা। প্রতিপক্ষ খুব ভালো ছিল। সব মিলিয়ে হয়নি। তবে পরের বার হবে আশা করি।
পরের এশিয়ান গেমসে তাহলে বাংলাদেশ আপনার কাছে পদক পেতে পারে? জানেন নিশ্চয়ই, বক্সিং বাংলাদেশের একমাত্র খেলা, যেখানে এশিয়ান গেমসে একটা ব্যক্তিগত পদক এসেছে ১৯৮৬ সালে। আপনি কি মনে করেন, দ্বিতীয় জন হবেন?
জিনাত: এটাই আমার লক্ষ্য। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যক্তিগত পদকটা আমার হাত ধরে আসতে পারে। ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকও আছে। তার আগে আছে কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস, এসএ গেমস। যেখানেই যাব, লক্ষ্য থাকবে পদক জেতা।
আপনার বয়স এখন ৩১ বছর। ২৭ বছর বয়সে খেলা শুরু করেছেন। দেরি হয়ে গেল না?
জিনাত: দেরি তো অবশ্যই। এখন আমি ৩১। তরুণ বলার সুযোগ নেই। তবে আমি কঠিন পরিশ্রম করি। আমার ডিফেন্স ভালো। বয়স যতই হোক, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।
আপনি বাংলাদেশকে কেন বেছে নিলেন?
জিনাত: যুক্তরাষ্ট্রে বক্সার অনেক। আমি সেখানে শুধুই একজন অ্যাথলেট। কিন্তু বাংলাদেশে আমি বিশেষ। আমি চাই আমার কাজের প্রভাব থাকুক বাংলাদেশে। এখানেই আমি বদল আনতে পারি। এই কারণে আমি বাংলাদেশকে প্রাধান্য দিই।
বাংলাদেশে বক্সিং রিংয়ে এই প্রথম নামতে চলেছেন। এখানকার রিং, অবকাঠামোসহ সবকিছু দেখে কেমন লাগছে?
জিনাত: ভালো লাগছে। তবে উন্নতির অনেক জায়গা আছে। কাঠামোগত উন্নয়ন দরকার।
এই ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় আপনি সহজেই চ্যাম্পিয়ন হবেন জেনেও খেলছেন কেন?
জিনাত: আমি চাই সবাই আমাকে দেখুক, জানুক। তরুণ বক্সাররা অনুপ্রাণিত হোক। তাই এসেছি। এটি বাংলাদেশে আমার অষ্টমবার আসা। এই যে বাংলাদেশি অ্যাথলেট হয়ে ওঠা, এর পেছনে অনেক আবেগ আছে।
বাংলাদেশের বক্সিংয়ের উন্নয়নে আপনাকে ভবিষ্যতে দেখা যাবে?
জিনাত: অবশ্যই। এটাই আমার বড় লক্ষ্য। যদি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারি, সেটাই আমার আনন্দ।
বক্সিং খেলা কতটা কঠিন?
জিনাত: খুব কঠিন। শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও। প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে তৈরি রাখতে হয়। শুধু শক্তি নয়; কৌশল, ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস—সবকিছু লাগে।
পছন্দের খেলা শুধু বক্সিং?
জিনাত: একদম। আমি শুধু বক্সিং করি। কেউ ২৭-এ শুরু করে না, কোনো খেলায়ই না। কিন্তু বক্সিংই আমার সব। এটা আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
ছোটবেলায় স্বপ্ন কী ছিল?
জিনাত: বক্সার হওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। হয়তো চিকিৎসক হতাম। কিন্তু বক্সিং আমার জীবনে এমনভাবে এল, যেন এটা এক স্বপ্নের যাত্রা।
বাংলা চর্চা করেন?
জিনাত: বাংলা বলতে পারি, তবে পড়তে পারি না (হাসি)।