
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ বন্ধে তাঁর প্রশাসনের ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণার দিনটিকে ‘মানবসভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম মহান দিন’ বলে অভিহিত করেছেন। গত সোমবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই খুব কাছাকাছি পৌঁছেছি।’
এ ধরনের অত্যধিক উৎসাহপূর্ণ ভাষা সবাই ট্রাম্পের কাছ থেকে আশা করেন, কিন্তু এটি বাস্তবসম্মত কি না, সেটিই মূল প্রশ্ন।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ইসরায়েল ২৫০ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে, সেই সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আটক ১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেবে। বিনিময়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ৪৮ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করবে। তাঁদের মধ্যে ২০ জন জীবিত আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর হামাসের সদস্যরা যদি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার ও তাঁদের অস্ত্র ত্যাগের’ প্রতিশ্রুতি দেন, তবে তাঁদের ক্ষমা করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইসরায়েল ধীরে ধীরে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং আরব দেশগুলোর নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) উপত্যকাটির নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে, ‘পিস বোর্ড’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে এক ফিলিস্তিনি কমিটি গাজার প্রশাসন পরিচালনা করবে; যতক্ষণ না পুনর্গঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা গ্রহণে প্রস্তুত হয়। প্রস্তাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃত হয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের ‘স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গ্রহণযোগ্য পথ’ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
নেতানিয়াহু পরিকল্পনাটি সমর্থন করছেন। তবে ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়নি। কারণ, তা কার্যকর করতে মন্ত্রিসভার সম্মতি প্রয়োজন। আবার পরিকল্পনাটি এখনো চূড়ান্ত নয়। কারণ, হামাসকে মতামত দেওয়ার ও প্রস্তাবে পরিবর্তন চাওয়ার জন্য কিছু সময় দেওয়া হবে।
হামাস (পরিকল্পনাকে) না বলবে—সম্ভবত এটিই নেতানিয়াহুর মূল পরিকল্পনা। ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রকাশের পর নেতানিয়াহু তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, হামাস সম্ভবত প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে না। এতে তিনি ট্রাম্পের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গাজার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন।
হামাস কি এ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু এখন হামাসের প্রতিক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। পরিকল্পনাটি নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দোহায় যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার প্রধান মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিসরের হামাসের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা ছিল। হামাসের মিত্র তুরস্কেরও আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা।
পরিকল্পনাটি হামাসের ইতিপূর্বে ঘোষণা করা ‘রেড লাইন’ (চূড়ান্ত সীমারেখা) অতিক্রম করে, যেমন তাদের অস্ত্র ত্যাগ করা ও ভবিষ্যতে গাজার শাসনে অংশগ্রহণ না করা। প্রস্তাব অনুযায়ী, হামাসের সব অবকাঠামো স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করা হবে এবং সেগুলো পুনর্নির্মাণ করা হবে না।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা হামাসকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান তামির হায়মান ও তেল আবিবের জাতীয় নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএনএসএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ওফের গুটারম্যান লিখেছেন, ‘হামাস সম্ভবত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করবে—এটা অনুমান করাই যুক্তিসংগত।’
হামাসের জন্য একটি বিশেষ শর্ত বড় সমস্যা তৈরি করেছে। পরিকল্পনার ১৭ ধারা অনুযায়ী, হামাস যদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তবু গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং ইসরায়েলি সেনাদের দখলকৃত এলাকা তাঁদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে হস্তান্তরের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে।
হায়মান ও গুটারম্যান লিখেছেন, ‘যদি হামাস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তবে গাজার হামাসনিয়ন্ত্রিত এলাকায় আইডিএফের সেনা মোতায়েন চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা ইসরায়েলের থাকবে এবং রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও নাগরিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াও এগিয়ে যাবে।’
বিশ্ব সম্প্রদায়, বিশেষ করে আরব ও মুসলিম দেশগুলো ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধে চাপ দিচ্ছে। তবে তারা এও স্পষ্টভাবে বলেছে, হামাসকে এখনই অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে।
এসব দাবি তাঁদের অভিপ্রায় থেকে কত দূরে, সেই কথা সিএনএনের সঙ্গে গত সপ্তাহে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঘাজি হামাদ। বলছিলেন, ‘হামাসের (সশস্ত্র) শাখা একটি বৈধ ও আইনি “অস্ত্র”, যা সব সময় দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়।’
হামাদ আরও বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, হামাসের অস্ত্র ফিলিস্তিনি সেনাবাহিনীর কাছে যাবে। কিন্তু ফিলিস্তিনি সমস্যা থেকে হামাসকে বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, হামাস ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।’
‘আমরা কখনো আত্মসমর্পণ করব না, কখনো না’, বলেন হামাদ।
যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, হামাসের অস্ত্র ফিলিস্তিনি সেনাবাহিনীর কাছে যাবে। কিন্তু ফিলিস্তিনি সমস্যা থেকে হামাসকে বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, হামাস ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। আমরা কখনো আত্মসমর্পণ করব না, কখনো নাঘাজি হামাদ, হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
নেতানিয়াহু কী করবেন
ট্রাম্পের প্রস্তাবের ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন রয়েছে। আটটি আরব ও মুসলিম দেশ যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, এটি ‘দ্বি–রাষ্ট্রীয়’ সমাধানের ভিত্তিতে ন্যায়সংগত শান্তির পথ তৈরি করে। পশ্চিম তীরের কিছু অংশ শাসনকারী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে।
নেতানিয়াহুর সামনে মূলত দুটি সম্ভাবনা রয়েছে—হামাস চুক্তি প্রত্যাখ্যান করবে কিংবা গ্রহণ করবে।
হামাস না বলবে—সম্ভবত এটিই নেতানিয়াহুর মূল পরিকল্পনা। ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রকাশের পর নেতানিয়াহু তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, হামাস সম্ভবত প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে না। এতে তিনি ট্রাম্পের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গাজার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন।
এ পথ নেতানিয়াহুর জন্য সহজ। কারণ এটি এরই মধ্যে চলমান যুদ্ধ ইসরায়েলকে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। তাঁর দলীয় মিত্ররাও তাঁকে সমর্থন দেবেন এবং ইসরায়েলে নেতানিয়াহু সরকার অটুট থাকবে।
হামাস হ্যাঁ বললে
হামাস পরিকল্পনা মেনে নিলে তা নেতানিয়াহুর জন্য পরিস্থিতিকে দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে জটিল করে তুলবে। কেননা, যুদ্ধ শেষ করা ও জিম্মিদের মুক্তি ইসরায়েলের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পাবে। কিন্তু নেতানিয়াহুর দল চরম দক্ষিণপন্থী মিত্রদের সমর্থন হারাতে পারে, যারা তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাব অনুমোদিত হলে তারা সরকারের অংশ হয়ে থাকতে নাও চাইতে পারে। নেতানিয়াহুর যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে বিরোধীদের সমর্থন আছে। অবশ্য, যুদ্ধ শেষ হলো তাঁর ভাগ্য তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদের হাতে চলে যেতে পারে।
নেতানিয়াহু চাইলে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধ শেষ করা ও আঞ্চলিক সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চেষ্টা চালাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য বড় হয়ে দাঁড়াবে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ। দেশের ভেতর এখন তাঁর সমর্থন খারাপ—জরিপে এটাই দেখা গেছে।
পরিকল্পনাটি হামাসের ইতিপূর্বে ঘোষণা করা ‘রেড লাইন’ (চূড়ান্ত সীমারেখা) অতিক্রম করে, যেমন তাদের অস্ত্র ত্যাগ করা ও ভবিষ্যতে গাজার শাসনে অংশগ্রহণ না করা। প্রস্তাব অনুযায়ী, হামাসের সব অবকাঠামো স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করা হবে এবং সেগুলো পুনর্নির্মাণ করা হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের ভূমিকা
ট্রাম্পের পরিকল্পনার সফলতা বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে। এ পরিকল্পনা সফল করতে প্রথমেই আরব দেশগুলোকে হামাসের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে; যেন তারা এটি গ্রহণ করে।
কিন্তু এটি কেবলই শুরু। তথাকথিত নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘পিস বোর্ডের’ তত্ত্বাবধানে একটি টেকনোক্র্যাট ফিলিস্তিনি কমিটি গাজার শাসন পরিচালনা করবে। বোর্ডের নেতৃত্বে থাকবেন ট্রাম্প, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানেরা।
আবার আরব দেশ ও অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারেরা অস্থায়ী বাহিনী আইএসএফ তৈরি করবে। এটি গাজার নিরাপত্তা দেখভাল করবে। এতে ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীও থাকবে। ট্রাম্পের প্রস্তাবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও গাজায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কথাও বলা হয়েছে; যা আলোর মুখ দেখতে লাগতে পারে কয়েক বছর।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনিরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কেউ যুদ্ধ শেষের আশা করছেন, কেউ পরিকল্পনার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
গাজার বাসিন্দা আত্তা আল জাজার বলেন, ‘মানুষ আশা ধরে রেখেছেন…হয়তো পরিকল্পনাটি সুযোগ দেবে, তবে আমরা ট্রাম্প বা নেতানিয়াহুকে বিশ্বাস করি না।’ তিনি বলেন, ‘আমি পরিকল্পনাকে সমর্থন করি না, কিন্তু বিকল্পকেও নয়। বিকল্প হলো, ফিলিস্তিনি জনগণের ধ্বংস ও উচ্ছেদ।’
উত্তর গাজার বাসিন্দা মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ‘যেকোনো পরিকল্পনাকে সমর্থন করি, যা যুদ্ধ শেষ করবে। মানুষ যেন বাঁচে…আমরা ক্লান্ত। আমরা চাই যুদ্ধ আজই শেষ হোক, কাল নয়।’ গাজার যুদ্ধে স্ত্রী ও সন্তানদের হারিয়েছেন তিনি।
গাজার আরেক বাসিন্দা রায়েদ সোব বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি হতাশ। ‘প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি যুদ্ধ বন্ধ করব…মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনব’’। কিন্তু কিছুই হয়নি। তিনি এক বছর এখানে আছেন, কিছুই বদলায়নি’, বলেন এই ফিলিস্তিনি।