
ভারতের মণিপুর রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে গত ৩০ আগস্ট একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আগামী ৭ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর’ পর্যন্ত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যকে ছুটি দেওয়া হবে না। কারণ, ওই সময়ে জরুরি প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে।
মণিপুরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য ওয়্যারকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য সফরের কারণেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য সফরসূচিতে রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল এবং দুই বছর আগের সহিংসতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার একটি চূড়াচাঁদপুরের নাম প্রস্তাব করা আছে।
গত ৩১ আগস্ট দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘সরকারি সূত্রের’ বরাতে বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মোদির মণিপুর সফরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদি মোদি এই সফরে যান, তবে ২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া জাতিগত দাঙ্গার দুই বছরের বেশি সময় পর এটি হবে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম মণিপুর সফর।
রাজ্যের একাধিক সূত্র দ্য ওয়্যারকে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে মণিপুরের দীর্ঘদিনের সহিংসতার অবসান এবং মণিপুরে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর একটি সরকার গঠনের পথ সুগম করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যদিও বাহ্যিক এ পরিস্থিতির আড়ালে রয়েছে অনেক বেশি জটিল এক বাস্তবতা। মণিপুরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো গভীর বিভেদ বিদ্যমান। হাজারো মানুষ এখনো ত্রাণশিবিরে বসবাস করছেন। সর্বোপরি সংকটময় সময়ে মোদি সরকারের দীর্ঘ নীরবতা দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছে।
মণিপুরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো গভীর বিভেদ বিদ্যমান। হাজারো মানুষ এখনো ত্রাণশিবিরে বসবাস করছেন।
মণিপুরে ৮৫০ দিনের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলেছে। সহিংসতায় ২৬০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ।
মোদির সম্ভাব্য এই সফরের ওপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নির্ভর করছে। তার একটি হলো—কুকি-জো গোষ্ঠীর সঙ্গে সাসপেনশন অব অপারেশনস (এসওও) কাঠামোর অধীনে নতুন চুক্তি এবং একজন নতুন মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ ও রাজ্য সরকার গঠন।
একটি এসওও চুক্তি কি সম্ভব
মণিপুরে কুকি সম্প্রদায়ের প্রধান দুই দল ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (ইউপিএফ) এবং কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএনও) দ্য ওয়্যারকে নিশ্চিত করে বলেছে, তারা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন। সেখানে ৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে ওই চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত হয়ে আছে।
সাসপেনশন অব অপারেশনস (এসওও) চুক্তি প্রথম স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২২ আগস্ট। ভারত সরকার, মণিপুর সরকার এবং কুকি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে ওই চুক্তি হয়। সেই থেকে প্রতিবছর চুক্তি নবায়ন হয়ে আসছিল।
এই চুক্তি অনুযায়ী, ‘বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে অবস্থান করতে হবে এবং অস্ত্রশস্ত্র তালাবদ্ধ করে রাখতে হবে।’
মণিপুরে ৮৫০ দিনের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলেছে। সহিংসতায় ২৬০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ।
একটি সূত্র দ্য ওয়্যারকে বলেছে, ২০২৩ সালের ৩ মে ইম্ফলে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল কেএনও ও ইউপিএফ। কিন্তু তার আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে মণিপুরে ভয়াবহ জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
জাতিগত সহিংসতার পর থেকে ইউপিএফ ও কেএনও বারবার কুকি-জো এলাকার জন্য ‘স্বতন্ত্র প্রশাসনের’জোর দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের যুক্তি, মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহাবস্থান আর সম্ভব নয়।
‘স্বতন্ত্র প্রশাসনের’ এই দাবি কুকি-জো সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু মেইতেই সম্প্রদায় দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করেছে। মণিপুরে মেইতেইরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং রাজ্যের সমতল জেলাগুলোতে তাঁরা বসবাস করেন। মেইতেইদের অভিযোগ, কুকি-জো গোষ্ঠী জাতিগত সহিংসতার সময় শান্তিচুক্তির নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য ওয়্যার বলেছে, মণিপুরকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবির প্রশ্নে ২০২৪ সালে নয়াদিল্লিতে তিন দফায় রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মধ্যস্থতাকারী এ কে মিশ্র ২০২৪ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে একটি খসড়া প্রস্তাবনা জমা দিয়েছেন।
ওয়্যারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়া মেলেনি।
রাজ্য বিজেপি ও রাজ্য কংগ্রেস, উভয় দল থেকে দ্য ওয়্যারকে বলা হয়েছে, যদি নয়াদিল্লি কুকি গোষ্ঠীর ‘স্বতন্ত্র প্রশাসনের’ দাবি মেনে নেয়, তবে মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হবে।
মণিপুরের বিধানসভা ৬০ সদস্যের। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ৪৪ আসন তাদের পক্ষে বলে দাবি করেছে। ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়।
নতুন সরকারব্যবস্থা কেমন হবে
যদিও কেন্দ্র সরকার আগস্ট মাসে মণিপুরে প্রেসিডেন্ট শাসনের (প্রেসিডেন্টস রুল) মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে। কিন্তু ইম্ফলে বিজেপি বিধায়কেরা কয়েক মাস ধরে দলটির জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ধাপে ধাপে বৈঠক করছেন। মণিপুরে নতুন সরকার গঠন করার জন্য চাপ দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য।
এখন মোদির সম্ভাব্য সফরের প্রেক্ষাপটে রাজ্যের বিজেপির মধ্যে নতুন সরকার গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।
মণিপুরের বিধানসভা ৬০ সদস্যের। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ৪৪ আসন তাদের পক্ষে বলে দাবি করেছে। ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মণিপুরে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করা হয়।
দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাড়তে থাকা সমালোচনার মুখে গত ৯ ফেব্রুয়ারি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এন বীরেন সিংহ।