
ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে জন্ম, স্থায়ী ঠিকানাও সেখানেই। কিন্তু হৃদয়ে বাংলাদেশ। জীবনসঙ্গিনী পাকিস্তানি। সকাল শুরু হয় অ্যাথলেটিকস অনুশীলনে, শেষ হয় দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্নে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, অনুশীলন—সব সামলে দেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান ছুটে চলেছেন নিজের গতিতে। ইমরানুরের সঙ্গে কথা বলেছেন মাসুদ আলম।
আপনার দৈনন্দিন রুটিনটা কেমন—সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত?
ইমরানুর: বেশির ভাগ দিন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। কখনো মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিই। তারপর অনুশীলনে যাই, সেখান থেকে কাজে। মাঝেমধ্যে কাজের ফাঁকে স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে আসি। বাড়িতে এসে দুই বাচ্চার দেখাশোনা করি। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত জিমে সময় দিই।
আপনি ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে একটি প্রতিষ্ঠানে স্টোরকিপার হিসেবে কাজ করছেন। পেশাগত জীবন কেমন?
ইমরানুর: ভালোই চলছে। কয়েক বছর ধরে এই কাজ করছি। প্রতিদিন ছয় থেকে আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে ছুটি নিতে হয়।
গত মৌসুমে ফুটবলার হামজা চৌধুরী শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছেন। দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে?
ইমরানুর: হ্যাঁ, কয়েকবার কথা হয়েছে। নিজেদের খেলার দায়িত্ব, মনোভাব আর বাংলাদেশকে কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়—এসব নিয়েই আলাপ হয়েছিল।
আপনার স্ত্রী পাকিস্তানি। নিশ্চয়ই এর পেছনে একটা গল্প আছে! কবে, কীভাবে পরিচয়?
ইমরানুর: আমাদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজনই বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম—ও নার্সিংয়ে, আমি স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজে। সময়টা ২০১৫–১৬ সালের দিকের। এক বন্ধুর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়। ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসি, বুঝে ফেলি আমরা একে অন্যকে চাই। তারপর পরিবারকে জানাই।
প্রেমের প্রস্তাব প্রথম কে দিয়েছিলেন?
ইমরানুর: (হাসি) বলা যায়, দুজনেই একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিই। পরিবারও রাজি ছিল। পড়াশোনা শেষ করে ২০১৮ সালে পরিবারের আশীর্বাদে বিয়ে করি।
আপনার স্ত্রী হাফসা মাজহার পাকিস্তানের কোন শহরের?
ইমরানুর: আমার মতো সেও ইংল্যান্ডে জন্মেছে। ওর মা–বাবা অনেক বছর ধরে এখানে আছেন। তাঁদের আদি বাড়ি রাওয়ালপিন্ডিতে, ইসলামাবাদের কাছে।
কখনো রাওয়ালপিন্ডি গেছেন?
ইমরানুর: না, এখনো যাওয়া হয়নি। শ্বশুর-শাশুড়ির পরিবার ইংল্যান্ডেই থাকে, শেফিল্ড থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে। তবে আশা করছি, জানুয়ারির শেষে ইসলামাবাদে দক্ষিণ এশীয় গেমস হলে সেখানে যাব। তখন রাওয়ালপিন্ডিও ঘুরে দেখা হবে। শ্বশুরের আদি বাড়ি দেখতে মুখিয়ে আছি।
আপনার অ্যাথলেটিকস ক্যারিয়ারে স্ত্রী কতটা সহায়তা করেন?
ইমরানুর: অনেক। সংসার, বাচ্চা—সব সামলে নেয়। আমি যখন প্রতিযোগিতায় থাকি বা অনুশীলনে ব্যস্ত থাকি, তখন ও-ই সব দেখে। ওর সমর্থন না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।
স্ত্রী এখন কী করছেন?
ইমরানুর: সন্তান জন্মের পর কিছুদিন কাজ থেকে বিরতি নিয়েছিল। এখন আবার কাজে ফিরেছে—নার্সিং ও ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যাসেসর হিসেবে কাজ করছে।
পাকিস্তানের ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে আপনার একটা ছবি দেখেছি। তাঁর সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল?
ইমরানুর: কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যে একটি দাতব্য অনুষ্ঠানে। সংক্ষিপ্ত আলাপ হয়েছিল। আমার স্ত্রী পাকিস্তানি জেনে আফ্রিদি হেসে বলেছিলেন, ‘বাহ, দারুণ।’
শেফিল্ডের জীবন কেমন কাটছে?
ইমরানুর: পরিবার নিয়ে ভালোই আছি। তবে অ্যাথলেটিকস ক্যারিয়ারটা কঠিন। বাংলাদেশ থেকে যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা পাই না। ট্রেনিং, কোচিং, ইনজুরি—সব মিলিয়ে ব্যয় অনেক। ২০২৩ সালে এশিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলাম, কিন্তু তেমন সহায়তা পাইনি। যদিও তারা বলেছিল তারা সাহায্য করবে।
দেখুন, দুজন মেডেলজয়ী মাহফুজ আর জহির সহায়তার অভাবে অবসর নিয়েছেন। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে যাচ্ছে, তারা কি এটা দেখতে পারছে না? খেলোয়াড়দের সম্মান দিন, তাঁদের পণ্যের মতো ব্যবহার করবেন না। যদি তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব না নেন, হয়তো আমি আমার ভবিষ্যৎ ভাবব।ইমরানুর রহমান, অ্যাথলেট
এটা নিয়ে মন খারাপ হয়?
ইমরানুর: এটা সত্যিই মন খারাপ করার মতো, আমি আমার খেলাধুলার অধিকাংশ ব্যয় নিজে বহন করছি। তাদেরও কিছু দায়িত্ব এবং দায়িত্ববোধ থাকা উচিত। দেখুন, দুজন মেডেলজয়ী মাহফুজ আর জহির সহায়তার অভাবে অবসর নিয়েছেন। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এগিয়ে যাচ্ছে, তারা কি এটা দেখতে পারছে না? খেলোয়াড়দের সম্মান দিন, তাঁদের পণ্যের মতো ব্যবহার করবেন না। যদি তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব না নেন, হয়তো আমি আমার ভবিষ্যৎ ভাবব। আমার বক্তব্য স্পষ্ট। সত্য বলুন, যাতে আমরা জানি আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছি। মিথ্যা আশা নয়। সবকিছু স্পষ্ট এবং পরিষ্কার হোক। আমি ফেডারেশনকে প্রতিনিধিত্ব করি না। আমি আমাদের মানুষ এবং বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করি।
আপনার পরিবার কীভাবে ইংল্যান্ডে স্থায়ী হলো?
ইমরানুর: আমার দাদা গাউসুর রহমান প্রথম আসেন ১৯৭০-এর দশকে। পরে দাদি ও বাবা আসেন। বাবা আলাউর রহমান বিয়ের পর মাকে এখানে নিয়ে আসেন ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে। আমি ১৯৯৩ সালে শেফিল্ডে জন্মেছি। দুই ছোট বোনও এখানেই জন্মেছে।
শুনেছি আপনার পরিবারের রেস্তোরাঁ ব্যবসা আছে?
ইমরানুর: হ্যাঁ, আগে বাবা নিয়মিত যেতেন। এখন মাঝেমধ্যে যান।
১৪ বছর বয়স থেকে করেছি। কঠিন সময়, শ্রমসাধ্য কাজ...সবই দেখেছি। এমনকি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত, যখন দুটি চাকরি করতাম, আর পুরো সময় ব্যবসা চালাতাম। সাকিব আল হাসান বা হামজা চৌধুরীরা যদি এ ধরনের দায়িত্ব পেতেন, তাঁরা তা করতে পারতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু আমি যেখানে এসেছি, এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।ইমরানুর রহমান, অ্যাথলেট
আপনি কখনো বাবার রেস্তোরাঁ ব্যবসায় সহায়তা করেছেন?
ইমরানুর: ১৪ বছর বয়স থেকে করেছি। কঠিন সময়, শ্রমসাধ্য কাজ...সবই দেখেছি। এমনকি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত, যখন দুটি চাকরি করতাম, আর পুরো সময় ব্যবসা চালাতাম। সাকিব আল হাসান বা হামজা চৌধুরীরা যদি এ ধরনের দায়িত্ব পেতেন, তাঁরা তা করতে পারতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু আমি যেখানে এসেছি, এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।
তাহলে তো কিশোর বয়সের আনন্দটা সেভাবে পাননি...
ইমরানুর: পেয়েছি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলে আনন্দ পেতাম। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং এবং আরও নানা ধরনের খেলা খেলেছি। পরিবারের সঙ্গে ঘুরতাম এবং মজার সময় কাটাতাম
অবসর সময় কীভাবে কাটান?
ইমরানুর: আসলে অবসর বলতে কিছুই নেই। অনুশীলন, কাজ, জিম, বাচ্চাদের দেখা—সপ্তাহজুড়ে ব্যস্ততা। নিজের জন্য আলাদা সময় পাওয়া দায়।
অ্যাথলেটিকস ছাড়া প্রিয় খেলা?
ইমরানুর: ফুটবল। খুব ভালো লাগে।
প্রিয় ক্লাব?
ইমরানুর: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ক্লাবটার প্রেমে পড়েছি বলা যায়। ১০-১২ বছর ধরে খারাপ সময় যাচ্ছে, তবু আমি ওদের পাশেই আছি।
কখনো ওল্ড ট্রাফোর্ডে গেছেন?
ইমরানুর: হ্যাঁ, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও আয়াক্সের ম্যাচ দেখেছিলাম। আরও কিছু প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচও দেখেছি।
প্রিয় ক্রীড়াবিদ?
ইমরানুর: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ওর খেলায় নিবেদন আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ছোটবেলা থেকেই রোনালদোর ভক্ত।
ছোটবেলায় অ্যাথলেট হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ইমরানুর: নির্দিষ্ট করে না, খেলাধুলা ভালো লাগত সব সময়। এখন যা হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।
চান আপনার সন্তানরা অ্যাথলেট হোক?
ইমরানুর: সেটা ওদের ওপর নির্ভর করবে। আমি সাপোর্ট করব, জোর করব না। এখনো ওরা ছোট—মেয়ে পাঁচ বছরের, ছেলে এক বছরের। সময় এলে দেখা যাবে।
আপনি জন্মেছেন শেফিল্ডে, এখন ঢাকাতেও আসেন ঘন ঘন। কোন শহরটা বেশি পছন্দ?
ইমরানুর: দুই শহরই আলাদা। শেফিল্ড আমার জন্মভূমি, ঢাকায় এসেছি খেলাধুলার কারণে। দুই জায়গার সঙ্গেই আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
ঢাকার কোন দিকটা বেশি ভালো লাগে?
ইমরানুর: এখানকার মানুষের ভালোবাসা। অ্যাথলেটিকসের মানুষের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক হয়েছে। আর ঢাকার বিরিয়ানি—অসাধারণ! শুধু খেয়াল রাখি, যেন বেশি না খাই।
ভ্রমণপিপাসু মানুষ কি আপনি?
ইমরানুর: হ্যাঁ, দুবাই খুব ভালো লাগে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াও সুন্দর।
বাংলাদেশের কোন জায়গায় যেতে চান?
ইমরানুর: সিলেট—আমাদের আদি বাড়ি দক্ষিণ সুরমায়। তবে সাধারণত বাংলাদেশে অল্প সময়ের জন্যই আসি।
প্রিয় বাংলাদেশি খাবার?
ইমরানুর: বিরিয়ানি। ঝাল খাবারও পছন্দ করি। আমি সিলেটি—ঝাল তো রক্তেই আছে!
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কোনটা ছিল?
ইমরানুর: গত অলিম্পিকের সময় ইনজুরিতে পড়েছিলাম। খুব কঠিন সময়। প্রত্যাশিত সহায়তা পাইনি। তখন অবসর আর রাগ—দুটোই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখনো ক্ষোভ আছে, তবে নিজেকে সংযত রাখি।
জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন?
ইমরানুর: খুব সাম্প্রতিক—আমার দাদির মৃত্যু। তিনি আমার জীবনের বড় অংশ ছিলেন।
আর সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত?
ইমরানুর: আমার সন্তানদের জন্ম। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
প্রিয় সিনেমা?
ইমরানুর: অ্যাকশন মুভি ভালো লাগে। ‘স্কুইড গেমস’, মার্ভেলের মুভি দেখি। কখনো অ্যানিমেও দেখি, যেমন ‘ড্রাগন বল জেড’।
প্রিয় রং?
ইমরানুর: নীল।
প্রিয় খাবার?
ইমরানুর: ল্যাম্ব চপস—ছাগলের পাঁজরের মাংসের টুকরা, ভেজে বা গ্রিল করে খাওয়া হয়।
আদর্শ?
ইমরানুর: আমাদের নবী (সা.)। তাঁকে অনুসরণ করি।
ফোনে সবচেয়ে বেশি কোন অ্যাপ ব্যবহার করেন?
ইমরানুর: ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটক।
জিম না ট্র্যাক—কোনটা বেশি ভালোবাসেন?
ইমরানুর: ট্র্যাক।
অ্যাথলেট না হলে কী হতেন?
ইমরানুর: অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
এক লাইনে জীবনমন্ত্র?
ইমরানুর: ধৈর্য আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।
বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা আছে?
ইমরানুর: সব সময়ই একটা সম্ভাবনা থাকবে।
বাড়ি থেকে দূরে থাকলে কাকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
ইমরানুর: পরিবারকে। ওরাই আমার শক্তি।
ট্র্যাকে নামার আগে কী ভাবেন?
ইমরানুর: মনোযোগী থাকার চেষ্টা করি। যেন সেরাটা দিতে পারি।
স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়ালে কীভাবে মনোযোগ ধরে রাখেন?
ইমরানুর: সব ভাবনা সরিয়ে শুধু টেকনিকের ওপর মন দিই।
দৌড় শুরু করার আগে কোনো প্রার্থনা করেন?
ইমরানুর: হ্যাঁ, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সফলতার জন্য দোয়া করি।
স্টার্টারের গুলি ছুটলে কী অনুভব হয়?
ইমরানুর: কিছু না, শুধু সেই শব্দটাই শুনি।
পরবর্তী লক্ষ্য?
ইমরানুর: দক্ষিণ এশীয় গেমসে সোনা। সামনে আরও ভালো কিছু করতে চাই।
অবসরের পর পরিকল্পনা?
ইমরানুর: খেলা ছাড়লেও খেলাটার সঙ্গেই থাকতে চাই। বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসকে এগিয়ে নিতে চাই। আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে—এ জায়গাটা বদলাতে চাই।